প্রিন্টিং বা মুদ্রণ বলতে আমরা সাধারণত কাগজের উপর কালি বা লেজার দিয়ে কোনো ছবি বা লেখা ছাপানোকে বুঝি। কিন্তু বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এ যুগে প্রিন্টিং শুধু দ্বিমাত্রিক কাগজের উপর সীমাবদ্ধ নেই। থ্রিডি গ্রাফিক্স, থ্রিডি মডেলিং, থ্রিডি এনিমেশনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রিন্টিংও এখন থ্রিডিতে উন্নীত হয়েছে।
থ্রিডি প্রিন্টিং হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে কম্পিউটারে ডিজাইন করা ডিজিটাইল ফাইল থেকে ত্রিমাত্রিক বস্তু তৈরি করা হয়। সাধারণত ডিজাইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পদার্থের একের পর এক সূক্ষ্ম আনুভূমিক আস্তরণ বা প্রলেপ স্থাপনের মাধ্যমে বস্তুটি তৈরি করা হয়।
প্রথমদিকে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র প্লাস্টিকের বস্তু তৈরি করা গেলেও দিনে দিনে এর ব্যবহার বিস্তার লাভ করছে। বর্তমানে প্লাস্টিক ছাড়াও স্টিল, কনক্রিট, ফাইবার সহ বিভিন্ন পদার্থের বস্তুও থ্রিডি প্রিন্টিং পদ্ধতিতে তৈরি করা সম্ভব। অন্য অনেক ক্ষেত্রের পাশাপাশি নির্মাণ শিল্পও সম্প্রতি থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের যুগে প্রবেশ করেছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে প্লাস্টিক, স্টিল এবং কনক্রিটের কয়েকটি সেতু।
স্পেনের বিশ্বের প্রথম থ্রিডি প্রিন্টেড ব্রিজ
বিশ্বের প্রথম থ্রিডি প্রিন্টেড ব্রিজ নির্মিত হয় স্পেনের অ্যাক্লোবেন্দাসে। রাজধানী মাদ্রিদের দক্ষিণে অবস্থিত অ্যাক্লোবেন্দাস শহরের কাস্তিলা লা মাঞ্ছা পার্কে এই সেতুটির উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে। ১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.৭৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই সেতুটি মূলত একটি পদচারী সেতু, যা পার্কটির একটি কৃত্রিম জলাধারের উপর স্থাপিত।
সেতুটি আটটি ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিভক্ত, যেগুলোকে পরবর্তীতে একত্রিত করে অখন্ড সেতুর রূপ দেওয়া হয়। প্রতিটি অংশ তৈরি হয়েছে কনক্রিট পাউডারকে উত্তপ্ত করে গলিয়ে স্তরীভূত করার মাধ্যমে। স্টিলের পরিবর্তে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে কনক্রিটের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে থার্মোপ্লাস্টিক পলিপ্রপিলিন। বিশ্বের প্রথম ত্রিমাতৃক মুদ্রণযন্ত্রে মুদ্রিত এই সেতুটি নির্মাণের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে এবং এর নকশা তৈরি করে বার্সেলোনা ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড আর্কিটেকচার অফ কাতালুনিয়া। তবে সেতুটি নির্মাণ করে স্পেনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান অ্যাকিওনা।
ইনস্টিউটের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রিন্ট করার পূর্বে সেতুটির ডিজাইন করা হয়েছিল কম্পিউটারে এবং সেই ডিজাইন অনুযায়ী যেখানে যতটুকু দরকার, সেখানে ঠিক ততটুকু কনক্রিট এবং ফাইবার রিইনফোর্সমেন্ট স্থাপন করার মাধ্যমেই সেতুটি মুদ্রিত করা হয়েছে। তাদের মতে, এ ধরনের ডিজাইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ কাঠামোগত দক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে একইসাথে নির্মাণ সামগ্রীর অপচয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়। এতে কাঠ, প্লাস্টিক বা অন্য কোনো পদার্থের তৈরি বহিঃস্থ কাঠামো ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না এবং সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাঁকা স্থান সহ জটিল জ্যামিতিক নকশার কনক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব হয়, যা প্রচলিত পদ্ধতিতে সম্ভব না।
সেতুটি মুদ্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষক এনরিকো দিনির নির্মিত বিশেষ থ্রিডি প্রিন্টার ডি-শেপ। এটি এই জাতীয় প্রথম প্রিন্টার, যা কনক্রিটের পাউডারকে উত্তপ্ত করে স্তরের পর স্তরে সাজিয়ে কঠিন কনক্রিটের কাঠামো মুদ্রণ করতে সক্ষম।
নেদারল্যান্ডসের সাইকেল আরোহীদের জন্য থ্রিডি প্রিন্টেড ব্রিজ
স্পেনের সেতুটি বিশ্বের প্রথম মুদ্রিত সেতু হলেও এ বছর নেদারল্যান্ডসে ত্রিমাতৃক মুদ্রণের মাধ্যমে আরেকটি কনক্রিটের সেতু নির্মাণ করা হয়, যা মানুষের পাশাপাশি সাইকেল আরোহীদের জন্যও উপযোগী। নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গেমার্টে অবস্থিত এই সেতুটির দৈর্ঘ্য ৮ মিটার এবং প্রস্থ সাড়ে ৩ মিটার। এটি প্রায় ৮০০টি স্তরের মাধ্যমে মুদ্রিত হয়েছিল। এতে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে স্টিলের ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছিল। এর মুদ্রণ কাজে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল।
