পাঠক হিসেবে আপনার জন্য একটি প্রশ্ন, আপনাকে যদি বলি, এই লেখাটি কোনো মানবলেখকের নয়, বরং একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা বা আরো সহজ করে বললে- একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের লেখা, তবে তা পড়ার সময় আপনার অনুভূতি কেমন হবে? মানবরচিত কোনো লেখা পড়ার মতোই, নাকি আরো বেশি রোমাঞ্চকর? নাকি অনুভূতিহীন এক যন্ত্রের সৃষ্টি হওয়ায় লেখাটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে?
এতদিন পর্যন্ত কোনো বিষয়ের উপর কোনো লেখা পড়লে তা যে মানবরচিত, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা ছিল না। তবে বর্তমান সময়ে বিষয়টি আর পুরোপুরি সত্য না হবারও সম্ভাবনা আছে। ব্যাখ্যা শুরু করা যাক সবচেয়ে কাছের উদাহরণটি দিয়ে।
এখনকার স্মার্টফোনের কিবোর্ড অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে বেশ জনপ্রিয় ফিচারগুলোর একটি হলো ‘নেক্সট ওয়ার্ড সাজেশন’। কোনো বাক্য লেখার সময় একটি শব্দ লেখার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুমান করে নেয়, পরবর্তী শব্দটি কী হতে পারে। অনুমান অনুযায়ী সর্বোচ্চ সম্ভাব্য শব্দটিসহ আরো একাধিক সম্ভাব্য শব্দ প্রদর্শন করে স্ক্রিনে। অনেক সময় সেই অনুমান মিলেও যায়।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের মাথায় শুরুতেই আসে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিরি কিংবা অ্যামাজন অ্যালেক্সার নাম। কিন্তু এবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক নতুন আরেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে। নির্মাতা অ্যাডাম কিং এর নাম দিয়েছেন টক টু ট্রান্সফরমার। এর বিশেষত্ব জানার আগে চলুন নিচের অংশটি মনোযোগ সহকারে পড়া যাক।
It was cold inside the house. Darknes seemed to be swallowing me, an unknown fear was playing in my thoughts. I felt like I was not alone in the house. Then it happened, suddenly a cold wave flowed down my spine. And then I felt like I was “walking on air”, even though I’m actually frozen. I was flying.”
My brain was unable to process what was happening, which is why I knew that I must have had a stroke or some sort of temporary death, but I didn’t know how long it would be. The thing was so bizarre and so different to the whole state of mind that I had just started to feel a strong physical sensation in my hands. I was trying to look at the outside world, but nothing was….
এর বাংলাটুকু পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো,
ভেতরে খুব ঠাণ্ডা ছিল। মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকার আমাকে গ্রাস করছে, একটা অজানা ভয় আমার চিন্তা-ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ঘরটায় আমি একা নই। তারপরই ব্যাপারটি ঘটল। হঠাৎ আমার মেরুদণ্ড দিয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। এবং তখন আমার মনে হলো, আমি বাতাসে হাঁটছি, যদিও আমি আসলে জমে গিয়েছিলেন, তারপরও আমি উড়ছিলাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে, আমি ভাবছিলাম আমার কোনো ধরনের স্ট্রোক বা সাময়িক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম না এর স্থায়িত্ব কতক্ষণ হতে পারে। বিষয়টা এতই অদ্ভুত এবং আমার মানসিক অবস্থার জন্য অন্যরকম ছিল যে আমার হাতে একটা জোরালো শারীরিক অনুভূতি হচ্ছিল। আমি বাইরে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুই ছিল না…
উপরের অনুচ্ছেদটি কোনো অতিপ্রাকৃতিক উপন্যাসের অংশ নয়। শুরুর বোল্ড করা অংশটুকু ‘টক টু ট্রান্সফরমার’-কে ইনপুট দেয়ার পর বাকি অংশটুকু সেই এআই সম্পূর্ণ নিজের মতো করে লিখেছে। অর্থাৎ, মানুষের লেখার অনুকরণের চেষ্টা করেছে কোনো রকম টেমপ্লেট ব্যবহার ছাড়াই, এমনকি তা কোথাও থেকে সংগৃহীতও নয়। শুধু গল্পের অংশটুকু পড়েই কি আপনি বুঝতে পারতেন, লেখাটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট নয়?
