সেই যুগে ভদ্রঘরের মেয়েরা মোটর সাইকেল চালিয়ে বেড়াত না।
– বেসি স্ট্রিংফিল্ড
আধুনিক সভ্য সমাজে আজও বর্ণবৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। আর যদি ১৯৩০-৪০ এর দশকের কথা ধরা হয়, তাহলে এ বৈষম্যই ছিল সেসময়ের সমাজের স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু সামাজিক রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইতিহাস তৈরির নজিরও বিশ্বে নেহাত কম নয়। আর হয়তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণেই, রীতিবিরুদ্ধ আচরণের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টির কাজটি মেয়েরাই বেশি করেছে। বেসি স্ট্রিংফিল্ড এমনই একজন দুঃসাহসী নারী যিনি শুধু রীতি ভঙ্গ করে ইতিহাসই তৈরি করেননি, আদায় করে নিয়েছেন নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকুও।
বেসি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন মোটরসাইকেলে একা গোটা যুক্তরাষ্ট্র পরিভ্রমণকারী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে। ১৯৩০-৪০ এর দশকে তিনি এই কাজটি করেন। প্রথমবারের অর্জনের পরে তিনি আরও সাতবার, অর্থাৎ মোট আটবার মোটরবাইক নিয়ে গোটা যুক্তরাষ্ট্র একা ভ্রমণ করেছেন। চষে বেড়িয়েছেন দেশটির ৪৮টি রাজ্য জুড়ে। তার নিজের মোট ২৭টি হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল ছিল, যেগুলোর বিভিন্নটি তিনি বিভিন্ন অভিযানে ব্যবহার করেন।
১৯১১ সালের ৫ মার্চ ডাচ মা ও জ্যামাইকান বাবার ঘরে জ্যামাইকার কিংস্টোনে বেটসি এলিয়াসের জন্ম হয়। এর অল্পদিন পরেই তার পরিবার বোস্টনে চলে আসে। কিন্তু বেসির বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা-মা দুজনই মারা যান। বোস্টনে বসবাসকারী একজন আইরিশ ক্যাথলিক নারী তাকে দত্তক নেন ও লালন-পালন করেন। এই ক্যাথলিক নারীর পরিচয় বেসি কোথাও উল্লেখ না করলেও তাকেই তিনি ‘মা’ বলে ডাকতেন। বোস্টনে বেড়ে ওঠা ‘বেটসি’ ঠিক কীভাবে ‘বেসি’ হয়ে ওঠেন, তা জানা না গেলেও, তার ‘মোটরসাইকেল কুইন অভ মায়ামি’ হয়ে ওঠার গল্প বহুল প্রচলিত। তবে এই কিংবদন্তিতুল্য স্থান অর্জনের জন্য নারী হিসেবে তাকে যতটা প্রতিবন্ধকতা সইতে হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি সইতে হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ হবার কারণে।
১৯২৮ সালে মায়ের কাছে তিনি একটি মোটরসাইকেল চান। সেই ‘ইন্ডিয়ান স্কাউট’ নামের মোটরসাইকেল নিয়ে তার ‘মোটরসাইকেল কুইন’ হয়ে ওঠার যাত্রার শুরু। কিশোরী বেসি তখনো জানতেন না কীভাবে মোটরসাইকেল চালাতে হয়, কিন্তু শিখে নেবার ব্যাপারে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। পরে তিনি হার্লে ডেভিডসন ব্র্যান্ডের বাইক ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং এ ব্র্যান্ডের বাইকই তিনি আজীবন ব্যবহার করেন।
আমি হার্লে ডেভিডসন ছাড়া অন্য কোনো বাইক কখনোই চাইতাম না।
– বেসি স্ট্রিংফিল্ড
বেসির অনুসারী ও তার জীবনীর লেখক অ্যান ফেরারের লেখা ‘হিয়ার মি রোর: উওমেন, মোটরসাইকেলস অ্যান্ড দ্য রাপচার অভ দ্য রোড’ নামক বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৯ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানচিত্রের ওপরে একটি পয়সা ঘুরিয়ে গন্তব্য স্থান নির্ধারণ করেন এবং তার বাইক নিয়ে একা যুক্তরাষ্ট্র সফরে বেরিয়ে পড়েন। সেই সময়েও আন্তঃপ্রদেশ রাজপথ নির্মাণ হয়নি, কিন্তু বন্ধুর পথ তার সংকল্পকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৪৮টি প্রদেশকে সংযুক্তকারী পথে বাইক চালিয়ে ভ্রমণকারী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নেন।
কিন্তু ১৯৩০-৪০ এর সময়টাতে বর্ণবৈষম্য ও জিম ক্রো আইনের কারণে বেসিকে অজানা পথে একা চলাচলের ঝুঁকির চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়। সেসময়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে বাইক নিয়ে রাস্তায় বেরোতে দেখাটা কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। সেই আইনের কারণে বেশিরভাগ মোটেলেই তাকে থাকার অনুমতি দেওয়া হতো না। সেসকল রাতে তিনি তার বাইকের ওপরে জ্যাকেট মাথায় দিয়ে শুয়ে গ্যাস স্টেশনেই রাত কাটাতেন। আর ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে, পথে যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের সাথে তার পরিচয় হতো, তাদের বাড়িতে রাত কাটানোর সুযোগ পেতেন।
