অফিসিয়াল কাজে হোক কিংবা একাডেমিক- কাউকে আপনি একটি ফাইল মেইল করেছেন, তার প্রত্যুত্তরে তিনি হয়তো আপনাকে ‘ধন্যবাদ’ লিখে পাঠিয়েছেন। জেনে সম্ভবত অবাকই হবেন, ছোট্ট এই প্রাপ্তিস্বীকারই পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনার্জি রিটেইল কোম্পানি ‘ওভো এনার্জি’ দেশটিতে চালানো এক গবেষণায় দেখেছে, যুক্তরাজ্যের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি প্রতিদিন অন্তত একটি ধন্যবাদসূচক ই-মেইল কম পাঠান, তাহলে বছর-শেষে ১৬,৪৩৩ টন কার্বন সাশ্রয় করা সম্ভব। এই অপ্রয়োজনীয় ই-মেইল কার্বন ফুটপ্রিন্টে রাখছে বিশাল প্রভাব।
কার্বন ফুটপ্রিন্ট কী?
বাস্তুতান্ত্রিক পদক্ষেপের বহুল আলোচিত উপাদানটি হলো কার্বন ফুটপ্রিন্ট। এটি জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য উৎসের জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইডের শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, প্রক্রিয়া অথবা কর্মক্ষেত্রের পারিপার্শ্বিক পুরো সীমানায় সংশ্লিষ্ট সকল উৎস, সংগ্রাহক এবং ধারক বিবেচনায় নিঃসৃত কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেনের মোট পরিমাণকেই উক্ত অঞ্চলের কার্বন ফুটপ্রিন্ট বা কার্বন পদচিহ্ন বলা হয়।
কী বলছে গবেষণা?
গত বছরের (২০১৯) ২৬ নভেম্বর ই-মেইল বিষয়ক গবেষণার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ওভো এনার্জি। ১৬ বছরের উপরে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির উপর অভিজ্ঞ জরিপকারীদের দ্বারা এই গবেষণা চালানো হয় নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। গবেষণায় বলা হয়, যুক্তরাজ্যের ৭২ শতাংশ মানুষ ই-মেইলের ইনবক্সের সাথে কার্বন ফুটপ্রিন্টের যে সংযোগ আছে, সে সম্পর্কে অসেচতন। এ অসচেতনতার দরুন প্রতিদিন যে অপ্রয়োজনীয় ৬৪ মিলিয়ন ই-মেইল পাঠানো হয়, সেগুলো থেকে বছর শেষে ২৩,৪৭৫ টন কার্বন যোগ হচ্ছে দেশটির কার্বন ফুটপ্রিন্টে।
ই-মেইল বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজে ই-মেইল পাঠানোর চল শুরু হওয়ার পর থেকে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় ই-মেইলের সংখ্যাও। গবেষণার জরিপে অংশ নেয়া প্রায় অর্ধেক ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন, তারা তাদের অফিসের সহকর্মী বা বন্ধুকে কথা বলার দূরত্বে থেকেও অপ্রয়োজনীয় মেইল করে থাকেন। ওভো এমন দশটি শব্দের তালিকা করেছে, যেগুলো অপ্রয়োজনীয় মেইল হিসেবে সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয়ে থাকে। এই তালিকায় শীর্ষে আছে ‘Thank You‘।
ওভো বলছে, যুক্তরাজ্যের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি প্রতিদিন একটি করে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ই-মেইল কম পাঠান, তাহলে বছর-শেষে ১৬,৪৩৩ টন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব। এটি ঠিক কত বড় সাশ্রয়, সেটি বোঝাতে কোম্পানিটি দুটি বিষয়ের সাথে তুলনা দেখিয়েছে। ১৬,৪৩৩ টন কার্বন হচ্ছে মাদ্রিদের উদ্দেশে উড়ে যাওয়া ৮১,১৫২টি ফ্লাইট থেকে নিঃসরিত কার্বনের সম পরিমাণ! (লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে মাদ্রিদ বিমানবন্দরের দূরত্ব ১,২৫০ কিলোমিটার। একেকটি ফ্লাইটে কিলোমিটার প্রতি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরিত হয় গড়ে ০.১৬২ গ্রাম) অথবা এটি হতে পারে ডিজেল চালিত ৩,৩৩৪টি গাড়ি যদি রাস্তায় কম চলে, তার থেকে যে কার্বন সাশ্রয় হবে, তার সমান! ইংল্যান্ডে একটি ডিজেলচালিত গাড়ি বছরে গড়ে ৯,৪০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়। মাইলপ্রতি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ গড়ে ০.৫২৪৩ কিলোগ্রাম।
ব্রিটিশরা বরাবরই ভদ্র জাতি হিসেবে পরিচিত, এজন্য ধন্যবাদ সূচক মেইল পাঠানোতেও তাদের অবস্থান বেশ উপরে। তবে ওভো তাদের জরিপে দেখেছে, ৭১ শতাংশ ব্রিটিশই এ ধরনের ইমেইল পাঠানো থেকে বিরত থাকতে আপত্তি করবেন না, যদি তারা জানেন বা বুঝতে পারেন, এসব থেকে জলবায়ু সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।
ই-মেইল কীভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করে?