‘নেক্সট ওয়ার্ড সাজেশন’ কিংবা এরকম ‘টেক্সট জেনারেটিং’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা হলো ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলিং। ‘টক টু ট্রান্সফরমার’ এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে আরো বেশি উন্নত মডেল, ওপেনএআই ইনকর্পোরেটেড এর তৈরি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল জিপিটি-২। তবে এসব ক্ষেত্রে মডেলগুলোর জন্য ‘ফ্যাক্ট’ সৃষ্টির থেকে ‘ফিকশন’ লেখা অনেক বেশি সহজ।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লেখকের আসনে বসে পরবর্তী কোনো ‘হ্যারি পটার’ কিংবা ‘লর্ড অভ দ্য রিংস’ কল্পকাহিনীর সিরিজ লিখবে কি না, সে বিতর্কে যাবার আগে এই ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বিষয়টি কী, আর কীভাবেই-বা এআই নিজের মতো করে লিখতে পারলো বাকি অংশটুকু, সে বিষয়ে সহজ ভাষায় কিঞ্চিৎ ধারণা নেওয়া যাক। এরপর আমরা নির্ধারণ করতে চেষ্টা করব, কলমযুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সহযোদ্ধা হতে চলেছে, নাকি অপরাজেয় প্রতিপক্ষ, নাকি কলমযুদ্ধ ছাড়াও অন্য কোনো শঙ্কার কারণ হতে পারে।
ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল পদ্ধতি ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেসিং’-কে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি শাখা হলো এই ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেসিং, যেটি মানুষের ভাষায় কম্পিউটার কীভাবে যোগাযোগ করবে, তা প্রোগ্রাম করা হয়। যেমন গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলা, এক ভাষা থেকে ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা, টেক্সট থেকে স্পিচে রূপান্তরের মতো প্রযুক্তিগুলো নিয়ে কাজ করা হয় এই শাখাতে।
ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল কাজ করে সম্ভাব্যতা এবং পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে। এটি প্রোগ্রাম করা হয় এমনভাবে, যেন কোনো শব্দের সাথে আরেকটি শব্দ যত বেশি ব্যবহার হয়, সেটিই অনুমান করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
এআই কতটা শক্তিশালী হবে, তা নির্ভর করে কত বেশি তথ্য দিয়ে একে ‘প্রশিক্ষণ’ দেওয়া হচ্ছে তার উপর। যত বেশি তথ্য সরবরাহ করা হবে, এটি তত বেশি শিখবে এবং কম ভুল করবে। এজন্য দরকার প্রচুর পরিমাণে নির্ভুল তথ্য। যেমন- অনুবাদের জন্য এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় মানুষের করা অনুবাদ কিংবা স্প্যাম ফিল্টারের জন্য কোন ধরনের ইমেইল বা বার্তা স্প্যাম তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই তথ্যগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করে ধীরে ধীরে ভুলের পরিমাণ কমিয়ে আনে।
কিন্তু একটি আস্ত গল্প কিংবা অনুচ্ছেদ লেখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ধরনের তথ্যের প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ চাইলে কয়েক হাজার বই কিংবা মিলিয়ন মিলিয়ন ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন গল্প বা আর্টিকেল বিশ্লেষণ করে ভাষা শিখে নিতে পারে ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। উইকিপিডিয়ার লক্ষাধিক আর্টিকেল বিশ্লেষণ করে বুঝে নিতে পারে, কোন শব্দের সাথে কোন শব্দটি বেশি সম্পর্কযুক্ত। শব্দের সম্ভাবনা আর পরিসংখ্যানের একটি গাণিতিক ম্যাপ তৈরি করে ফেলে ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষায় একে বলা ‘সেল্ফ সুপারভাইজড লার্নিং’। এর সাথে জটিল কিছু অ্যালগরিদম যোগ করে দিলেই শব্দগুলো নিয়ে আরো ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে এই মডেল। সব থেকে সহজ কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো, যেকোনো বিষয়ের উপর ছোট ছোট কাল্পনিক অনুচ্ছেদ তৈরি।
২০১৭ সালের শেষদিকে বটনিক স্টুডিওজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে জে.কে. রোলিং-এর আসনে বসায়। হ্যারি পটার সিরিজের সব ক’টি উপন্যাস বিশ্লেষণ করে সে এআই আরেকটি গল্প লিখে, যার শিরোনাম ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য পোর্ট্রেট অভ হোয়াট লুকড লাইক অ্যা লার্জ পাইল অভ অ্যাশ’। হাস্যকর এই শিরোনামের তিন পৃষ্ঠার বইটি হাসির খোরাক জোগালেও পাঠক প্রতিক্রিয়া অনুসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই দক্ষতা কেবল গল্পের অংশ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তৈরি করেছে কাব্যগ্রন্থ, লিখেছে সংবাদ আর আর্টিকেলও।
