১
ক্রিকেটের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিত স্যার ডব্লিউ জি গ্রেস অনেক দিন আগে একটি কথা বলেছিলেন, “টস জিতলে ব্যাটিং নাও। যদি তোমার মনে কোনো প্রকার সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে আরেকবার চিন্তা করো এবং ব্যাটিং নাও। যদি এরপরেও সন্দেহ থাকে তাহলে সতীর্থদের সাথে আলোচনা করে ব্যাটিং নাও।” বার্তাটা পরিষ্কার, পরে ব্যাটিং করে আস্কিং রান রেটের চাপ নেওয়ার পক্ষপাতী উনি নন। তবে টসের বিষয়টা যেহেতু নিজের হাতে নেই, কাজেই টস হেরে ফিল্ডিং পেলে না চাইলেও বাধ্য হয়ে অনেক সময় রান করতে হয়। রান তাড়া করাটা যে সবসময় চাপের এমনটা না-ও হতে পারে। অনেক সময়েই বোলিং ডিপার্টমেন্ট প্রতিপক্ষকে অল্প রানে বেঁধে ফেলে ব্যাটসম্যানের কাজটা সহজ করে দেয়। কিন্তু এরপরেও বেশিরভাগ দিনে চাপটার সম্মুখীন হতে হয়। সেই চাপ থেকে বের হবার উপায়টা সেই মুহূর্তে ব্যাটসম্যানকে খুঁজে বের করতে হয়।
এখন এই চাপটা কতটুকু সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের হয়। ফ্যাক্টর যত বেশি থাকবে, চাপ তত বেশি হয়। যে ব্যাটসম্যানটা যত বেশি চাপ সামাল দিয়ে দলকে জয়ের দিক পৌঁছে দিতে পারবেন, তার ইনিংসের মর্যাদা নিঃসন্দেহে তত বেশি হবে। এমন একটা ইনিংসের গল্পই আজ শোনা যাক।
২
খেলাটা ১৯৯৯ বিশ্বকাপের। প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে হট ফেভারিট বলে একটা ট্যাগ কিছু দলের আগে বসানো হয়, সেই বিশ্বকাপেও ব্যতিক্রম হয়নি। কাগজে কলমে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া ছিল সেই টুর্নামেন্টের সেরা তিন দল। এই ফেভারিট হবার চাপটাই হয়তো সহ্য হচ্ছিল না অস্ট্রেলিয়ানদের। ১৯৯২ বিশ্বকাপেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ঘরের মাঠে হওয়া বিশ্বকাপে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া দল হিসেবে দুর্দান্ত থাকার পরেও গ্রুপ পর্ব পার হতে না পারার পেছনে এই চাপকেই দায়ী করা হয়। একই ঘটনা ঘটলো এই বিশ্বকাপে।
প্রথম ম্যাচে দুর্বল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সহজ জয় পেলেও পরপর দুই ম্যাচে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় বাকি ম্যাচগুলো হয়ে গেল নক আউটের মতোই। বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে পরের পর্বে চলে গেলেও সেই বিশ্বকাপের বাই-লজ অনুযায়ী সুপার সিক্স পর্ব শুরু করতে হলো অস্ট্রেলিয়াকে শূন্য হাতে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য চ্যাম্পিয়ন হবার সমীকরণটা খুবই সহজ, টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোর একটিতেও হারা চলবে না। আসলেই কি খুব সহজ?
