কক্সবাজারের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সেঞ্চুরি করে শূন্যে লাফিয়ে উঠেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চলাকালে এমন একটা ছবি বিশ্বব্যাপী বেশ ভাইরাল হলো। আজও গুগলে শান্তর নাম সার্চ দিলে প্রথমেই আসে এই ছবি।
আক্ষরিক অর্থেই ওই সময় যুব ক্রিকেটের বিশাল তারকা ছিলেন তিনি। শান্ত কেমন ছিলেন ওই সময়, সেটা বোঝাতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের ইতিহাসেরই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
যুব ক্রিকেটে ৩৭.৯১ গড়ে ১,৮২০ রান করা এই ব্যাটসম্যান তখন থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের ‘নেক্সট বিগ থিং’। ঘরোয়া ক্রিকেটেও বিস্তর রান করা শুরু করেন তখন থেকেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) শান্তর মধ্যে সেই আগুনটা টের পেয়েছিল।
২০১৭ সালে, যুব বিশ্বকাপের বছর পেরোতে না পেরোতেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউ জিল্যান্ড সফরে। না, ম্যাচ খেলানোর কোনো পরিকল্পনা তখন তাকে নিয়ে ছিল না। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেই ভূতুড়ে নিউ জিল্যান্ড সফরে একের পর এক ইনজুরি হানা দেওয়ার কারণে ক্রাইস্টচার্চে টেস্টে শেষমেষ অভিষেকটা হয়েই গেল।
বয়স তখন তার মাত্র ১৮। এরপরের বছরই ওয়ানডে অভিষেক। আবারও বড় মঞ্চ, এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে এশিয়া কাপ। তিন ম্যাচ খেললেন, তিনটাতেই ব্যর্থ। রান আসলো মাত্র ২০টি।
রান কম হওয়ার চেয়েও সবচেয়ে বড় যেটা সমস্যা ছিল, তা হল উইকেটে একদমই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সব জায়গাতেই শান্ত তখন স্রেফ একজন ‘লস্ট ওয়ান্ডার কিড’। এমনকি ফাইনালে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বাধ্য হয়ে লিটন দাসের সাথে ব্যাটিংয়ের সূচনা করতে পাঠিয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজকে।
সেই এশিয়া কাপের পরই দল থেকে বাদ পড়ে যান। তাহলে এতদিনের জেনে আসা প্রতিভা, এতদিন তার পেছনে করে আসা বিসিবির বিনিয়োগ – সব কি মিথ্যা হয়ে যাবে?
না। বিসিবি কিংবা শান্ত, কেউই সেটা হতে দেননি।
এরপর শান্ত বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে ফিরেছেন, ‘এ’ দলে খেলেছেন, এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশকে অধিনায়ক হিসেবে স্বর্ণ জিতেছেন, বিপিএলে ঝড়ো সেঞ্চুরি করেছেন। জায়গা ফিরে পেয়েছেন জাতীয় দলে। টেস্টে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাটিং করে নিজের প্রতিভার সদ্ব্যবহার করেছেন।
নিজের প্রত্যাবর্তনের রহস্য ভেঙে শান্ত বলেন,
‘সত্যি কথা বলতে, এর আগে যখন খেলেছি, তখন একটা ভয় কাজ করতো। মনে হতো যে, খারাপ খেললে বাদ পড়তে পারি, বা এমন কিছু একটা ছিল। মানে, আগে যখন ২০১৭ সালে অভিষেক হয়েছে, তখন এই ব্যাপারটা ছিল। তবে এখন আমি মানসিকভাবে তেমন কিছু চিন্তা করছি না। ভালো খেলি কিংবা খারাপ খেলি, সেটা আসলে আমার দিক। দলে থাকব কি থাকব না, সেটা নিয়ে ভাবছি না। তবে চেষ্টা করছি নিয়মিত ভালো খেলার। আর একটা ইতিবাচক দিক হলো, আমাদের কোচিং স্টাফ যারা আছেন, তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস দিচ্ছেন এখন। এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করছে। তারা বারবার বলছে, তুমি অনেক সুযোগ পাবে, এখন শুধু খেলায় ফোকাস করো।’
বোঝাই যাচ্ছে, নেটে শুধু নিজের ঘামই ঝরাননি শান্ত, মস্তিষ্কের অলিগলিতেও বিস্তর কাজ করেছেন। কাজ করেছেন নিজের মানসিকতা নিয়ে। মানসিকতা নিয়ে কাজ করার পেছনে এখানে তার পাশে ছিলেন জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচ সোহেল ইসলাম।
শান্ত বলেন,
