তথ্যপ্রযুক্তির তীর্থভূমি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির কথা কম-বেশি আমরা সবাই জানি, যদিও ১৯৯৫ সালের আগে সিলিকন ভ্যালির প্রসিদ্ধি ছিল না। গুগল, ইয়াহু, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, টুইটার, ফেসবুক, উবার, অ্যামাজনের মতো হালের সব টেক-জায়ান্ট কোম্পানির জন্ম সিলিকন ভ্যালিতে।
ধারণা করা হয়, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় একদিন এ পৃথিবী পরিণত হবে কাগজবিহীন পৃথিবীতে। সেখানে কাগজের কোনো ব্যবহার থাকবে না। ব্যানার, ফেস্টুন, বই-খাতা, অফিসের কাগজপত্র, পত্রিকা, টাকার নোট ইত্যাদি বানানোর জন্য আর কোনো গাছ কাটতে হবে না। একজন সাধারণতম পেশার মানুষের সাথেও তখন লেনদেন হবে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে। প্রযুক্তির এমন উন্নয়নের ভালো দিক যেমন থাকবে, অনেক খারাপ দিকও তেমন থাকবে।
সেই সময় হয়তো মুখোমুখি যুদ্ধের চেয়ে সার্ভারের যুদ্ধ হয়ে উঠবে অধিক কার্যকরী। যে দেশ যত বেশি সুরক্ষিত সার্ভারের অধিকারী হবে ও অন্যের সার্ভার থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে পারবে, তারাই তত বেশি বিশ্ব-নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেবে। এসব বিষয় চিন্তা করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিকে টেক্কা দিতে চীন বানিয়েছে নিজেদের সিলিকন ভ্যালি জোংগুয়ানসুন। যে ভ্যালিতে রয়েছে গুগল, ইয়াহু, মাইক্রোসফট, আ্যপল, টুইটার, ফেসবুকের মতো টেক কোম্পানিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী সব কোম্পানি। গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন, ফেসবুকের মতো সোশাল নেটওয়ার্ক, আ্যমাজনের মতো ই-কমার্স সাইট তারা তৈরি করেছে। মার্কিন টেক-জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর চীনা প্রতিদ্বন্দ্বী অনলাইন জায়ান্ট নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
বাইদু বনাম গুগল
Baidu হলো চীনের গুগল। চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট এটি। বাইদু ২০০০ সালে Robin Li এবং Eric Xu এর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উভয়েই চীনা নাগরিক যারা চীনে ফিরে আসার আগে বিদেশে পড়ালেখা ও কাজ করে এসেছেন। এই অনলাইন জায়ান্টটির রয়েছে বিভিন্ন সার্ভিস। অডিও, ভিডিও, ইমেজ, সার্চ ইঞ্জিন, ম্যাপ টুলস, ক্লাউড স্টোরেজ, নিউজ, পোস্টবার, এমপি-থ্রি, বাইদু এনসাইক্লোপিডিয়া, ওয়েব ডিকশনারি, গেমস ইত্যাদি সার্ভিস ছাড়াও রয়েছে গুগলের মতো চালকবিহীন গাড়ির সার্ভিস। এর দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ মিলিয়ন আর মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৬০ মিলিয়ন। ২০১৬ এর ডিসেম্বরে বাইদু অ্যালেক্সার ইন্টারনেট র্যাংকিংয়ে চতুর্থ স্থান অধিকার করে। উল্লেখ্য, চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুগল বন্ধ।
উইচ্যাট বনাম ফেসবুক
চীনা ইন্টারনেট জুড়ে বিস্তৃত ইন্টারনেট কোম্পানির নাম হল Tencent। তারা এনেছে WeChat। চীনে উইচ্যাটের গুরুত্ব অন্য দেশের ফেসবুকের মতোই। বার্তা প্রেরণ এবং সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের জন্য উইচ্যাট সুপরিচিত। iMessage, Google News, Venmo ইত্যাদি সবগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী উইচ্যাটের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে।
এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সেবা- টেক্সট ম্যাসেজ, ভয়েস ম্যাসেজ, ওয়াকিটকি, ছবি শেয়ার ইত্যাদি ছাড়াও রয়েছে নিজস্ব পেমেন্ট মেথড ‘WeChat Payment’ সার্ভিস। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং, ইলেক্ট্রিসিটি বিল, ট্রাফিক ফাইন ইত্যাদি জমা দেওয়ার সার্ভিসও দিচ্ছে WeChat। প্রথমে এর নাম ছিল Weixin। কিন্তু এই নাম দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডিং মানাচ্ছিল না। ফলে ২০১২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে WeChat। ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মাত্র ৬ বছরে মধ্যে ৯৮৩ মিলিয়ন মাসিক ব্যবহারকারী নিয়ে বিশ্বের অন্যতম স্বতন্ত্র চ্যাটিং অ্যাপ হিসেবে মনোনীত হয়েছে উইচ্যাট। অনায়াসেই একে ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফেসবুক বন্ধ।
আলিবাবা বনাম অ্যামাজন