সুপার সিক্সের প্রথম দুই ম্যাচে ভারত আর জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর বড় বাধাটা আসলো সুপার সিক্স পর্বের শেষ ম্যাচে। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, যারা কিনা হট ফেভারিট হবার সাথে সাথে খেলছেও দুর্দান্ত। সেমিফাইনালে যেতে হলে অস্ট্রেলিয়াকে জিততেই হবে, অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার হারলেও সমস্যা নাই। তবে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলে সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ হবে এই অস্ট্রেলিয়াই, বিপরীতে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে জিম্বাবুয়েকে। কে না চাইবে সহজ প্রতিপক্ষ? আর সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর চেয়ে এখানেই হারানোটা বেশি সুবিধাজনক।
টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং বেছে নিল। হার্শেল গিবসের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি, কালিনানের হাফ সেঞ্চুরি আর ল্যান্স ক্লুজনারের ক্যামিওর সুবাদে দাঁড়ালো ২৭১ রানের একটা শক্ত স্কোর। ২৭২ রানের স্কোর তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া জিততে পারবে না এমন ভাবাটা বোকামি, তবে সম্ভাবনার কথা বললে দক্ষিণ আফ্রিকার পাল্লাই ভারী। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণ, এত রান তাড়া করে সেই টুর্নামেন্টে এখনো পর্যন্ত কেউ জিততে পারেনি। এসব ফ্যাক্টরের সাথে আরেকটি যে ফ্যাক্টর যুক্ত হয়েছিল তা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিং। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তখন ২৭২ রান তাড়া করার অর্থ হচ্ছে মোটামুটি ৩০০/৩১০ রান তাড়া করার মতো।
ব্যাটিং করতে নেমে ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই গিলক্রিস্টকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া চাপে পড়ে যায়। ষষ্ঠ ওভারে মার্ক ওয়াহ রান আউট আর দ্বাদশ ওভারে ডেমিয়েন মার্টিন আউট হবার পর অনেক পাড় অস্ট্রেলিয়ান ভক্তও টেলিভিশন বন্ধ করে অন্য কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল।
মাঠে তখন স্টিভ ওয়াহ নামের যে ব্যাটসম্যান নামলেন, তার নামের সাথে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ নামক একটি ট্যাগ লাগানো থাকলেও ভক্তরা খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না। উইকেট হারিয়ে কাঁপতে থাকা দলটির আস্কিং রান রেটটাও যে ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ৩৮.৩ ওভারে তখনো প্রয়োজন ২২৪ রানের। এই পরিস্থিতিকে আয়ত্বে আনতে হলে দ্রুত রান তোলার পাশাপাশি কোনো একজনের বড় ইনিংস খেলাটাও জরুরি। তখন পর্যন্ত ৭৪.৫৬ স্ট্রাইক রেট আর ৩১.২৫ গড়ের অধিকারী স্টিভ ওয়াহকে নিয়ে বাজি ধরাটাও বোকামি মনে হবারই কথা। তাছাড়া সেই সময় পর্যন্ত স্টিভ ওয়াহর ওয়ানডে সেঞ্চুরিও মাত্র ১টি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে টুর্নামেন্টের ফর্ম, আগের ৭টি ইনিংসে এক জিম্বাবুয়ে বাদে কারো বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরির ইনিংসও নেই। তবে এগুলো তো মাঠের ভেতরের চাপ। এর বাইরেও আরো কিছু চাপ ততদিনে স্টিভ ওয়াহর সঙ্গী হয়ে আছে। পরিস্থিতিটা ভালভাবে বোঝার জন্য সেগুলোর দিকেও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
৩
অনেকের হয়তো জানা নেই যে সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে বিবেচিত স্টিভ ওয়াহর অধিনায়কত্ব একটা সময় কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বিশ্বকাপের আগের সিরিজেই খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজে ড্র করার পর প্রশ্নটা তীব্র হয়ে ওঠে। টেস্ট সিরিজে তবুও ব্রায়ান লারার জ্বলে উঠার একটা বিষয় ছিল, কিন্তু ওয়ানডে সিরিজে ইনজুরির কারণে লারা না থাকার পরেও সিরিজটা ড্র হয়। এর মাঝে একটা সিরিজে শেন ওয়ার্নের অধিনায়কত্ব প্রশংসিত হলে স্টিভ ওয়াহকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার সমালোচনা শুরু হয়ে যায়।
তা সমালোচনা করলেও সেটাকে মিডিয়ার খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজের বাকি দুই দল ছিল ইংল্যান্ড আর শ্রীলংকা। স্টিভের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্নের অধীনে অস্ট্রেলিয়া ভালো করলেও মাঝের দুটো ম্যাচে স্টিভ অধিনায়ক হিসেবে আবারও ফেরত আসেন। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, অস্ট্রেলিয়া সেই দুটি ম্যাচে পরাজিত হয় । পরবর্তীতে স্টিভের ইনজুরির সুবাদে ওয়ার্ন আবারও অধিনায়কত্ব ফেরত পান এবং খুব সুন্দরভাবে দলটাকে পরিচালিত করে টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন করেন। সেই টুর্নামেন্টে শেন ওয়ার্নের অধিনায়কত্ব, পরের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে না পারার ব্যর্থতা, মিডিয়ার দাবি- সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ডটা স্টিভের বদলে ওয়ার্নের হাতে ওঠা অবিশ্বাস্য কিছু ছিল না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড এমন একজনকে অধিনায়ক করতে চাচ্ছিল না যার ভেতর চারিত্রিক স্থিরতার অভাব রয়েছে। মূলত এই ইমেজের কারণেই শেন ওয়ার্নের পরিবর্তে স্টিভ ওয়াহই বিশ্বকাপের অধিনায়ক থেকে যান।
অধিনায়কত্ব নিয়ে সমালোচনা, ফেভারিট হয়েও দলগত পারফর্মেন্স আশাপ্রদ নয়, বড় রান তাড়া করতে গিয়ে উইকেট হারিয়ে ফেলা, হারলেই টুর্নামেন্ট থেকে বাদ, প্রতিপক্ষ বোলাররা উইকেটে আগুন ছড়াচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে অতীত রেকর্ড কিংবা নিজের সাম্প্রতিক ফর্মটাও তেমন আশাপ্রদ নয়– চাপে থাকার জন্য আর কোনো কারণ কি বাকি আছে?
