আপনি যে ডিভাইসটি দিয়ে এই লেখাটি পড়ছেন সেটি স্মার্টফোন হোক কিংবা কম্পিউটার হোক তাকে সচল রাখার মূলে রয়েছে চিপ। কোটি কোটি ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে এই চিপগুলো। প্রতি বছরই আমরা আগের বছরের চেয়ে দ্রুত গতির ও ভালো পারফরম্যান্সের ডিভাইস পাচ্ছি। আইফোনের বায়োনিক না কোয়ালকমের স্ন্যাপপড্রাগন, ইন্টেল না এএমডির প্রসেসর, এনভিডিয়ার নতুন গ্রাফিক্স কতো ফাস্ট এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউবে আলোচনা-সমালোচনা বিচার-বিশ্লেষণ লেগেই থাকে।
এসব তৈরির মূলে রয়েছে ট্রানজিস্টর। অ্যাপলের সর্বশেষ মোবাইল চিপ A13 বায়োনিকে রয়েছে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ট্রানজিস্টর। এই ছোট একটি চিপে এতো ট্রানজিস্টর কীভাবে আছে? পাশাপাশি দুটি ট্রানজিস্টরে যদি বিবাদ তৈরি হয় কী হবে? চলুন জেনে আসি।
ট্রানজিস্টর ও প্রসেস নোড
মুরের ল নিয়ে কথা বলার আগে এই দুটি বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার করা যাক। ট্রানজিস্টর হচ্ছে একটি বৈদ্যুতিক কম্পোনেন্ট যেটি বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। একটি প্রসেসর বা চিপ তৈরি করা হয় ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে। এগুলো তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে সংকেত আদান-প্রদান করে এবং আমাদের নির্দেশনা সম্পন্ন করে। একটি চিপ মেশিন ভাষায় চলে। প্রচলিত মেশিন ভাষা হলো বাইনারি বা ০ ও ১। অর্থাৎ যাবতীয় কাজ ০ এবং ১ দ্বারা সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি ট্রানজিস্টর একটি মান নিয়ে চলে। ০ অর্থাৎ কোনো তড়িৎ প্রবাহ হবে না, ১ অর্থাৎ তড়িৎ প্রবাহ হবে। এছাড়া একটি চিপ ডিজাইনে আনুসাংগিক অনেক বিষয় থাকে যেগুলো এদের প্রত্যেকটি থেকে নিজেদের আলাদা করে। এখন আসি প্রসেস নোডের ব্যাপারে।
ফটোলিথোগ্রাফি নামক একধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রসেসর তৈরি করা হয়। যেখানে প্রসেসরের আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের একটি ছবি সিলিকনের মাঝে প্রিন্ট করা হয়। যে পদ্ধতিতে এটি করা হয় একে বলে প্রসেস নোড এবং নির্মাতারা কত ছোট ট্রানজিস্টর তৈরি করতে পারে তার উপর প্রসেস নোডের মান নির্ভর করে।
মূলত প্রসেস নোডের মান বোঝায় একটি ট্রানজিস্টর থেকে অপর একটি ট্রানজিস্টরের দূরত্ব। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র প্রসেস নোডের সুবিধা হচ্ছে এগুলো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যার ফলে অতিরিক্ত গরম না হয়েই এটি বেশি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং ক্ষুদ্র হওয়ায় একই পরিমাণ জায়গায় অনেক বেশি ট্রানজিস্টর রাখা যায় যার ফলে পারফরম্যান্স অনেক বেশি বেড়ে যায়। যেমন, এএমডির নতুন তৃতীয় প্রজম্নের রাইজেন প্রসেসরগুলো ৭ ন্যানোমিটার প্রজেক্ট নোডে বানানো এবং সমপরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহে ইন্টেলের ১৪ ন্যানোমিটারের চেয়ে বেশি পারফরম্যান্স এবং কম উত্তাপ তৈরি করে।
যদিও একটি প্রসেসরের পারফরম্যান্স শুধু প্রসেস নোডের উপর নির্ভর করে না কিন্তু এটি একটি বড় বিষয়। এছাড়া নোড ডিজাইনও আলাদা হতে পারে। যেমন TSMC-র ৭ ন্যানোমিটার এবং আসন্ন ইন্টেলের ১০ ন্যানোমিটার বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। কিন্তু যখন প্রসেস নোড কমতে কমতে শুন্যের কাছাকাছি যাবে তখন কী হবে?
