১৯৮১ সালে ৩ অক্টোবর সুইডেনের মালমোতে বসনিয়ান বাবা এবং ক্রোয়েশিয়ান মায়ের ঘরে জন্ম হয় জাতান ইব্রাহিমোভিচের। জাতানের বাবা এবং মায়ের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিলো না। ফলে দুই বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের সাক্ষী হতে হয় ইব্রাহিমোভিচকে। সুইডেনের ডিভোর্সের আইন অনুসারে জাতানের লালন-পালনের দায়িত্ব পান তার মা। সেখান থেকেই কঠিন এক শৈশবের শুরু হয় তার।
“আমার মায়ের সাথে বসবাস করা আর পরিবারে নতুন একজন সৎ বাবার আগমন দেখা আমার জন্য খুব কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল।’”
নিজের আত্মজীবনী ‘I am Zlatan’-এ এভাবেই নিজের শৈশবের কথা জানান এই সুইডিশ ফুটবলার।
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ খুব ভালভাবে নিতে পারেননি ইব্রাহিমোভিচ। ফলে এক পর্যায়ে তার শরীরের ওজন অস্বাভাবিক হারে কমে যায় । এই অবস্থা কেটে উঠতে ইব্রার বেশ সময় লাগে। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন যখন বাবার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ পান। মায়ের চেয়ে বাবাকেই বেশি পছন্দের ছিল ইব্রাহিমোভিচের। বাবার সাথে বেশ কিছু ঘটনার কথা বর্ণনা করেন ইব্রাহিমোভিচ। একবার ইব্রার বাবার হাতে খুব বেশি টাকা ছিলো না। কিন্তু তিনি ইব্রার জন্য IKEA থেকে একটি খাট কিনেন। খাট কিনলেও সেটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার ভাড়া ছিলো না তাদের।
“আমরা নিজেরাই খাটটি বহন করে বাসায় নিয়ে যাই। এটি খুবই চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। আমি আমার মায়ের সাথে সময় কাটিয়েছি কিন্তু সত্যিকারে বাস করেছি আমার বাবার সাথে। একবার আমার বাবা আমাকে তার বেতনের সব টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে এটা আমি নিজের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি।”
স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পরেও সেফিক ইব্রাহিমোভিচের মানসিক অবস্থা খুব ভাল ছিলো না। বলকান যুদ্ধে নিজের গ্রামে সার্বিয়ান সৈন্যদের আক্রমণের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বেশিরভাগ সময়ে মদেই ডুবে থাকতেন তিনি। ফলে ইব্রার শৈশব ছিল খুবই একা এবং মেজাজ থাকতো রুক্ষ। জাতানের ভাষায়, “আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল বাবার সঙ্গ না পাওয়া।”
বসনিয়ান কেয়ারটেকার এবং ক্রোয়েশিয়ান ক্লিনারের ছেলে হিসেবে জাতান ইব্রাহিমোভিচের জন্য বেড়ে ওঠা অনেক কঠিন ছিল। অল্প বয়সে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের খারাপ প্রভাবে ইব্রা একরোখা চরিত্রের মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠেন। তার মতে, “কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করত না, আমার দিন কেমন ছিল।” ঘরে কারো সান্নিধ্য না পেলেও মালমোর অভিবাসী, যারা নিজেদের গ্যাংস্টার ধরনের যাবতীয় কাজকর্মের প্রতিনিয়ত হতেন মিডিয়ার সংবাদ, তাদের মাঝেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন লম্বা নাকধারী এই যুবক। এই সময়টাতেই আত্মপরতা এবং মেজাজি স্বভাব সত্যিকার অর্থে ভর করে ইব্রাহিমোভিচের উপর। সেই সময়ে ইব্রা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সাইকেল এবং মিষ্টি চোর হিসেবে। একটি সাক্ষাতকারে ইব্রাহিমোভিচ বলেন, “আমাদের কিছু দরকার হলে আমাদের কাজ ছিল দোকানে যাওয়া আর চুরি করা…বিশেষ করে সাইকেলের সাথে আমার বেশ সখ্যতা ছিল।”