যদিও এই সেতুটি তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র সাইকেল আরোহীদের পারাপারের জন্য, কিন্তু এর ভারবহন ক্ষমতা আরও অনেক বেশি। গবেষণাগারে এটি পাঁচ টনেরও বেশি ভারবহনে সক্ষম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরো দীর্ঘ স্প্যান বিশিষ্ট এবং যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও ত্রিমাতৃক মুদ্রণের ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। সেতুটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য অনুযায়ী, এটি ৩০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে এবং প্রতিদিন শতশত সাইকেল আরোহী এর উপর দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
নেদারল্যান্ডসের এই সেতুটির নকশা এবং পরিকল্পনা করা হয়েছে এডিনহোভেন ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির তত্ত্বাবধানে। আর সেতুটি নির্মাণ করেছে বিএএম ইনফ্রা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সেতুটি মুদ্রণের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায়, কীভাবে বিশাল একটি মুদ্রণযন্ত্র নকশা অনুযায়ী প্যাঁচানো পথ ধরে কনক্রিটের পাতলা আস্তরণ বিছিয়ে ধীরে ধীরে সেতুটির অংশবিশেষ মুদ্রণ করছে।
ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এই সেতুটি সফলভাবে নির্মাণ এবং স্থাপনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে আরো বড় কনক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বাড়ি, যেগুলো সম্পূর্ণ থ্রিডি প্রিন্টারের সাহায্যে মুদ্রিত হবে।
চীনের প্লাস্টিকের তৈরি থ্রিডি প্রিন্টেড ব্রীজ
চীনের সাংহাইয়ের টংজি ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য এবং নগর পরিকল্পনা অনুষদ, তাদের ভবনের সামনে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে তৈরি প্লাস্টিকের দুটি সেতু স্থাপন করেছে। এদের একটির দৈর্ঘ্য ১১ মিটার, যা ছোট একটি জলপ্রবাহ এবং গাছপালার উপর দিয়ে স্থাপিত। অন্য সেতুটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ মিটার, এবং সেটি শুধু পানির উপর স্থাপিত। বড় সেতুটিতে প্লাস্টিকের তৈরি সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। অন্যদিকে ছোট সেতুটি সম্পূর্ণ সমতল।
সেতু দুইটি তৈরি করা হয়েছে থ্রিডি প্রিন্টার এবং ছয় হাত বিশিষ্ট রোবটের সাহায্যে। মুদ্রণে সময় লেগেছে মাত্র ৩৬০ ঘন্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে মুদ্রণকাজ সম্পন্ন করার পর সেতু দুটির অংশগুলোকে বাইরে এনে একত্রিত করে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। সেতু দুইটি উদ্বোধন করা হয়েছিল এ বছরের ২৪ জুন শুরু হওয়া ডিজিটাল ফিউচার সাংহাই সামার ওয়ার্কশপ অ্যান্ড কনফারেন্সকে উপলক্ষ করে।
১১ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বড় সেতুটি একসাথে পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভার বহন করতে সক্ষম। তবে ব্রীজ দুটিকে সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। এগুলোকে শুধুই প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের স্টিলের তৈরি থ্রিডি প্রিন্টেড ব্রিজ
নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামের বিখ্যাত রেড লাইট শহরের একটি খালের উপর থ্রিডি প্রিন্টেড স্টিলের ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয় আরও কয়েক বছর আগে। বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং সফটওয়্যার অটোক্যাডের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অটোডেস্কের আর্থিক সহযোগিতায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে জরিস লারম্যান স্টুডিও এবং ইনস্টিটিউশন ফর অ্যাডভান্সড আর্কিটেকচার ফর কাতালুনিয়া।
প্রচলিত থ্রিডি প্রিন্টারগুলো তাদের অত্যন্ত উচ্চাকাংখী এই সেতুটি মুদ্রণে সক্ষম না হওয়ায় তারা নিজেরাই এর জন্য বিশেষ থ্রিডি প্রিন্টার এবং সফটওয়্যার তৈরি করেন। তাদের তৈরি এই সফটওয়্যার, প্রিন্টারের এক্সট্রুডার থেকে কপার এবং অ্যালুমিনিয়ামের গলিত মিশ্রণ একটি ছয় হাত বিশিষ্ট রোবটের কাছে প্রেরণ করবে, যা স্টিলের লাইনের পর লাইন তৈরির মাধ্যমে শূন্য থেকে ব্রিজটি তৈরি করবে।
প্রথমে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির পরিকল্পনা ছিল, সেতুটি খালের উপরই তৈরি করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির হেডকোয়ার্টারে এর মুদ্রণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে এর নির্মাণকাজ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, ২০১৮ সালের জুনের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্টিলের ব্রিজটির নির্মাণ সম্পন্ন হবে।
ফিচার ইমেজ- mx3d.com