মুরের সূত্র
১৯৬৫ সালে ইন্টেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা গরডোন মুর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বলেন, কোনো চিপের কম্পিউট করার ক্ষমতা প্রায় দুই বছর অন্তর অন্তর দ্বিগুণ হবে। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী তার ধারাবাহিকতা কমবেশি বজায় রেখে চলছে এবং এই ধারাবাহিকতার সাফল্যের জন্য ‘মুরের সূত্র’ মোটামুটি সূত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আসলে প্রতিনিয়ত আমাদের প্রযুক্তি এত ক্ষমতাধর আর স্বল্পমূল্যের হয়ে উঠছে যে আমরা মাঝেমধ্যে এর অভিনবতার কথা ভুলে যাই। অটোমোবাইল কিংবা এরোপ্লেনের প্রযুক্তি নিয়ে ভাবি? আজ কতদূর এগিয়েছে তারা? আর কতদুর এগোতে পারবে? বা কী হবে যখন প্রযুক্তি তার শেষ সীমায় যাবে পৌঁছে?
চিপ প্রযুক্তি যে তার শীর্ষে এসে পৌঁছেছে তা পরিষ্কার। ২০০০ সালের পর থেকেই মুরের ল এর ধারাবাহিকতা সামান্য কমতে থাকে। প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর ইন্টেল ৪০০৪ এ ২৩০০ টি ট্রানজিস্টর ছিল। খালি চোখে দেখাও যেত। প্রতিটি ট্রানজিস্টর ছিল ১০ মাইক্রন সাইজের। বর্তমানে গড়ে একটি প্রসেসর ১৪ ন্যানোমিটারের। আর প্রতি বর্গমিলিমিটারে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ট্রানজিস্টর থাকে এখন। ৭ ন্যানোমিটারের ট্রানজিস্টর বাজারে এসে সাড়া ফেলে দিয়েছে। সামনের বছরে হয়তো ৫ ন্যানোমিটারও উন্মোচন করা হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা ১ এর কোঠায় পৌঁছে যাচ্ছি। এরপর? তার আগেই হয়তো আমরা বুঝে যাব যে আমাদের আর আগানো সম্ভব হচ্ছে না। যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতায় পড়ে যাবো আমরা।
ইলেকট্রনের প্রবাহের ফলেই বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুতের প্রবাহেই কাজ করে ট্রানজিস্টর। কিন্তু এদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যত এরা একে অপরের কাছাকাছি যাচ্ছে ততই অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিটি প্রসেসরের কাজ করার একটি তাপগত সীমা থাকে। বরাবর এটি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে।
বর্তমানে প্রসেসর ওভারক্লক শব্দটির সাথে অনেকে পরিচিত। ওভারক্লক হচ্ছে কোনো প্রসেসরকে যখন তার নির্ধারিত ক্ষমতারও বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধীরে ধীরে প্রসেসর কোর ভোল্টেজ বাড়িয়ে বাড়িয়ে এটি করা হয়। অতিরিক্ত বাড়ানো হলে প্রসেসর পুড়ে যেতে পারে। এইসব ধকল যায় ট্রানজিস্টরের উপর দিয়ে। তখনই একটি প্রসেসর পুড়ে যায় যখন একটি ট্রানজিস্টরের সাথে আরেকটার সংঘর্ষ লাগে। এই কাজে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা উন্নতমানের কুলার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এজন্য ওভারক্লকিংয়ের জন্য একটি ট্রানজিস্টর থেকে আরেকটি যত দূরে থাকবে তত ভালো। কিন্তু বর্তমানে তেমন ওভাক্লকিং পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্রানুযায়ী এ সময়ে আমাদের ৭ গিগাহার্টজে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা ৫ এর আশপাশে কেবল। নতুন ৭ ন্যানোমিটারের এএমডির প্রসেসরগুলোতে তেমন ওভারক্লক করা যায় না। এর কারণ নির্মাতারা একটি প্রসেসরের সর্বোচ্চ ক্যাপাবিলিটি দিয়েই বাজারে ছাড়ছে। প্রসেস নোড আরও কমলে ওভারক্লকিং নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মুরের ল এর যে মৃত্যু ঘটেছে তা নিশ্চিত। এখন আমাদের অন্য ব্যবস্থা খুজে বের করতে হবে। ১ ন্যানোমিটারের পরের ধারণা হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। কিন্তু তা হিমাঙ্কেরও নিচে কাজ করে ফলে ভোক্তা ব্যবহারে উপযোগী নয়। তবে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে যেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে গ্রহণ করা হবে।
