‘প্রতিভার জাত লাগে না কিন্তু পাত লাগে। প্রতিপালন-লালন ছাড়া সকল প্রতিভা কুসুমেই বিনষ্ট হয়ে যায়।’
অনুযোগটা আর যে-ই করুন, নাজমুল হোসেন শান্তর সে সুযোগটা অন্তত নেই। ক্রিকেট-পাড়ায় পা রাখা সকলেই এক বাক্যে মেনে নেন, এযাবৎ কালে তো তার চেয়ে বেশি সুযোগ কিংবা সুবিধা আর কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটার পাননি, আর কারও ওপর দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা এত পরিমাণে বিনিয়োগ করেনি। আর তিনি যে অভিজ্ঞতা দিলেন, এরপরে গিয়ে আর কারও ক্ষেত্রে এ পরিমাণ সময়-শ্রম-অর্থ ঢালা হবে কি না, সেটাও দেখা দিচ্ছে বড় প্রশ্ন হয়ে।
অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে শেষ করেছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে। বিসিবি ভেবেছিল, টেস্টের ওয়ান ডাউন ব্যাটিং পজিশনটা নিয়ে বাংলাদেশের আক্ষেপের বোধ হয় যুগান্ত হলো। ‘এ’ দলের সফরগুলোতে নিয়ম করে পাঠানো হলো তাকে, কোনোটায় আবার অধিনায়ক হিসেবে; জাতীয় দলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো তার নাম, খেলানোর জন্য অবশ্য নয়। পাকাপাকি ভবিষ্যৎটা যেহেতু ওখানেই, লেগে থেকে জল-হাওয়াটা বুঝে নেবেন সেখানকার, এই উদ্দেশ্যেই।
এমনই এক নিউ জিল্যান্ড সফরে গিয়েই যদিও আচমকা টেস্ট অভিষেক। অভিষেকটা স্বপ্নীল হয়নি, দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩০ রান। তবে এ রান তুলতেই ১১৬ বল কাটিয়ে দিয়েছিলেন উইকেটে; সম্ভবত বিসিবি কর্তারা দেখেছিলেন আলোর দিশা, ‘আরেকটু মাজা-ঘষা করলে এ-ই তো নিশ্চিত হীরা।’
তবে সেই আলোটা আলেয়ার রূপ নিয়েছে পাঁচ বছরের পথ হেঁটে। ১৭ টেস্ট খেলে ফেলার পরে তার স্ট্যাটবোর্ডের রিডিংটা এমন: ২৬.৭১ গড়ে ৮২৮ রান। ৩২ ইনিংসে দুই সেঞ্চুরির পাশে দুই ফিফটি। করোনা-বিরতি কাটানোর পর থেকে এই অব্দি দলের ওয়ান ডাউন পজিশনটা বিসিবি একরকম লিখেই দিয়েছে তার নামে। দলে জায়গা পাকা করার আগে এমন সুযোগ মেলেনি চেতেশ্বর পুজারা, মারনাস লাবুশেন, কেন উইলিয়ামসনদেরও। শান্তর ব্যর্থতাটা আরও বেশি চোখে পড়ছে এ কারণে।
তিন নম্বরে ব্যাট করতে গিয়েই জন্ম দিয়েছেন আরও বড় একটা প্রশ্নের। এক অর্থে তিন নম্বর পজিশনটা তো ইনিংস উদ্বোধনেরই সমার্থক, প্রথম বলে কোনো এক ওপেনার ফেরা মানে নন-স্ট্রাইকারেরও আগে নতুন বলের সামনে পড়তে হচ্ছে ওয়ান ডাউনে নামা ব্যাটারকে। প্রতিটা দলই তাই তিন নম্বরে খেলায় টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটারদের। প্রশ্নটা হচ্ছে, শান্ত সেরকম শক্ত-পোক্ত টেকনিক্যাল ভিত নিয়ে এসেছেন কি না?