‘গত দুই-তিন মাস ধরে আমাদের সোহেল স্যারের সঙ্গে বেশি কথা হচ্ছে। উনি একটা কথাই বলেছেন যে, ‘খুব বেশি চিন্তা করিস না এসব নিয়ে। শুধু খেলায় ফোকাস কর। আর বিশ্বাস করতে শেখ যে এখানে তুই রান করতে পারবি, যেটা তুই ঘরোয়া ক্রিকেটে করিস।’ তাই আমি খুব বেশি খেলা নিয়ে চিন্তিত নই। নিজের যে স্কিল আছে, সেটার উপরে বিশ্বাস রাখছি। আর এই কারণে আমার কাছে মনে হয় যে, আস্তে আস্তে বড় রান করা শুরু করতে পেরেছি।’
শান্ত জানালেন, নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরতে শুরু করেছে তার। আর সেটা হয়েছে মানসিকতার পরিবর্তনের কারণে। বললেন,
‘আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, গত কয়েক মাসে আমার মানসিকতা খুব ভালোভাবে পরিবর্তন হয়েছে। যেটা আমি বললাম যে, নিজের প্রতি বিশ্বাসটা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। স্কিলও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যেমন দেখেন, আগে আমার কাছে মনে হতো যে, একটু তাড়াহুড়ো করছি। এখন সেই জিনিসটা বুঝতে পেরেছি। এখন থেকে দেখেশুনে বলের মেরিট অনুযায়ী খেলা শুরু করছি। আমার মনে হয়, ইনিংসের শুরুটা আগের চেয়ে গোছানো হয়েছে।’
টেস্টের পর এবার তিনি ডাক পেয়েছেন ওয়ানডে দলেও। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চলতি সিরিজেই তার অভিষেক হয়ে যেতে পারে। নির্বাচকদের এই সিদ্ধান্তই বলে দেয় যে, তিনি বিসিবির লম্বা সময়ের পরিকল্পনায় আছেন। শান্ত এখন এই ভরসার প্রতিদান দিতে চান। আর সেখানেও নিজের নির্ভার মানসিকতা ধরে রাখতে চান তিনি।
বললেন,
‘লম্বা সময় ধরে আমি পরিকল্পনায় আছি, এটা একটা ইতিবাচক দিক। সেটা প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই থাকা উচিত। আমি মনে করি, যখন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লাম, এরপর আমি হাই পারফরম্যান্স, ‘এ’ দলে ছিলাম। এটা আমার জন্য একটা ইতিবাচক দিক যে নির্বাচকেরা আমাকে ওই জায়গাতে সুযোগ দিয়েছেন। প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই এমন সুযোগ পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমি এখন মনে করি যে, মাঠে যখন নামি, তখন আগের চেয়ে বেশি নির্ভার থাকি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ওয়ানডে দলে ডাক পাওয়ার খবর পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ, যদি সেখানেও সুযোগ পাই ম্যাচ খেলার, তাহলে ভালো করার চেষ্টা করবো।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শান্ত সাতটি চারের সৌজন্যে ৭১ রানের ইনিংস খেলেছেন ১৩৯ বল খেলে। যতটুকু সময় উইকেটে ছিলেন, যেটা করা দরকার, সেটাই করেছেন। ভালো বলকে সমীহ করেছেন, বাজে বলকে তার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রীতি মেনে যথারীতি আউট হয়েছেন মনঃসংযোগের ঘাটতিতে।
ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরির ইনিংসটা তাই তিন অংকের ম্যাজিক্যাল ফিগারে পৌঁছায়নি। শান্তও জানেন, সেঞ্চুরির খুব কাছ থেকে ফিরেছেন তিনি। বললেন,
‘অবশ্যই সুযোগ ছিল, যেহেতু উইকেট ভালো ছিল। তবে এরপরেও আমি মনে করি যে, যতটুকু ব্যাটিং করেছি, আউটটা ছাড়া সেটা ভালো হয়েছে। তবে যেভাবে খেলছিলাম, শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, তাতে ইনিংসটা বড় করা উচিত ছিল।’
শান্ত এই ইনিংসে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন, যেমনটা ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের পরই বুঝেছিলেন ভূলটা কোথায় হয়েছিল। সেজন্যই তিনি হারিয়ে যাননি। এবার আরো বড় ইনিংসের অপেক্ষা, সত্যিকারের বিস্ফোরণের অপেক্ষা। তাহলেই তো যুব ক্রিকেটের সেই সুপারস্টারের সত্যিকারের প্রত্যাবর্তন হবে!