দুই মাস পরই বড় পর্দায় উঠতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯, ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এবং কুলীন প্রতিযোগিতার ১২তম আসর।
আগের ১১ আসরে খেলে গিয়েছেন ক্রিকেটের অনেক রথী-মহারথীরা। বল হাতে পিচে আগুন ঝরিয়েছেন ডেনিস লিলি, ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আকরাম, কপিল দেবের মতো তারকারা। ঘূর্ণির ভেলকিতে ব্যাটসম্যানদের নাকাল করেছেন শেন ওয়ার্ন, মুরালিধরন, সাকলাইন মুশতাকরা। তবে স্পিনারদের তুলনায় ম্যাচের মোড় ঘুরানোয় বিশ্বকাপে সফল বেশি পেসাররা।
একক নৈপুন্যে অনেক ম্যাচই বের করেছেন বোলাররা। এক জাদুকরী স্পেলে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপকে তাসের ঘরের মতো গুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও একেবারে কম নয়। তবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে ইনিংসে সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়ার সংখ্যা ৭টি। তাও এই ঘটনা ঘটেছে মাত্র চারবার, যার সর্বশেষ সংযোজন টিম সাউদি। আর বাকিরা হলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা, অ্যান্ডি বিকেল, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইন্সটন ডেভিস।
তবে বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ বোলিং পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে গেলে শুধু উইকেটসংখ্যাই বিবেচ্য নয়। তার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ, ম্যাচের গুরুত্ব ও আবহও সমানভাবে কার্যকর। সেইসব কিছু মাথায় রেখেই বেছে নেওয়া হলো ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা পাঁচ বোলিং পারফরম্যান্স।
৫. আশিষ নেহরা: ৬/২৩, বনাম ইংল্যান্ড (২০০৩)
ইংল্যান্ড বনাম ভারত।
সেই ম্যাচটি দুই দলের জন্যই হয়ে দাঁড়ায় বাঁচা-মরার লড়াই। যে জিতবে, সেই দলই শুধু পরবর্তী রাউন্ডের জন্য কোয়ালিফাই করবে। এইরকম সমীকরণে দাঁড়িয়ে ডারবানে প্রথমে ব্যাট করে ২৫১ রান সংগ্রহ করে ভারত। মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং স্কোর বলে শুরুতেই ভারতের দরকার ছিল মোমেন্টাম। ভরসা করার মতো পেসার নেহরাও আগের ম্যাচে ছিলেন উইকেটশূন্য। কিন্তু জ্বলে ওঠার জন্য নেহরা বেছে নিলেন মোক্ষম ম্যাচই।
নিজের প্রথম ওভারেই সাজঘরে ফেরান ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হোসাইনকে। ঠিক পরের ডেলিভারিতেই রানের খাতা খোলার আগেই সেই নেহরার হাতেই আত্মাহুতি দেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট। প্রথম পাওয়ারপ্লে’তেই নেহরা তুলে নেন আরো দুইটি মূল্যবান উইকেট, মাইকেল ভন এবং পল কলিংউডও শিকার হন আশিষ নেহরার। ততক্ষণে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকেই গেছে ইংল্যান্ড। কিছুটা আশা জোগানোর চেষ্টা করলেও ক্রেইগ হোয়াইটও পারেননি, হার মানেন দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে আসা নেহরার কাছেই। পরবর্তীতে রনি ইরানির উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে ছয়টি উইকেট নিজের করে নেন নেহরা। ইংল্যান্ডও গুটিয়ে যায় মাত্র ১৬৮ রানে।
ম্যাচের আগেই অ্যান্ডি ক্যাডিক টেন্ডুলকারকে আর দশজন সাধারণ ব্যাটসম্যানের সাথে তুলনা করে ম্যাচের ঝাঁঝ বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ। আগে ব্যাটিংয়ে নেমে টেন্ডুলকারের হাফসেঞ্চুরিতে ভারত ২৫০ রান সংগ্রহ করলেও ইংল্যান্ড এর বোলিং লাইনআপের সামনে হাঁসফাঁসই করেছিলেন তিনি। তখনই বুঝা গিয়েছিল, ভারতকে জিততে হলে বল হাতে করতে হবে উড়ন্ত সূচনা। উড়ন্ত সূচনাই করেছিল ভারত। তবে ত্রাস হয়ে নেহরার আগমন কিছুটা পরে। ১৩তম ওভারে নেহরা আসার সময়ে ইংল্যান্ডের স্কোরকার্ডে লেখা ২৮/২। তখনও প্রয়োজন ২২৮ বলে ২২৩ রান। দুই স্পেলে নেহরার দশ ওভারশেষে ইংল্যান্ডের স্কোরকার্ডে লেখা ১০৭/৮। ৩১ ওভারের মধ্যেই ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপকে একাই তছনছ করে দেন নেহরা। আর অনুমিতভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে নেহরার হাতে।