একবার তো এমনই হয়েছে যে, নিজের কোচের সাইকেল চুরি করে ফেলেছিলেন ভুল করে! পরে বুঝতে পেরে কীভাবে ফেরত দেবেন, ঠিক করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ফেরত দিলে কোচ বুঝতে পারলেও তেমন কিছু বলেননি।
নিজের জন্মস্থান রোজেনগার্ডকে জাতান এখনও স্বর্গ বলেই মনে করেন। সাম্প্রতিক সময়ে জাতান জানান, নিজের পুরনো বাসস্থানকে বিশ্বের সবচেয়ে দামী হোটেলগুলোর চেয়েও বেশি আপন মনে হয় তার। যদিও জাতান ভোলেননি, রোজেনগার্ড ছিল খুবই ভয়ংকর জায়গা।
তিনি বলেন,
“ফুটবল আমাকে মুক্ত করেছে। একটা সময়ে রোজেনগার্ডে মদ এবং নেশা ছিল আমার জীবন। আমি খুশি যে আমি এগুলো থেকে দূরে থাকতে পেরেছি। সুতরাং যাদের বাবা নেই, যারা নিজেদেরকে ভিন্ন ভাবে অথবা যারা নিজেদেরকে দুর্ভাগা মনে করে তাদের প্রতি আমার উপদেশ থাকবে, নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, একদিন তুমি পারবে সফল হতে। সুযোগ সব সময়েই আছে, সবকিছুই তোমার উপর নির্ভর করে।”
৬ বছর বয়সে একজোড়া বুট পাওয়ার পর জাতান নিজের মায়ের ঘরের বাইরের মাঠে খেলা শুরু করেন। ছোট এবং নুড়ি পাথরে ভরা রুক্ষ মাঠে জাতান এবং বন্ধুরা বিভিন্ন স্কিল, ট্রিকস, স্পিন, ফ্লিক এবং শট অনুশীলন করতো। জায়গা কম থাকায় পায়ে এবং মাথায় দুই জায়গাতেই খুব দ্রুত হতে হত। জাতানের মতে,
“যখন আমরা রোজেনগার্ডে ফুটবল খেলতাম , ফুটবল মানেই ছিল অন্যের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল বের করা, ভিন্ন ভিন্ন স্কিল প্রদর্শন। প্রতিটি ট্রিকের পর দর্শকরা উল্লাস করতো। কে সবচেয়ে কঠিন শট মারতে পারে, কে সবচেয়ে ভালো মুভ দেখাতে পারে- সেগুলোই ছিল আসল। আমি এটি খুবই ভালোবাসতাম।”
নিজের খরচ জোগাতে ১৫ বছর বয়সে ফুটবল খেলার পাশাপাশি মালমো ডকে কাজ শুরু করেন তিনি। একপর্যায়ে ফুটবল খেলা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু তার কোচ বুঝিয়ে শুনিয়ে ফুটবল খেলায় মনোযোগ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তার। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করলে আরও একবার বাধার সম্মুখীন হন ইব্রা। ১৭ বছর বয়সে যোগ দেন নিজের শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাব মালমোতে। একই দলের আরেক খেলোয়াড়ের বাবা-মা আরও কয়েকজনের অভিভাবক সহ ইব্রাকে ক্লাব থেকে বহিষ্কারের জন্য ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট বরাবর দরখাস্ত করেন। এর পেছনে কারণ ছিল, ইব্রা তাদের একমাত্র ছেলের মাথায় ঢুস মেরেছিল। ইব্রা বলেন,
“সেই খেলোয়াড় তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলো এবং সবাইকে অনুরোধ করছিলো, যাতে সবাই এটিতে স্বাক্ষর করে যাতে তারা আমাকে ক্লাব থেকে বের করে দেয়। আমি যদি আমাকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাহলে আমি কখনোই এটি আবার করতাম না। কিন্তু তখন আমি ছিলাম একজন রাগী যুবক।”