যখন আমি মোটরসাইকেলে চড়ি, তখন ওপরে থাকা ঐ মানুষটিকে (ঈশ্বরকে বেসি এভাবেই সম্বোধন করতেন) সামনে রেখেই এগিয়ে যাই। এই দ্বিচক্রযানে চড়লে আমি ভীষণ খুশি থাকি।
– বেসি স্ট্রিংফিল্ড
আমেরিকার মোটরসাইকেল চালনার সংস্কৃতি তখনও উদারপন্থী ছিল না। আমেরিকান মোটরসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কৃষ্ণাঙ্গ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি শুরু হয় ১৯৫০-এর দিকে, তা-ও আবার শুধুমাত্র পুরুষদেরই সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিভিলিয়ান মোটরসাইকেল ডিসপ্যাচার দলে যোগ দেন এবং এ দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য। নীল রঙের হার্লে ডেভিডসন নাকলহেডের সামনে সেনাবাহিনীর ক্রেস্ট বসিয়ে নিয়ে বেসি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সেনাঘাঁটিতে বিভিন্ন কাগজপত্র আদান-প্রদান করতেন।
১৯৩৯ সালে তিনি ফ্লোরিডার মায়ামিতে চলে যান এবং সেখানেই একটি বাড়ি কিনে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ফ্লোরিডার প্রথমদিকের দিনগুলোতে স্থানীয় পুলিশের কারণে তাকে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত আমেরিকান মোটরসাইক্লিস্ট এর একটি সংখ্যায় উল্লেখ আছে, তিনি যখন মোটরসাইকেল লাইসেন্স নিতে যান, সেখানকার পুলিশ তাকে জানায় যে, তারা একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে নিজেদের এলাকায় মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি দেবে না।
উক্ত কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকার পুলিশপ্রধান ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ। বেসি তার সাথে দেখা করার আবেদন জানান। পুলিশপ্রধান তাকে নিকটস্থ একটি পার্কে নিয়ে গিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকটি কঠিন কসরৎ করে দেখাতে বলেন, আর বেসি অত্যন্ত সফলতার সাথে সবক’টিই করে দেখান।
সেদিনের পর থেকে পুলিশ আমাকে আর কখনও হয়রানি করেনি, আর আমি আমার লাইসেন্সও পেয়ে যাই।
– বেসি স্ট্রিংফিল্ড
এরপর তিনি বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, ‘আয়রন হর্স’ নামে একটি মোটরসাইকেল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘মোটরসাইকেল কুইন অভ মায়ামি’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। একবার পুরুষ সেজে একটি রেস জেতার পর হেলমেট খুলে নিলে শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে তাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। ৭০ বছর বয়সেও তিনি মোটরসাইকেল চালিয়েই গির্জায় যেতেন। এমনকি মৃত্যুর আগপর্যন্তও তিনি মোটর সাইকেল চালিয়ে যান।
বেসি মোট ছ’বার বিয়ে করেন। প্রথম স্বামীর সাথে তিনটি সন্তান হারানোর কষ্টে আর কখনও গর্ভধারণের চেষ্টা করেননি। বিবাহবিচ্ছেদের পরেও তৃতীয় স্বামী আর্থার স্ট্রিংফিল্ডের অনুরোধে তার নামটি তিনি নিজের নাম থেকে সরিয়ে নেননি। ১৯৯৩ সালে ৮২ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২০০০ সালে আমেরিকান মোটরসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন একটি প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে তাকে সম্মান জানায়। সেই সাথে মোটরসাইকেল সংক্রান্ত ক্রীড়া ও বিনোদনকে নতুন নতুন দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য প্রতি বছর বেসি স্ট্রিংফিল্ড অ্যাওয়ার্ড নামে পুরস্কারেরও প্রচলন করে। ২০০২ সালে তিনি আমেরিকান মোটরসাইকেল অ্যাসোসিয়েশনের হল অভ ফেমেও জায়গা করে নেন। মায়ামি টাইমসের ২০০২ সালের জুন মাসের সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়, ২০০ নারী মোটরসাইকেল চালক বেসির দক্ষিণ ফ্লোরিডার বাড়িতে গিয়ে প্রয়াত এই পথপ্রদর্শককে সম্মান প্রদান করেন।