সকল প্রযুক্তির উন্নতির রেখচিত্রে একটি পর্যায় আসে যেখানে তাকে হার মানতে হয়। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে তাকে মানিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয় না আর। এমনটি হয়েছিল ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের জয়জয়কার। রেডিও, কম্পিউটারসহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে সুইচ ও অ্যামপ্লিফায়ার ডিভাইস হিসেবে তখন ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ব্যবহার করা হতো।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ভেসে উঠে- উচ্চ মূল্য, স্বল্প মেয়াদ, সহজেই ভেঙ্গে যাওয়ার প্রবণতা ছাড়াও এটি ছিল আকারে বড় এবং এর জন্য শক্তিও খরচ হতো বেশি। বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়নের যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা তাতে এটি বেশ বড়সড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। দৈত্যাকার ইনিয়াক কম্পিউটারটি তৈরির পর ভ্যাকুয়াম ট্রায়োডের এ দুর্বলতা স্পষ্টভাবে নজরে আসে সবার। এ সময় প্রয়োজন পড়ে ভ্যাকুয়াম ট্রায়োডের বদলে সম্পূর্ণ নতুন একটি ডিভাইসের যেটি আরো দক্ষভাবে সুইচিং ও অ্যামপ্লিফিকেশনের কাজ সামলাতে পারবে।
সে অনন্য ডিভাইসটিকে আমরা আজকে ট্রানজিস্টর হিসেবে জানি। এ ডিভাইসের কল্যাণে ইলেকট্রনিক্স পদার্পণ করেছিল আধুনিক যুগে। ইলেকট্রনিক্স জগতে এ বিপ্লবের জন্ম হয়েছিল নিউজার্সির এক কোনে, বেল ল্যাবরেটরিজ নামক তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গবেষণাগারে।
বেল ল্যাবরেটরিজ
১৯০৭ সালের দিকে আমেরিকান টেলিফোন এন্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানি AT&T তে ফিরে আসেন থিওডোর ভেইল। এর বিশ বছর আগে AT&T’র কর্তাদের সাথে মতপার্থক্য হওয়ায় তিনি এখানের জেনারেল ম্যানেজারের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি সেসময় বোর্ডকে বোঝাতে পারেননি যে, স্বল্প মেয়াদে অধিক লাভের চেয়ে তাদের সেবার মান উন্নত করে দীর্ঘমেয়াদী লাভের দিকে নজর দেয়া উচিত।
বিশ বছর পরে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয় AT&T’তে। সেখানে ফিরে এসে তিনি বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেন। তার লক্ষ্য ছিল AT&T’কে যোগাযোগ খাতে সবচেয়ে সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। এজন্য তিনি এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন AT&T’কে যেন আর কখনো বাইরের কোনো উদ্ভাবক বা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানের পেটেন্ট ব্যবহার করতে না হয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল কোম্পানির গবেষণা খাতকে উন্নত করে তোলা।
এ কারণে তিনি তাদের যন্ত্রপাতি তৈরি করার প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিকের সাথে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেকটা টমাস আলভা এডিসনের বিখ্যাত গবেষণাগারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এর প্রথম ঠাঁই হয় নিউইয়র্কে। ভেইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সকল ক্ষেত্র থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল মেধাবীদের নিয়োগ দেন তার গবেষণাগারে। প্রথম থেকেই পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, গণিত থেকে শুরু করে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন সায়েন্স, নেটওয়ার্ক সিস্টেম সহ বিশাল পরিসরের গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
অনেকেই তখন AT&T’র মতো একটি কোম্পানির গবেষণাগারে এতসব বিচ্ছিন্ন বিষয়ে এত বিস্তর সব গবেষণা-প্রকল্প হাতে নেওয়ার মাহাত্ম্য বুঝতে পারেননি। কিন্তু টেড ভেইল তার অসামান্য দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এসব প্রকল্পের সমন্বয় করতে পেরেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এ বিচ্ছিন্ন সব প্রকল্প ছিল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা। তা হলো AT&T’কে যোগাযোগ প্রযুক্তিতে মূখ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।
প্রথম থেকেই এ প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়। এর বিভিন্ন ব্যবসাখাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর উন্নতি করে কোম্পানির জন্য নিজেদের আবশ্যকতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। ১৯২৫ সালের দিকে এসে এর নাম ‘ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট’ থেকে বদলে ‘বেল ল্যাবরেটরিজ’ রাখা হয়। ততদিনে এর সফলতার পাশাপাশি পরিসরও বেড়েছে অনেক। আগের জায়গায় স্থান সংকুলান হচ্ছিল না আর। সেজন্য নিউইয়র্ক থেকে সরিয়ে নিউজার্সিতে নিয়ে আসা হয়। এখানেই এর বর্তমান অবস্থান।
একটি গবেষণাগারের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের স্থিতিশীলতা। সে সময় বেল ল্যাবসের তহবিলের ব্যবস্থাপনাও ছিল অনন্য। AT&T তখন টেলিফোন খাতে সরকারি অনুমোদনে একচেটিয়া বাণিজ্য করতো। সেজন্য সরকারি একটি কমিশন এর ব্যয় হিসেব করে একটি নির্দিষ্ট লাভ রেখে টেলিফোন বিলের দর ঠিক করে দিতো। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল তখন পরিচালনার ব্যয়ের হিসাবের মধ্যে এক করে ধরা হতো।
তাছাড়া AT&T’র মতো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ব্যবসায়িক ব্যয়ের তুলনায় বেল ল্যাবসের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র অংশ। এ কারণে বেল ল্যাবসের তহবিলে তেমন কোনো প্রভাব পড়তো না। তাই বেল ল্যাবস বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যবসায়িক দিক থেকে অনিশ্চিত প্রকল্প পরিচালনা করার ঝুঁকি নিতে পারতো। বেল ল্যাবসের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল, এর গবেষণা প্রকল্পগুলো ছিল বাজারের চাহিদার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। তাই অন্যান্য গবেষণা সংস্থার তুলনায় বেল ল্যাবসের অধিকাংশ গবেষণার ফলাফলকে সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়গুলো মেধাবী প্রযুক্তিবিদদের কাছে বেল ল্যাবসকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কে চাইবে না, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গবেষণাগারে কাজ করতে যার তহবিল স্থিতিশীল এবং যেখানে কাজ করলে সরাসরি সমাজে প্রভাব ফেলার সুযোগ সবচেয়ে বেশি?