১৮ বছর বয়সে ইব্রাহিমোভিচ বুঝতে পারেন, ফুটবলে তার ভালো ভবিষ্যৎ আছে, একমাত্র ফুটবলই পারে তাকে দরিদ্রতা থেকে মুক্ত করতে। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল মালমো ফুটবল ক্লাবের হয়ে তার অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলে এবং পরের মৌসুমেই মালমোকে তুলে নিয়ে আসেন সুইডেনের প্রথম বিভাগে। পরের বছরই ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকার তৎকালীন সুইডিশ ট্রান্সফার রেকর্ডে পাড়ি জমান বিখ্যাত ডাচ ক্লাব আয়াক্স ফুটবল ক্লাবে। সেখানে অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে লিগ জেতেন দুবার। মাঠে সাফল্য আসলেও মিডিয়াতে ততদিনে মেজাজি খেলোয়াড়ের তকমা পেয়ে যান জাতান।
যদিও জাতান অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তিনি যেখানেই গিয়েছেন বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। এটির কারণ হতে পারে জাতানের উদ্ধত স্বভাব, যার কারণ ছিল তার দুঃসহ শৈশব। এর মাঝে দুটি ঘটনা মিডিয়াতে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। আয়াক্সে থাকাকালীন নিজের দলের খেলোয়াড় রাফায়েল ভন ডার ভার্টের সাথে ঝগড়ার পরে তার পা ভেঙে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন জাতান। কিছুদিন পরে নেদারল্যান্ড এবং সুইডেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে মুখোমুখি হলে জাতানের ট্যাকলে ইনজুরড হয়ে মাঠ ছাড়েন এই ডাচ খেলোয়াড়। পরবর্তীতে ভন ডার ভার্ট দাবি করেন, জাতান এটি ইচ্ছে করে করেছেন। তবে নিজের বায়োগ্রাফিতে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এটি অনিচ্ছাকৃত ছিল বলে জানান ইব্রা।
তায়কান্দোতে ব্ল্যাকবেল্টধারী সুগঠিত দেহের অধিকারী ইব্রা আরেকবার মারামারিতে জড়ান এসি মিলান সতীর্থ আমেরিকান ফুটবলার অগুচি অনিউর সাথে। অনিউ নিজেও ছিলেন জাতানের মতোই দীর্ঘ এবং বিশাল দেহের অধিকারী। এই মারামারিতে জাতানের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছিলো। জানা যায়, এই দুজনের মধ্যকার এই মারামারি থামাতে কোচ সহ প্রায় ১০ জন মানুষ লেগেছিল। বারবার ক্লাব বদলের কারণেও জাতান জন্ম দিয়েছেন অনেক বিতর্কের। এই কারণে অনেক খেলোয়াড় এবং দর্শকের তেমন একটা পছন্দের পাত্র নন এই স্ট্রাইকার।
১০ বছর বয়সে নিজের পাড়ার ক্লাব এফবিকে বলকানের হয়ে যখন খেলছিলেন, একটি ম্যাচে দ্বিতীয় অর্ধে মাঠে নামেন তিনি, যখন তার দল ৫-০ তে পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের দায়িত্ব একাই নিজের মাথায় তুলে নেন। একাই ৮ গোল করে দলকে জেতান ৮-৫ গোলে। এই ম্যাচের মাধ্যমেই জন্ম হয়েছিলো জাতান ইব্রাহিমোভিচের। খুব অল্প বয়সেই ইউরোপের অনেক বড় দলের নজর পড়েছিল এই সুইডিশ বালকের উপর।
ব্যক্তিগত জীবনে এখনো বিয়ে না করলেও সাবেক সুইডিশ মডেল হেলেনা সেগারের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে আছেন জাতানের। তাদের রয়েছে দুই সন্তান। নিজের শরীরে ট্যাটু আঁকাতে পছন্দ করেন এই তারকা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার গোল করে জাতান নিজের জার্সি খুলে ট্যাটু প্রদর্শন করেন। জাতিসংঘের ফুড প্রোগামের অংশ হিসেবে জাতান বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত আছে এমন ৫০ জনের নাম নিজের শরীরে লেখান। জাতানের শরীরে অনেকগুলোই ট্যাটু আছে, কিন্তু কিছু ট্যাটু আছে যেগুলো তার ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে। তার শরীরে রয়েছে ড্রাগনের একটি ট্যাটু, যেটি জাতানের যোদ্ধার মতো মানসিকতার পরিচয় বহন করে। আরও আছে কই মাছের একটি ট্যাটু, যেটি প্রকাশ করে স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার মনোভাব।