২০১৭ সালে ডাটা সায়েন্টিস্ট রস গুডউইন গুগলের সহায়তায় একটি প্রজেক্ট পরিচালনা করেন। জিপিএস সিস্টেম, বিশেষ ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন সংযুক্ত কালো রঙের এক ক্যাডিলাক গাড়িতে চেপে ব্রুকলিন থেকে নিউ অরলিন্সের উদ্দেশে পাড়ি জমান তিনি। যাত্রার সময় আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করতে থাকে ডিভাইস তিনটি, পাঠাতে থাকে ভেতরে ল্যাপটপে থাকা নিউরাল মডেলে। চারপাশের পরিবেশ আর সময়ের সাথে মিল রেখে সেই কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে থাকে কবিতা। চারদিনের দীর্ঘ সফর শেষে রচিত হয় ইতিহাসের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘ওয়ান দ্য রোড’। মানবরচিত না হলেও তাতে শৈল্পিকতার ঘাটতি ছিল না। বইটির কাগুজে কপি কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রোভার নামের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের উপর ভিত্তি করে অ্যাডাম গেটজি তৈরি করেছেন ‘নিউজ ইউ কান্ট ইউজ’ নামের এক ওয়েবসাইট, যেখানে কেবল ভুয়া সংবাদ রয়েছে, যার সবগুলোই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লিখেছে। ৫,০০০ এর বেশি পাবলিকেশনের নিউজ আর্টিকেল দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে এই মডেলকে। মজার বিষয় হলো, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখার সামঞ্জস্য বজায় রাখলেও তথ্যের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারেনি সেই মডেলটি, কেবলই তা মানুষের সংবাদ লেখার ধরন অনুকরণ করেছে।
ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করে লেখা হচ্ছে সিনেমার স্ক্রিপ্টও। এমনই আরও অনেক উদাহরণ তুলে আনা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৃতিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয়, ভবিষ্যতে মানুষের সাথে সৃজনশীল এই প্রতিভার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? সত্যিকার লেখক কি তার স্থান হারাবে, ঠিক যেভাবে রোবটের কাছে চাকরি হারাচ্ছে মানুষ? নাকি নতুনত্বের প্রতি আমাদের এই শঙ্কা একেবারেই অমূলক?
শুরু থেকে বর্ণনা দিয়ে আসা এত কেচ্ছা-কাহিনীর মূলে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যা হলো তথ্য বা ডাটা। মেশিন যা কিছু করে, যা কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, তা সবই তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। এখানে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করে নতুন কোনো তথ্য সৃষ্টি করে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি গল্প বা উপন্যাস কেবলই কিছু শব্দ নিয়ে গঠিত বাক্যের পুনর্বিন্যাস নয়। একেকটি উপন্যাস একইসাথে একেকটি অভিজ্ঞতা, অভিব্যক্তি এবং নতুনত্বের বহিঃপ্রকাশ। অনুভূতিহীন, অভিজ্ঞতাহীন একটি কম্পিউটার যে বিষয়ে এখনও একেবারেই দক্ষ নয়। তথ্য নিয়ে কাজ করতে অভিজ্ঞ হলেও সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির প্রয়োগ জানে না এই কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলো।
বর্তমান সময়ের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের সীমাবদ্ধতার আরেকটি বড় অংশ হলো সত্যতা যাচাই। এসব প্রযুক্তি যা লিখছে, তা কতটা যৌক্তিক তা নিজে থেকে নির্ধারণ করতে পারে না। অবাস্তব কিছু বিষয়ের সংমিশ্রণে উপন্যাস লিখে কখনোই মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একইসাথে গুরুত্বপূর্ণ লেখার সামঞ্জস্য বজায় রাখা। এখন পর্যন্ত লিখিত বিষয়গুলোর পরিসর খুব ছোটই, এরপরেও দেখা গেছে সেসব লেখাতে রয়েছে যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ বড় পরিসরের কোনো উপন্যাস লেখার মতো কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও আসেনি। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রযুক্তি যতটা না প্রতিদ্বন্দ্বী, তার থেকেও বড় একটি উপকরণ, যা মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবতে শেখাতে পারে। তবে অদূর ভবিষ্যতে এসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন অনেক গবেষক। তখন কি লেখকের স্থানচ্যুত হবে মানুষ, বর্তমান সময়ে যেভাবে রোবটের জন্য কর্মসংস্থান লোপ পাচ্ছে?
একটি বিষয় এখানে মাথায় রাখা জরুরি- রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিন্তু মানুষের কর্মসংস্থান সংকটে ফেলছে না, বরং কর্তৃপক্ষই লাভের আশায় কর্মী ছাঁটাই করছে। ভবিষ্যতের প্রকাশনা সংস্থাগুলো অবশ্যই লাভের অঙ্কটা বেশ ভালোমতোই হিসেব করবে, কারণ এআই জেনারেটেড কোনো বইয়ের জন্য কম্পিউটারকে এর লভ্যাংশ দেওয়া লাগবে না।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লেখার থেকেও আরও বড় চিন্তার বিষয় আছে এ প্রযুক্তি নিয়ে, তা হলো পক্ষপাতিত্ব। নিরপেক্ষ ফলাফলের আশায় আমরা দ্বারস্থ হয়েছি প্রযুক্তির। কিন্তু বাস্তবেই কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে?