তার আউট হওয়ার ধরনগুলো নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করলেই উত্তর মেলার কথা। দেখা যাচ্ছে, ৩২ ইনিংসে ব্যাট করে নট আউট ছিলেন একবার, বাদবাকি ৩১ ইনিংসের মাঝে ক্যাচ আউট হয়েছেন ১৯ বার। ক্যাচ আউটের সংখ্যা থেকে ঠিক বোঝা না গেলেও কট বিহাইন্ড কিংবা স্লিপে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার সংখ্যা দেখে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত উইকেটকিপার, স্লিপে কিংবা গালিতে দাঁড়ানো ফিল্ডারকে ১৫ বার ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন তিনি। উইকেটের পেছনে কিংবা বোল্ড-এলবিডব্লিউ হয়ে এতবার আউট হওয়ার মানে তো একটাই, যে নিরেট দেয়ালের মতো রক্ষণ আশা করা হয় নাম্বার থ্রি’র কাছ থেকে, শান্ত সেটা নন।
তো সমস্যাটা হচ্ছে কোথায়? একটু টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসে ঢোকা যাক। মিডল-স্টাম্পে গার্ড নেওয়া শান্ত উইকেটে দাঁড়ান প্রায় ওপেন চেস্টেড স্ট্যান্স নিয়ে, ভেতরে ঢোকা কিংবা পায়ের ওপরের বলগুলো লেগে ঘোরাতে সুবিধা হওয়ার কথা এ কারণে। তবে এই স্ট্যান্সটাই তাকে অরক্ষিত করে দেয় বেরিয়ে যাওয়া বলগুলোতে।
ডেলিভারির আগে থেকেই হিপ আর চেস্ট ওপেন থাকলে কী হয়, সেই পরিণতির প্রমাণ বিরাট কোহলিই সবচেয়ে ভালো পেয়েছিলেন। ২০১৪ ইংল্যান্ড সফরে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, পায়ের অবস্থানের কারণে নিজেকে ‘সাইড অন’ রাখতে পারেননি, বলের ‘ফিল’ পেতে ছুটে যাচ্ছিলেন চ্যানেলের বলগুলো তাড়া করতে। ফলাফল, ওই ডেলিভারিগুলোতে খোঁচা দিয়ে ফিরতে হচ্ছিল প্যাভিলিয়নে। শান্তও যে বলকে খোঁচা দিতে চাইছেন কিংবা আউটসাইড এজের শিকার হচ্ছেন, তার কারণটাও একই।
সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এসে দেখা গেল এতদিন বেরিয়ে যাওয়া বল ঝামেলা করে থাকলে এবার হন্তারক হয়েছে ভেতরে ঢোকা বল। নিচের ছবিটাতে দেখতে পাওয়ার কথা, ব্যাকলিফট যখন শেষ হচ্ছে, শান্তর হাতটা চলে যাচ্ছে প্রায় পঞ্চম স্টাম্পে। হাত দূরে সরে যায় বলে ব্যাট-প্যাডের মাঝে রয়ে যায় বিরাট ফাঁক, সেই ফাঁকের কারণেই হয়েছেন বোল্ড।
কেন আউটসাইড এজের শিকার হচ্ছেন বেশি বেশি, তারও একটা ব্যাখ্যা মেলে এতে। ‘নিজের অফ স্টাম্পের খেয়াল রাখো’, কোচদের বহুল ব্যবহৃত এই উপদেশটা মেনে চলতেই পারছেন না হাত দূরে সরে যায় বলে। যে বলগুলো তাই নিশ্চিন্ত মনে ছেড়ে দেওয়ার কথা, সেই বেরিয়ে যাওয়া বলগুলোও খুঁচিয়ে শান্ত ক্যাচ দিচ্ছেন পেছনে।
ট্রিগার মুভমেন্টের পরে শরীরের ভর পেছনের পায়ে রাখতে চান বলে শর্ট বলের বিপক্ষে সপাটে পুল-হুক করার কথা তার। তবে সেখানটায়ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন নিজেই। ফরোয়ার্ড প্রেসের পরে শরীরের ওপরের অংশটা খোলা থাকলেও নিচের অংশটা ‘লক’ করে দিচ্ছে তাকে। পুল করতে চাইলে শরীরকে ঠিকঠাক তাই ঘোরাতেও পারছেন না তিনি।
ফরোয়ার্ড প্রেসের পরে এই তালাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যাটা ভারতের ঋষভ পন্তেরও হতো। তবে দারুণ ফাস্ট হ্যান্ডের কারণে সেটাকে সামলে নিয়েছেন তিনি। উইকেটে যদিও ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গিয়েছেন অনেকবার, তবে চার-ছক্কা ঠিকই হাঁকিয়েছেন। কিন্তু শান্তর সেই চাবুক চালানো হাত নেই। গায়ের বলগুলো থেকে বাঁচতে চাওয়াটাকেই প্রাধান্য দেন সর্বাগ্রে, আর পুল করতে গেলেও ওই আটকে যাওয়ার ব্যাপারটা তো থাকছেই, সবশেষ নিউ জিল্যান্ড সিরিজেই যে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
‘পিক দ্য বল আর্লি, প্লে ইট লেট’ তরিকাটাও মানতে পারছেন না শান্ত। বলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন শক্ত হাত (হার্ড হ্যান্ডস) নিয়ে। ব্যাটের কানা নেওয়া বলগুলো যে স্লিপ অব্দি যাচ্ছে কিংবা তার একমাত্র দেড় শ রানের ইনিংসটা যে শেষ হলো কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে, সেটাও এই অনমনীয় হাতের কারণেই।
ব্যাকরণ জিনিসটাই এমন যে, শতভাগ নিখুঁত টেকনিক আয়ত্ত করা অসম্ভব সবার জন্যই। হার্ড হ্যান্ডস নিয়ে বিরাট কোহলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করে গেলেন এক দশক, স্টিভেন স্মিথ অদ্ভুত এক স্ট্যান্স নিয়েও চলেন গেলেন ব্র্যাডম্যানের সবচেয়ে কাছে। টেকনিক নিয়ে যত কথাই তাই কপচানো হোক, দিনের শেষে রান পাওয়াটাই সমাপ্তিরেখা। শান্তর টেকনিক নিয়েও যে এত কথা, তার পেছনে ওই রান না পাওয়াটাই কারণ।
একবার রান পেতে শুরু করলে এখন পর্যন্ত বলা সব কথাই উড়ে যেতে শুরু করবে কর্পুরের মতো, সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকেরাও। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, এতদিন ধরে বিনিয়োগের পরে তার ওপরে আরও ভরসা রাখতে চাইছেন খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ, মৌসুমটা তার ফুরিয়েই আসছে।
ফুল হয়ে ফোটার শেষ সুযোগটা শান্ত সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই পাচ্ছেন।