ফুটবলের বাইরে সফল ব্যবসায়ীও জাতান ইব্রাহিমোভিচ। সুইডেনে A-Z নামে একটি ব্র্যান্ড রয়েছে তার। সুইডিশ জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়া এই তারকার মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ফোর্বসের মতে, তার বার্ষিক আয় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সুইডিশ হলেও জাতানের ফুটবল আইডল ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রোনালদো। ছোটবেলায় রোনালদোকেই অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন ৩৬ বছর বয়সী এই ফুটবলার। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের হয়ে লিগ জেতা এই স্ট্রাইকার যেখানেই গেছেন, যেই কোচের অধীনেই খেলেছেন, গোল করেছে অনেক। নিজের সময়ের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকার বলেন,
“আমি সবসময়েই নিজেকে দ্বিতীয়তে রাখতে পছন্দ করি। আমি যেখানেই গিয়েছি আমার সতীর্থদের, ভক্তদের খুশি করার চেষ্টা করেছি। আমি গত ১০ বছরে ৫টি ভিন্ন ক্লাবের ৯ বার লিগ জিতেছি। কিন্তু আমি তখনই সন্তুষ্ট, যখন আমার সতীর্থ, কোচ, ভক্ত সবাই খুশি। আমার হৃদয় অনেক বড়।”
জাতানের সাক্ষাতকারগুলো দেখলে একটি জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, তার নিজেকে খুবই পছন্দ। বাস্তবিকেই নিজের নাম তার এতটাই পছন্দ যে, ২০০৩ সালে সুইডেনে নিজের নাম ট্রেডমার্ক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করান, যাতে অন্য কেউ তার নাম বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে না পারে। ফ্রান্সে এখন ‘Zlataner’ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘To Crush’। সুইডিশ শব্দভাণ্ডারে ক্রিয়াপদ হিসেবে ‘To Zlatan’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে, যেটির অর্থ হচ্ছে ‘To do something audacious or outrageously brilliant’। জাতান ইব্রাহিমোভিচ শুধু একজন ফুটবলারের নাম নয়। তিনি হয়ে উঠেছেন একজন প্রতীক, জীবনযাপনের এক স্বতন্ত্র ধারা।
নিজের রাগী স্বভাব এখনো বজায় থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইব্রা বলেন, “আগে রাগ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতো কিন্তু এখন আমি এখন রাগকে নিয়ন্ত্রণ করি।” ৯ বার সুইডেনের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পাওয়া এই খেলোয়াড় ২০১১ সালে নিজের আত্মজীবনী ‘I am Zltan’ প্রকাশ করেন। বেস্ট সেলিং খেতাব পাওয়া এই বইয়ে নিজের শৈশবের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তিনি। পেপ গার্দিওলার সাথে তার সম্পর্ক নিয়েও বেশ খোলাখুলি আলোচনা করেছেন এখানে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
তথ্যসূত্র: Zlatan Ibrahimovic; I am Zlatan.
ফিচার ইমেজ: Deadspin