চালকবিহীন গাড়ি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি পণ্য, যেটি বিজ্ঞানীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ইলেকট্রনিক বিজ্ঞানী, পরিবহন বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে তাদের নিজস্ব বিষয়ে গবেষণা করছেন। জনপ্রিয়তার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ মানুষের ভুল। যেহেতু সারা পৃথিবীতে মানুষ রাস্তায় গাড়ি চালায়, সেহেতু মানুষেরই ভুলের কারণে অথবা ঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের জন্যই দায়ী হলো মানুষ। কিন্তু চালকবিহীন গাড়ি কখনো ক্লান্ত হবে না, রেগে যাবে না, মাতলামি করার সুযোগও এদের নেই। অর্থাৎ আবেগ না থাকার কারণে এদের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। দিনের পর দিন প্রযুক্তির বিকাশ, জটিল গণিত, নতুন নতুন এলগরিদম, প্রচুর তথ্য বিশ্লেষণী ক্ষমতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির উন্নতির কারণে বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের ধারণা যে, মানুষের আচরণ বা স্বভাবজনিত কারণে এবং তাদের নিজেদের ভুলের কারণে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলো স্বয়ংক্রিয় গাড়ির মাধ্যমে অনেকাংশে কমানো যাবে।
বর্তমানে এই বিষয় নিয়ে যে গবেষণা করা হচ্ছে, তা মূলত চালকবিহীন গাড়ির দুর্ঘটনার সম্ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, চালকবিহীন গাড়ির সংঘর্ষের সম্ভাবনা কীরকম, চালকবিহীন গাড়ি কীভাবে নিজের জন্য পথ তৈরি করবে, কত দ্রুত এরা সামনে আসা কোনো প্রতিবন্ধকতা বুঝতে পারবে এবং সেটি এড়িয়ে যেতে পারবে, এই গাড়িগুলো রাস্তায় চলার সময় কীভাবে লেন পরিবর্তন করবে, কীভাবে রাস্তার মানুষ কিংবা সামনে-পেছনের গাড়ির অবস্থান বুঝতে পারবে, রাস্তায় চলাচলের সময় আশেপাশের পরিবেশকে কত দ্রুত সনাক্ত করতে পারবে, কোনো দুর্ঘটনা হবে কি হবে না সেটি কত দ্রুত বুঝতে পারবে- এসব বিষয় নিয়েই গবেষণা হচ্ছে। তাছাড়া এরকম গাড়ি চালানোর জন্য বুদ্ধিমান রাস্তা চাই, বুদ্ধিমান অবকাঠামোও চাই; যাদের সাথে চালকবিহীন গাড়ি যোগাযোগ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে পারে।
মানুষ-মেশিন সমন্বয় নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের ধারণা একটু ভিন্নরকম। তাদের মতামত এমন যে, এই গাড়িগুলো সংঘর্ষ করবে কি করবে না শুধু সেটি নিয়ে গবেষণা করলে হবে না। এই গবেষণার পাশাপাশি গাড়িগুলোর সংঘর্ষে লিপ্ত না হওয়ার ব্যাপারটিও দেখতে হবে। আরেকটু পরিস্কার করে বলি। মানুষের মন এমনভাবে কাজ করে যে, খুব সহজেই আমরা যেটি ঘটছে সেটি মনে রাখি, কিন্তু যেটি ঘটছে না সেটি মনে রাখতে পারি না বা ভুলে যাই। মানুষ ভুল করছে সে কারণে সড়কে গাড়ি দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ আমরা মানুষের ভুল করা নিয়েই গবেষণা করছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, দুর্ঘটনা ঘটার আগে অনেকটা সময় কিন্তু মানুষ ভুল না করেও গাড়ি চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাই কোটি কোটি মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থার সেবা নিচ্ছে। সুতরাং কিছু গবেষণা করতে হবে এই বিষয়ে যে, কোন কোন মুহূর্তে এবং কোন পরিবেশে মানুষ ভুল না করে গাড়ি চালাতে পারে। অর্থাৎ, চালকবিহীন গাড়ি কার্যকর করার আগে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
বিশ্বে বেশ কিছু উন্নত দেশ চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের ইচ্ছা হলো গাড়িগুলোকে রাস্তায় পুরোপুরি নামানো। গুগল, উবার, টেসলা, ওয়েম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান টেস্ট রান হিসেবে তাদের তৈরি চালকবিহীন গাড়িগুলোকে রাস্তায় নামিয়েছে। টেস্ট রানে মোটামুটি সফলতা লাভ করার পর ফলাফল দেখে এবং তথ্য-উপাত্ত দেখে সবার মনে আশা জেগেছে যে, চালকবিহীন গাড়িই হচ্ছে ভবিষ্যৎ।