৪
কিছু কিছু খেলোয়াড় আছেন যাদের ভেতর থেকে মূল খেলাটা নাকি বের হয়ে আসে চাপে পড়লেই। এই বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই হয়তো স্টিভ ওয়াহর আরেক নাম ছিল ‘ক্রাইসিস ম্যান’। ক্রিজে নেমে সঙ্গী হিসেবে পেলেন রিকি পন্টিংকে। দুজন মিলে ধীরস্থিরভাবেই শুরুটা করলেন। ২৩ ওভারে ১২৬ রানের পার্টনারশিপ দেখলে অবশ্য মনে হবে খেলাটা আক্রমণাত্মকভাবেই খেলেছিলেন। কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে, শুরুটা তারা করেছিলেন ধীরগতিতে। সেঞ্চুরি পার্টনারশিপের শেষের ৫০ রান এসেছিল মাত্র ২৮ বলে। এরই মাঝে স্টিভ ওয়াহ হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করে ফেলেছেন, সেটাও মাত্র ৪৭ বলে, যার ভেতর রয়েছে ৫টি চার আর ১টি ছয়। অথচ প্রথম ২১ বলে করেছিলেন মাত্র ৬ রান!
এরপরই এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যা না ঘটলে সেই সময়ের পরবর্তী পুরো ক্রিকেট ইতিহাসই হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হতো। ল্যান্স ক্লুজনারের বলে ফ্লিক করার পর স্টিভ দেখলেন যে সেটা ক্যাচ উঠে গিয়েছে মিড উইকেটে। এমন এক ক্যাচ, যা দেবার পর মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানে হয় না। দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবে পরিচিত হার্শেল গিবস ক্যাচটা ঠিকমতোই ধরলেন, কিন্তু উদযাপন করতে গিয়ে হাত থেকে ফসকে গেল ক্যাচটা। স্টিভ যখন জীবন পেলেন তখন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৫৬ রান, দলের প্রয়োজন আরো ১২০। ব্যস, ভাগ্যের হয়তো এতটুকুই সহায়তা প্রয়োজন ছিল স্টিভের।
কিছুক্ষণ পর পন্টিং যখন আউট হলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৯৫ বলে ৯৮ রান। মাঠে নামলেন ফিনিশার হিসেবে পরিচিত মাইকেল বেভান। কিন্তু বেভানও যেন সেদিন চিত্রনাট্যের পার্শ্বনায়ক। উইকেটের চারপাশে শটের ফুলঝুরি ঝরাচ্ছেন স্টিভ। এলওয়ার্দির একটা বল এমনভাবে হুক করলেন যে পরবর্তীতে সেটার নামই হয়ে গেল ‘ফলিং হুক’। ‘ফলিং’ নামকরণের কারণ হচ্ছে হুক করে ক্রিজে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেঞ্চুরিটাও হয়ে গেল স্টিভের, বল খরচ করেছেন মাত্র ৯১টি। কিন্তু সেঞ্চুরি করার পরেও তেমন উচ্ছ্বাস নেই, মূল কাজটা যে তখনো শেষ হয়নি।
৪৬ তম ওভারের ৪র্থ বলে মাইকেল বেভান যখন ৩৩ বলে ২৭ রান করে আউট হলেন তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ২৬ বলে ২৫ রান। মাঠে নামলেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ টম মুডি। এর আগে অস্ট্রেলিয়া যে একবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই দলের দুই সদস্যই মাঠে রইলো সেই বিশ্বকাপে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। অনেক নাটকীয়তার পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোনো ম্যাচ গড়ালো শেষ ওভারে। জয়সূচক রানটা আসলো স্টিভের ব্যাট থেকেই। জয় পাবার পরেই মাঠের মাঝে শূন্যে লাফিয়ে বাতাসে ছুঁড়ে দিলেন মুষ্টিবদ্ধ হাত। এত এত সমালোচনার জবাব দেওয়ার পর এই উদযাপনটা হয়তো একেবারে মানানসই।
৫
এই ম্যাচের পরেই সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বিখ্যাত টাই ম্যাচ। লো স্কোরিং সেই ম্যাচেও স্টিভ ওয়াহ করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। তারপর ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে তো অস্ট্রেলিয়া নতুন যুগেরও সৃষ্টি করেছিল। সেই সর্বজয়ী দলটির ভিত্তিপ্রস্তরটা তৈরির পেছনে স্টিভ ওয়াহর ইনিংসের ভূমিকাটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। যারা নিজের চোখে ইনিংসটা দেখতে পেরেছেন তারা সারা জীবন গল্প করার একটা সুন্দর উপলক্ষ পেয়ে গিয়েছেন সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।