সাধারণত তিনভাবে অপ্রয়োজনীয় ই-মেইল ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে পরিবেশের জন্য।
প্রথমত, আমরা যে ছোট্ট মেসেজ সম্বলিত ই-মেইল পাঠিয়ে থাকি, সেটি পাঠাতে আমাদের যে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় যুক্ত থাকতে হয়, সেটির জন্য ইলেক্ট্রিসিটি বা বৈদ্যুতিক সংযোগের প্রয়োজন। অন্যের ফোন বা ল্যাপটপে যখন এই ই-মেইল প্রদর্শিত হয়, তখনও লাগে বিদ্যুৎ। ই-মেইল যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, তখন প্রত্যেকটি সার্ভার কিছু সময়ের জন্য ই-মেইলটি স্টোর বা জমা করে রাখে, যেখানেও ব্যয় হয় বিদ্যুৎশক্তি। এই বিদ্যুৎশক্তি সরাসরি ভূমিকা রাখে কার্বন নিঃসরণে। একটি ছোট্ট মেসেজ সম্বলিত ই-মেইলে অন্তত ৪ গ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরিত হয়।
দ্বিতীয়ত, মেসেজের পরিবর্তে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে আমরা যদি কোনো ইমেজ বা স্থিরচিত্র পাঠাই, সেক্ষেত্রে সার্ভারে সেটি জমা থাকতে স্বাভাবিকভাবেই বেশি জায়গা নেবে। সেই ছবি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যখন যাবে, তাতেও লাগবে সময়, ব্যয় হবে বেশি বিদ্যুৎ শক্তি। একেকটি ইমেজ তাই ৫০ গ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করতে পারে। স্প্যাম ইমেইল অবশ্য এর চেয়ে কম কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করে, প্রতিটিতে ০.৩ গ্রাম। কারণ এ ধরনের ইমেইলের বেশিরভাগই আমরা খুলে দেখি না, অনেক সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই ইমেইল মুছে যায়। তাই কার্বন নিঃসরণও হয় কম।
তৃতীয়ত, আপনি যদি ৬৫টি ই-মেইল পাঠান, সেটি হবে একটি ব্যক্তিগত গাড়ির এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার সমান। গড়ে একজন ব্যক্তি প্রতি বছর ই-মেইল পাঠিয়ে এবং রিসিভ করে কার্বন ফুটপ্রিন্টে ১৩৬ গ্রাম কার্বন যোগ করছেন। এটি একটি ব্যক্তিগত গাড়ির অতিরিক্ত ১৩৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার সমান। বিশ্বব্যাপী যত ই-মেইল পাঠানো হয়, সেটি অতিরিক্ত সাত মিলিয়ন ব্যক্তিগত নতুন গাড়ি রাস্তায় নামানোর সমান।
ইংল্যান্ডের ল্যানচ্যাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইক বার্নার্স লি ওভো এনার্জির এ গবেষণায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তার মতে,
কার্বন নিঃসরণ কমাতে আমরা যদি ছোট ছোট এই পদক্ষেপগুলোয় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার অভিযানে আমরাও শামিল হতে পারব।
মাইক ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’-এর জনক টিম বার্নার্স লি-র ভাই। তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি তবে তার ভাইকে দোষারোপ করবেন? তিনি একগাল হেসে উত্তর দিয়েছেন,
ওয়েবের মাধ্যমে তো ভালো ভালো কাজও করা যায়, যদি সেটি আমরা বুঝে-শুনে ব্যবহার করতে পারি।
ওভো এনার্জি এই গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে ‘Think Before you Thank‘ শিরোনামে একটি স্লোগান সকলের কাছে তুলে ধরেছে। তারা বলছে, কিছু ইমেইল পাঠানো থেকে বিরত থাকার মানে এই নয় যে, জলবায়ু সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তবে এর মাধ্যমে আমরা এ বিষয়টি বুঝতে পারি, জঞ্জাল কমিয়ে আমরা কার্বন হ্রাস করার সাথে সাথে আমরা আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করতে পারি।