ট্রানজিস্টরের খোঁজ শুরুর কথা
ইলেকট্রনিক্স জগতের বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয় মারভিন কেলির হাত ধরে। ১৯৩৬ সালে বেল ল্যাবরেটরিজের ডিরেক্টর অব রিসার্চ হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯১৮ সালে নিজের পিএইচ.ডি শেষ করেই কেলি বেল ল্যাবসে যোগ দিয়েছিলেন। আঠারো বছরের ক্যারিয়ারে ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন তিনি।
প্রথম দিকে লী ডি ফরেস্টের উদ্ভাবিত ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ডিভাইসটির তেমন একটা ব্যবহার খুঁজে পায়নি কেউ। AT&T কর্তৃপক্ষ এর পেটেন্ট কেনার পর থেকেই বেল ল্যাবের গবেষকদল এটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করেন। ১৯১১ সালে এসে তারা দীর্ঘ দূরত্বের টেলিফোনের সমস্যা দূর করার জন্য ট্রায়োডকে সফলভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হন। পরবর্তী সময় ধরে প্রতিনিয়ত ট্রায়োড-প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য গবেষণা চালিয়ে যান তারা। একটি ছোট তথ্য দিলেই বোঝা যাবে এ উন্নতি কেমন ছিল- এ সময়ে তারা ট্রায়োডের মেয়াদকাল ৮০০ ঘণ্টা থেকে ৮০ হাজার ঘণ্টায় উন্নীত করেন।
কিন্তু চল্লিশের দশকে এসে টের পাওয়া যায়, ট্রায়োড প্রযুক্তির উন্নতি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। কেলির চেয়ে ট্রায়োড সম্পর্কে ভালো আর খুব কম মানুষই জানতেন। তিনি স্পষ্ট টের পেয়েছিলেন যে, AT&T’কে যদি ভবিষ্যতেও যোগাযোগ খাতের হাল ধরে রাখতে হয়, তবে ট্রায়োডের বিকল্প খোঁজার সময় চলে এসেছে। কিন্তু ভ্যাকুয়াম ট্রায়োডের বিকল্প কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর সবারই অজানা ছিল। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মারভিন কেলির মাথায় একটি সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। আরো ছয় দশক পূর্বে জার্মান উদ্ভাবক কার্ল ফ্রেডরিক ব্রাউনের একটি উদ্ভাবনের কথা মনে পড়েছিল কেলির।
ব্রাউন ১৮৭৪ সালে দেখিয়েছিলেন গ্যালেনা পদার্থ দিয়ে রেকটিফায়িং ক্ষমতা সম্পন্ন ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব, যা অনেকটা ভ্যাকুয়াম ডায়োডের মতো কাজ করে। ভ্যাকুয়াম ডায়োডের সাথে অতিরিক্ত একটি পা জুড়ে দিয়ে ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। দুটির মধ্যে মিল দেখে কেলির মনে উদয় হলো, তবে কি ব্রাউনের গ্যালেনা ডিভাইস থেকে কোনোভাবে নতুন ধরনের ট্রায়োড তৈরি করা সম্ভব হবে? কেলির অনুমান বলেছে সম্ভব হবে। কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন এর জন্য বিশাল পরিমাণ প্রযুক্তিগত বাঁধার মুখোমুখি হতে হবে, ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে বিস্তর।
তবে কেলি জানতেন সফল হবার জন্য তাকে কীভাবে এগোতে হবে। তার পরিকল্পনা ছিল সরল- স্পষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রথম সারির প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে একটি দল গঠন করতে হবে, শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক তহবিলের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এরপর সমাধান খুঁজে বের করা সেই দলের কাজ। কেলি এও জানতেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক ক্ষেত্রে তখনো পদার্থবিজ্ঞান ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের আরো অগ্রগতি দরকার।
এর জন্য কেলি দ্রুতই তার দল গঠন শুরু করে দিয়েছিলেন। এম.আই.টি থেকে নিয়ে এসেছিলেন তরুণ পদার্থবিদ উইলিয়াম শকলিকে। শকলি সেখানে এসে খুঁজে পান বেল ল্যাবের জ্যোষ্ঠ গবেষক ওয়াল্টার ব্র্যাটেইনকে। আরো পরে আমেরিকান নৌবাহিনী থেকে এসে যুক্ত হন জন বারডিন। এ তিনজনের দলটিই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিল।
অবশ্য শুধু এ তিনজনের কথা বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অ্যালান.এইচ.উইলসন, ওয়াল্টার শটকিসহ অনেক গবেষকদের সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কিত কাজ এ উদ্ভাবনের যাত্রাপথে রসদ হিসেবে কাজ করেছে। ট্রানজিস্টর উদ্ভাবনের ইতিহাসে কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কাহিনীই নয়, রয়েছে ইগো, দ্বন্ধ ও ঈর্ষাপ্রসূত বিভিন্ন নাটকীয় গল্পও। সে গল্প বলা হবে পরবর্তীতে কোনো একসময়।