নেহরার বোলিং ফিগার ৬/২৩ এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার।
ওয়ানডেতে দুইবার ইনিংসে ৬ উইকেট নেওয়া একমাত্র ভারতীয় বোলারও তিনিই। তবে নেহরাকে নিঃসন্দেহে সবাই মনে রাখবে ডারবানের কিংসমিডের সেই বিধ্বংসী স্পেলের জন্যই।
৪. উইন্সটন ডেভিস – ৭/৫১, বনাম অস্ট্রেলিয়া (১৯৮৩)
উইন্সটন ডেভিসের ১৯৮৩ ফাইনাল না খেলতে পারাটা বিশ্বকাপের অন্যতম আক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সবার বিশ্বাস ইনজুরির জন্য ফাইনাল মিস না করলে টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিততো ওয়েস্ট ইন্ডিজই। আর এই ধারনা হবে না-ই বা কেন! পুরো বিশ্বকাপেই দুর্দান্ত বোলিং করে এসেছিলেন ডেভিস। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৫১ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার। প্রথমত, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা বোলিংয়ের এই রেকর্ড টিকে ছিল টানা ২০ বছর। ২০০৩ সালে এসে নামিবিয়ার বিপক্ষে ১৫ রানে ৭ উইকেট নিয়ে সেই রেকর্ড ভাঙেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। দ্বিতীয়ত, উইন্সটন ডেভিসই ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ৭ উইকেট পাওয়া খেলোয়াড়।
জয়ের জন্য মরিয়া দুই দলের এই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ৬০ ওভারে তারা ৯ উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ২৫২ রান। ম্যাচের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়া বড় ধাক্কা খায়। মাইকেল হোল্ডিংয়ের বাউন্সারে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন ওপেনার গ্রায়েম উড। পরবর্তীতে অ্যান্ডি রবার্টস ফিরিয়ে দেন কেপলার ওয়েসেলসকে। তবে এরপরই ঘুরে দাঁড়ায় অজিরা। এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ছিল ২০ ওভারে ১১৪ রানে ২ উইকেট। ২ উইকেট হলেও কার্যত গ্রায়েম উডের ইনজুরিতে তা মূলত ৩ উইকেটই। ম্যাচ জিততে ৪০ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার তখন প্রয়োজন ১৩৯ রান মাত্র।
সেই সময়েই দৃশ্যপটে আবির্ভাব এক আনকোরা পেসারের। উইন্সটন ডেভিস নামের সেই ২৪ বছর বয়সী বোলারই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেন অজিদের উপর। বোলিং তাণ্ডবে ১১৪ রান থেকে ১৫১ করতেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। শেষ সাত উইকেটের সাতটিই তুলে নেন উইন্সটন ডেভিস। আর সেই হারেই নকড আউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার। আর নিজের নাম ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখান উইন্সটন ডেভিস।
৩. শেন বন্ড – ৬/২৩, বনাম অস্ট্রেলিয়া (২০০৩)
একঝাঁক তারকা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে আসে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া। সুপার সিক্সের গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মুখামুখি হয় পাশাপাশি দুই দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে অস্ট্রেলিয়া পড়ে শেন বন্ডের তোপের মুখে। পোর্ট এলিজাবেথের সেই পিচ ছিল পেসারদের জন্য স্বর্গীয়। তারই ফায়দা লুটে নেন সেই সময়ের অন্যতম গতিদানব শেন বন্ড। ইনসুইং ও আউটসুইংয়ের পসরা সাজিয়ে নাকানিচুবানি খাওয়ান অস্ট্রেলিয়ার সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইনআপকে। এক পর্যায়ে ৮৪ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া, যার মধ্যে ৬টি উইকেটই বন্ডের ঝুলিতে। কিন্তু ততক্ষণে অধিনায়ক ফ্লেমিং বন্ডের ১০ ওভারের পুরোটাই ব্যবহার করে ফেলেন। আর তাতেই বিপাকে পড়ে নিউ জিল্যান্ড। অন্য কোনো বোলাররা তেমন সুবিধা না করতে পারায় মাইকেল বেভান ও অ্যান্ডি বিকেল মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বোলার বিকেলকে নিয়ে বেভান গড়েন ৯৭ রানের পার্টনারশিপ, বিকেল করেন সর্বোচ্চ ৬৪ রান। তবে বন্ডের শুরুর ধাক্কা সামাল দেওয়া ততটা সম্ভব হয়নি অজিদের। শেষ পর্যন্ত ২০৮ রানের দলীয় সংগ্রহ দাঁড় করায় তারা।