২০১৬ সালে প্রো-পাবলিকার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোর্টে ব্যবহৃত একটি এআই প্রোগ্রাম ‘কম্পাস’ জেলে থাকা বন্দীদের পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতার সম্ভাব্যতা জানায়। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, প্রোগ্রামটি ভুলভাবে প্রতিবার কৃষ্ণাঙ্গ আসামীদের অপরাধ প্রবণতার হার বেশি দেখায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায়। কীভাবে এই প্রোগ্রাম কাজ করে, তা এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। একইভাবে অন্য আরেকটি প্রোগ্রাম প্রেডপোল অনুমান করে, কোন এলাকাতে অপরাধ প্রবণতা বেশি; সে অনুযায়ী পূর্বে থেকে সেখানে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এবারও প্রতিবার ফলাফল আসে কৃষ্ণাঙ্গদের আবাসস্থলে অপরাধ সংঘটিত হবার শঙ্কার পরিমাণ বেশি।
উভয়ক্ষেত্রেই প্রোগ্রামগুলোকে পূর্বের পুলিশ রিপোর্ট, ক্রাইম কেস ইত্যাদির তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। অর্থাৎ, এতদিন মানুষ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে, ঠিক তা-ই শেখানো হয় প্রোগ্রামগুলোকে, নিরপেক্ষতা নয়। আগেও বলা হয়েছে- কী ধরনের তথ্য দিয়ে এসব প্রোগ্রামকে প্রশিক্ষিত করা হয়, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে ধরনের তথ্য সরবরাহ করব, ঠিক তেমনই ফলাফল পাব। নিজেদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিমূলক তথ্য দিয়ে আমরা কখনোই নিরপেক্ষতা আশা করতে পারি না। লেখনীর বিষয়েও একই ব্যাপার অনুমান করা যায় কি?
এসব ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল দিয়ে খুব সহজেই তৈরি করা সম্ভব ভুয়া সংবাদ, বিতর্কিত বিষয়ের উপর লেখা কিংবা বর্ণবাদ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন খবর। ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ভুল স্থানে প্রযুক্তির প্রয়োগের মাশুল কীভাবে গুনতে হয়। ভুল হাতে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার যে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অন্যতম অস্ত্র, তা চিন্তা করা খুব কঠিন কিছু নয়।
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট জুড়ে যেখানে ভুয়া সংবাদের বিচরণ, সেখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি ভুয়া সংবাদ আগুনে ঘি ঢালার শামিল। পণ্যের ভুয়া রিভিউ কিংবা অনলাইনে মানুষের সাথে তর্কেও জড়াতে পারে এ প্রযুক্তি।
তবে যে প্রশ্নটি এখন গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- নতুন সৃষ্টি হওয়া এসব কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? স্বত্বাধিকার কিংবা দায়বদ্ধতাই বা কার? যেসব আইন প্রচলিত আছে, তার বেশিরভাগ এসব প্রযুক্তির জন্য পরিষ্কারভাবে কিছু নির্ধারণ করে না। অনেক সময় আইনের থেকে প্রযুক্তির উন্নয়ন হয় দ্রুত। সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিগুলোর কার্যপদ্ধতি আরও জটিল হচ্ছে, জনসাধারণে জন্য তা বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রযুক্তির স্বচ্ছতা তুলে ধরছে না।
প্রযুক্তির কল্যাণে পর্দার অপর পাশে থাকা ব্যবহারকারী নিয়ে আগেও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে গুগল ডুপ্লেক্সের মতো প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুকরণ করেছে মানুষের চেহারা, কণ্ঠ; আর এখন করছে ভাষা। মানুষে মানুষে যেখানে অনলাইন নিরাপদ জায়গা নয়, সেখানে কৃত্রিম এই বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে।
এই লেখায় কেবল লেখক হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা আর আমাদের মনে জাগা শঙ্কার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু এর ফলে সবক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিংবা শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখলে চলবে না। বরং, আমাদের জীবন সহজ করতে একদল মানুষ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই প্রযুক্তি নিয়ে, অসংখ্য শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তাদের জন্য। আপনার কি মনে হয়? জানাতে ভুলবেন না। আপনি কীভাবে দেখছেন আগামীর এই প্রযুক্তিকে।