২০০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী আলিবাবা বিশ্বের বৃহত্তম ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানিগুলির মধ্যে অন্যতম। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা হিসেবে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ওয়ালমার্টকেও অতিক্রম করেছে আলিবাবা। ২০১৫ সাল থেকে এর অনলাইন বিক্রয় এবং মুনাফা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল খুচরা বিক্রেতা অর্থাৎ ওয়ালমার্ট, আমাজন এবং ই-বেকে অতিক্রম করেছে। বছরের পর বছর ধরে বহুগুণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এখন মিডিয়া ও বিনোদন শিল্পেও বিস্তৃত হচ্ছে আলিবাবা। এর প্ল্যাটফর্মে রয়েছে ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি মাসিক সক্রিয় মোবাইল ব্যবহারকারী। ‘Alipay’ পেমেন্ট অ্যাপের জন্য আলিবাবা ই-কমার্স বিশ্বে আরো অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত আলিবাবার উপরেই অন্যান্য ই-কমার্স সাইটগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিলে জ্যাক মা’র হাত ধরে। জ্যাক মা আলিবাবা নামটা নিয়েছিলেন বিখ্যাত গল্প ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ নামের গল্প থেকেই। আলিবাবা গ্রুপের রয়েছে Taobao.com যেটিকে বলা হয় ‘চাইনিজ ই-বে’।
ডিডি চুসিং বনাম উবার
Didi Chuxing কে বলা হয় চাইনিজ Uber। এটি হলো মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবার নেটওয়ার্ক। এ কোম্পানিটি চীনের ৪০০টি শহর জুড়ে ৪০০ মিলিয়নের বেশি ব্যবহারকারীর জন্য পরিবহন সেবা প্রদান করে থাকে। এর রয়েছে শোফার, বাস, টেস্ট ড্রাইভ, রেন্ট-এ-কার, এন্টারপ্রাইজ সলিউশন, মিনিবাস, বিলাসবহুল বাস এবং মোবাইল অ্যাপভিত্তিক সাইকেল শেয়ারিং নেটওয়ার্ক। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে Didi Chuxing এর সাথে Uber হাত মিলিয়েছে। ২০১২ সালের জুনে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। চ্যাং ওয়েই এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আট বছর আলিবাবাতে কাজ করেছিলেন ডিডি চুসিং শুরু করার আগে। শুরুতে এর নাম ছিল ডিডি ড্যাচি, পরে এর নাম হয়েছে ডিডি কুয়াইডি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে Didi Chuxing নামে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হয়।
সিনা উইবো বনাম টুইটার
Sina weibo হলো টুইটারের মতো মাইক্রো ব্লগিং সাইট। ৩৫০ মিলিয়ন মাসিক সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এর সেবা গ্রহণ করে থাকে। এর ১৫৪ মিলিয়ন দৈনিক ব্যবহারকারীর মধ্যে ৯১% নারী। এর রয়েছে ৫০৩ মিলিয়ন রেজিস্ট্রার্ড ব্যবহারকারী। প্রতিদিন এতে ১০০ মিলিয়ন বার্তা পোস্ট হয়। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ১৪ আগস্টে। Sina Weibo-র কারণে চীনের জনগণের মধ্যে বাকস্বাধীনতার ব্যপারে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সাধারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এই অ্যাপসকে সরকারের ভুল কাজের বিরোধীতা করার ক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছে। ফলে সিনা উইবোকে কয়েকবার চীনা প্রশাসনের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে। উল্লেখ্য, চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে টুইটার বন্ধ।
ইউকু বনাম ইউটিউব
ইউটিউবের প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায় Youkuকে। এটি চীনের জনপ্রিয় ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট। ইউকুতে পূর্ণদৈর্ঘ্য ভিডিও আপলোড করা যায়। টেলিভিশন স্টেশন, ডিস্ট্রিবিউটর, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রোডাকশন কোম্পানির মতো ১,৫০০টির ও বেশি লাইসেন্সধারীদের সাথে অংশীদারি করে ব্যবসা করছে ইউকু; যারা নিয়মিত সাইটটিতে ভিডিও কনটেন্ট আপলোড করে থাকে। ২০০৬ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, ভিক্টর কো হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। এর রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী ও ৮০০ মিলিয়ন দৈনিক দর্শক।
iQiyi, Sohu, LeTV, Tencent Video, PPTV, 56.com এবং Funshion এর মতো আরো অনেকগুলো ভিডিও সাইট আছে চীনে। যদিও সাম্প্রতিক বাইদুর iQiyi এসে Youku এর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছে। চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইউটিউব বন্ধ।
এই সাইটগুলোর আকার, সেবা ও বড় ধরনের ব্যবসাসফল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, চীনের বাইরে তাদের পরিচিতি তেমন একটা নেই। বর্তমানে চীনের জনসংখ্যা ১৩৮ কোটির বেশি। এই বিরাট জনসংখ্যক এলাকায় একচেটিয়াভাবে একই ঘরানার দেশজ কোম্পানিগুলো ব্যবসা ও পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোর এখানে ব্যবসার অনুমতি না থাকায়, চীন হয়ে গেছে অনলাইন বিশ্বের আরেক ব্যবসায়ীক কেন্দ্রবিন্দু। গড়ে উঠেছে চাইনিজ সিলিকন ভ্যালি জোংগুয়ানসুন। এর ফলে অনলাইন ভিত্তিক একচ্ছত্রবাদীতেও ক্ষমতার দ্বি-খণ্ডায়ন সৃষ্টি হয়েছে।