কিন্তু আরও একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর সময় বেশিরভাগ গাড়ি চলেছে যখন আবহাওয়া ভাল ছিল তখন। এগুলো যে রাস্তায় চলেছে, সেই রাস্তায় অন্যান্য গাড়ির প্রবাহ এক দিকে ছিল এবং রাস্তাগুলো অনেকগুলো লেনে বিভক্ত ছিল।
রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, কিছুক্ষণ পরে কী ঘটবে সেটি আগেভাগে বোঝা খুব কঠিন। তাই চালকবিহীন গাড়ি যখন রাস্তায় চলবে, তখন তাকে সব ধরনের পরিবেশে মানিয়ে নিতে হবে এবং ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন রকম আচরণ করা শিখতে হবে। ডাটা মাইনিং, মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যুগে যন্ত্রকে প্রশিক্ষণ দেওয়া খুব বেশি কঠিন নয়। তবে আশেপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নতুন নতুন এলগরিদম তৈরি করতে হয়, যার উপর ভিত্তি করে একটি যন্ত্র কাজ করে। সুতরাং চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে কোনো উপসংহারে আসার আগে আমাদেরকে এই বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখতে হবে।
অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করছেন, চালকবিহীন গাড়ি এবং মানুষ- দুই পক্ষকেই এক সাথে কাজ করতে হবে। কারণ, একটি যন্ত্র কখনো মানুষের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। দুর্ঘটনা ঘটার আগে দিয়ে মিলি সেকেন্ডের মধ্যে পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়। আবার দুর্ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ আগে এমন একটি কিছু সামনে আসতে পারে যেটি এড়ানো যাবে না, আবার সেটির ভিতর দিয়েও যাওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, একটি যন্ত্র সেভাবে পারবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। এমনও হয়েছে, পরিস্থিতির সাপেক্ষে চালক বাকি সব যাত্রীর জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে দেয়। এরকম আবেগ কিংবা অনুভূতি কি চালকবিহীন গাড়িকে দেওয়া যাবে?
অনেকে তর্ক করতে পারেন যে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু মিছিল কমানোর জন্যই চালকবিহীন গাড়ির দরকার। এটি অবশ্যই অত্যন্ত যৌক্তিক কথা এবং চালকবিহীন গাড়ি যদি রাস্তায় নামানো হয় তাহলে অবশ্যই কল্যাণ বয়ে আনবে। কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে অনেক সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে এই গাড়িগুলোকে মানুষচালিত গাড়ির সংস্পর্শে এনে তাদেরকে বিভিন্ন পরিবেশে সাথে খাপ খাওয়াতে হবে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করে ফলাফল পর্যালোচনা করতে হবে যে, কতটুকু সফলতা লাভ করা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এবং সমাজ কীভাবে এই গাড়িগুলোকে নেবে, সেটিও একটি গবেষণার বিষয়। এছাড়া গাড়ির দাম, চালকদের বেকার হয়ে পড়া, গাড়িগুলোর নিরাপত্তা এবং আরও কিছু আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না করলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুলও হতে পারে।
চালকবিহীন গাড়ি সব ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে, সেটি বলা যাবে না। কারণ, বেশ কিছু দুর্ঘটনা এবং সংঘর্ষ বুঝতে না পারার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এরকম ঘটনা প্রথম প্রথম যেকোনো নতুন কিছু বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেই হয়। দিন দিন এই বিষয়ে নিয়ে যেভাবে গবেষণা এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে নিখুঁত একটি চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। প্রকৌশলের মধ্যে পরিবহন বিজ্ঞান এমন একটি শাখা, যা শুধুমাত্র একটি বিষয় দিয়ে ব্যাখ্যা করলে ফলাফল পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখা এবং তাদের তত্ত্ব ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এখানে কাজ করতে হয়। তাই সবদিক বিবেচনা করে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রযুক্তি ভালো, কিন্তু এর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
ফিচার ইমেজ: wired.com