নতুন আর্কিটেকচার ডিজাইন ও অপটিমাইজেশন
প্রতিটি চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা প্রসেসর ডিজাইন আছে। প্রসেসর কীভাবে তার নির্দেশনা পালন করবে, ডিসিশন মেকিং সহ এমন বিভিন্ন বিষয় প্রত্যেক কোম্পানির প্রসেসর আলাদাভাবে মেইন্টেইন করে। অর্থাৎ সমান পরিমাণ ট্রানজিস্টর বিশিষ্ট একটি ইন্টেল এবং এএমডির চিপ ভিন্ন পারফরমেন্স দিতে পারে। এএমডির রাইজেন আসার আগে মাল্টিকোর নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। মাল্টিকোরের কনসেপ্ট হচ্ছে যদি আমি একটি কোর থেকে সর্বোচ্চ পারফরমেন্স পাই তাহলে আরও বেশি পারফরমেন্স পাওয়ার জন্য আরেকটি কোর যোগ করলেই হবে। কিন্তু সমস্যা হলো বর্তমানে যে হারে প্রসেসরে কোর বাড়ছে সে হারে পারফরমেন্স বাড়ছে না। এর কারণ সফটওয়্যার গুলো অতিরিক্ত এই কোরগুলো সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করার জন্য অপ্টিমাইজড না। যেমন বর্তমানে এএমডির সর্বোচ্চ ডেস্কটপ লাইনাপের প্রসেসর হচ্ছে থ্রেড্ররিপার ৩৯৯০এক্স। এতে রয়েছে ৬৪টি কোর। এ হিসেবে এটি থেকে তুলকালাম করা পারফরমেন্স পাওয়ার কথা। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি সফটওয়্যার ছাড়া এটি দিয়ে তেমন পারফরম্যান্স পাওয়া যায় না। এছাড়া বর্তমান ট্রিপল এ গেমগুলোর কোর অপ্টিমাইজেশন ৪ বা ৬ কোরের মাঝে সীমাবদ্ধ এবং গেমিংয়ে সিঙ্গেল কোর পারফরম্যান্স গুরুত্ব বহন করে। তো ভবিষ্যতে আমাদের প্রোগ্রাম এবং প্রসেসরগুলো আরও অপ্টিমাইজড হলে কোন পারফরম্যান্স অপচয় হবে না।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স
AI চিপ পারফরম্যান্সে একটি বড় ভুমিকা পালন করতে পারে। মেশিন লার্নিংয়ের প্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। প্রায় দশক ধরে AI ট্রেনিংয়ে গ্রাফিক্স কার্ড ইউজ করা হচ্ছে। কোনো প্রসেসর তৈরি করার সময় সেটি কীভাবে কাজ করবে এটি প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি তৈরির পর ব্যবহারভেদে একটি প্রসেসর নিজের কর্মক্ষেত্র নিজে তৈরি করে নিতে পারে তাহলে এটির কর্মক্ষমতা কয়েকগুনে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে NVIDIA-র DLSS (Deep Learning Super Sampling) প্রযুক্তি যা AI এর মাধ্যমে গেমিং পারফরম্যান্স বৃদ্ধি করে।
সিলিকনের প্রতিস্থাপন
আরেকটি বিকল্প চিন্তাধারা হচ্ছে চিপে সিলিকনের পরিবর্তে অন্য কোনো পদার্থ ব্যবহার করা। ইলেকট্রনের বদলে অন্য কোনো প্রবাহ দ্বারা চিপ নিয়ন্ত্রণ। এসব নতুন চিন্তা নয়। বিজ্ঞানীরা এগুলো নিয়ে আগে থেকেই গবেষণা করে আসছেন। ইলেক্ট্রনের বদলে ফোটনের ব্যবহার। সিলিকনের বদলে গ্রাফিন। ডিএনএ বা স্পিন্ট্রনিক ট্রানজিস্টর নিয়েও চলছে বিস্তর গবেষণা। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসতে আরও কয়েক দশক লাগতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার
কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের প্রযুক্তির জগতে এক অভূতপূর্ব সংযোজন। গুগল, মাইক্রোসফট তাদের কাজে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করেছে। কিন্তু এটি এখনো নবজাতকরূপে রয়েছে তাই এখনো এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ভোক্তাদের কাছে এমন কিছু পৌঁছাতে সময়ের প্রয়োজন।
পরিশেষে মুরের সূত্রের ইতির পর আমাদের ইলেক্ট্রন-সিলিকন জগত ছেড়ে যেতে হবে অন্য কোনো জগতে। ভালো সংবাদ এই যে আমাদের কাছে অপশন আছে ভালোই। ভবিষ্যৎ কম্পিউটিং প্রযুক্তি যে আরো চাঞ্চল্যকর হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।