তবে বন্ডের নৈপুন্য বিফলে যায় ম্যাকগ্রা ও ব্রেট লি’র কাছে। এই দুইজনের তোপে ব্ল্যাক ক্যাপসরা অলআউট হয় মাত্র ১১২ রানে। তবে বন্ডের সামনে গিলক্রিস্ট, হেইডেন, পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিনদের অসহায়ত্ব চোখ কেড়ে নিয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সেই তারকায় ঠাসা দলের বিপক্ষে কোনো বোলাররাই সুবিধা করতে পারতেন না। কিন্তু সেই এক ম্যাচেই বন্ডের সামনে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে পুরো অস্ট্রেলিয়া দল। তাই দলকে জেতাতে না পারলেও বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা স্পেল হয়ে থাকবে শেন বন্ডের এই বোলিং ফিগার।
২. অ্যান্ডি বিকেল – ৭/২০, বনাম ইংল্যান্ড (২০০৩)
২০০৩ বিশ্বকাপ ছিল বোলারদের বিশ্বকাপ। প্রায় বেশিরভাগ ম্যাচেই বোলাররা পথ দেখিয়েছেন দলকে। তেমনি আরেকটি স্পেল হচ্ছে অ্যান্ডি বিকেলের করা বোলিং। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া। নিজের ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে উদ্ধার করেন বিকেল। ঠিক তিন দিন আগে নামিবিয়ার সাথে ম্যাকগ্রার ৭ উইকেট নেওয়ার পরই এই কীর্তিতে ভাগ বসান বিকেল।
ইংল্যান্ডের শুরুটা হয়েছিল ভালোই। মার্কাস ট্রেসকোথিক আর নিক নাইট মিলে শুরুতে ভালো সূচনা এনে দিলেও মুহূর্তেই ইংল্যান্ডকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন বিকেল; ৬৬/০ থেকে ইংল্যান্ড পরিণত হয় ৮৭/৫-য়ে। এর মধ্যে ৪টি উইকেটই বিকেলের শিকার। এরপর অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও ফ্লিনটফের দৃঢ়তায় ট্র্যাকে ফেরে ইংল্যান্ড। কিন্তু দ্বিতীয় স্পেলে এসে আবারও জোড়া আঘাত অ্যান্ডি বিকেলের। ফিরে যান স্টুয়ার্ট ও ফ্লিনটফ দুইজনেই। সবশেষে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ২০৪ রান, যার মধ্যে ৭টি উইকেটই নিয়েছেন বিকেল। ১০ ওভার বোলিং করে ২০ রানে সাত উইকেট নিয়ে মূলত তিনিই ইংল্যান্ডকে বেঁধে রেখেছিলেন ২০৪ রানে। বিকেলের নেওয়া ৭ উইকেটের মধ্যে ৫টিই ছিল বোল্ড অথবা কট বিহাইন্ড।
তবে সেই ম্যাচে শুধু বোলিংই নয়, ব্যাটিং করেও অস্ট্রেলিয়াকে বাঁচান এই পেসার। ২০৪ তাড়া করতে নেমে ১১৪ রানে ৭ উইকেট হারায় অজি বাহিনী। সেখান থেকে বেভান ও বিকেল মিলে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের বন্দরে ফেরান। তবে ম্যাচশেষে আলোচনার মূলে ছিল বিকেলের সেই অতিমানবীয় বোলিং স্পেল।
১. গ্যারি গিলমোর – ৬/১৪, বনাম ইংল্যান্ড (১৯৭৫)
প্রথম বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা স্পেল হিসেবে খ্যাত গ্যারি গিলমোরের সেই স্পেলের কাছেই ধরাশায়ী হয় পুরো ইংল্যান্ড দল। ইংল্যান্ডের প্রথম ৬টি উইকেটের সব কয়টি উইকেটই নিজের করে নেন গিলমোর। তাতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ইংল্যান্ড। ৩৬ রানে ছয় উইকেট হারানোর পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা, তুলতে পারে মাত্র ৯৪ রান। গ্যারি গিলমোর ১২ ওভার বোলিং করে মাত্র ১৪ রানের খরচায় নেন ৬টি উইকেট, আর ৬ উইকেটের মধ্যে শুধুমাত্র টনি গ্রেগের উইকেটটিই এসেছে ফিল্ডারের সহায়তায়। রড মার্শের কাছে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে টনি গ্রেগ শিকার হন গিলমোরের। আর বাদবাকি পাঁচটি উইকেটই বোল্ড করে, না হয় লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে তুলে নেন গিলমোর। গড়ে মাত্র ১.১৬ রান দেন তিনি প্রতি ওভারে, যা কি না বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলিং এর রেকর্ড হিসেবে এখনও টিকে রয়েছে।
তবে এই লক্ষ্য তারা করতে গিয়েই হাঁসফাঁস অবস্থা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। ৩৯ রানেই ৬ উইকেট হারায় অজিরা। কিন্তু গিলমোর ত্রাণকর্তা হিসেবে আসেন ব্যাট হাতেও, তার করা ২৮ রানেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে অজিরা। তবে সবচেয়ে মিতব্যয়ী এবং আগুনঝড়ানো বোলিং দিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা স্পেলটি নিজের করে নিয়েছেন গ্যারি গিলমোর।