ভ্রমণ, শিকার কিংবা নিতান্তই কোনো প্রয়োজনে হাঁটছেন কোনো জলাশয়ের উপর জমা বরফের উপর দিয়ে। হঠাৎ সেই বরফ আর আপনার ভার বহন করতে আগ্রহী হলো না। ভাগ্যের নির্মমতায় অতিশয় ঠান্ডা বরফ পানিতে নিমজ্জিত হলেন অকস্মাৎ। তো, কী করবেন তখন? নিশ্চয়ই ভাবছেন, এক নিমেষেই বরফের পাড় ধরে উপরে উঠে দাঁড়াবেন? তবে আপনার জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, কাজটা মোটেও ততটা সহজ নয়। কারণ অকস্মাৎ প্রচন্ড ঠান্ডা পানির শক আপনার শরীরের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেবে, আর সেই সাথে প্রতি সেকেন্ড সময়ের সাথে বাড়তে থাকবে আপনার জীবনের ঝুঁকি। আর অত সহজে ভেঙে যাওয়া বরফের পাড়কে আবার আপনার ভার বহন করতে রাজি করাতেও পারবেন না। এই সময়টাতে যদি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে সামান্য সময়ও নষ্ট করেন, তবে জীবনে আর সেই ভুল শোধরাতে পারবেন কি না সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে কিছু বিষয় মাথায় রাখলে সেই অসময়েও সমর্থ হতে পারেন জীবন বাঁচানোর কার্যকর উদ্যোগটি নিতে।
পাতলা বরফ কি চেনা যায়?
জলাশয়ের উপর পাতলা বরফের আস্তরণ সবসময়ই জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবচেয়ে ভালো হবে আগে থেকেই সতর্ক থাকা এবং এই ধরনের অঞ্চল এড়িয়ে চলা। আর যদি এড়িয়ে যাওয়া নিতান্তই না সম্ভব হয়, তবে দুর্ঘটনার পূর্ব প্রস্তুতি রাখাটাই হবে সবচেয়ে বু্দ্ধিমানের কাজ। তবে পাতলা বরফ চেনা একেবারেই সহজ নয়। চেনার চেষ্টা করার আগে নিচের বিষয়গুলোও মনে রাখতে হবে-
- দূর থেকে বরফের পুরুত্ব মাপা প্রায় অসম্ভব। একটি জলাশয়ের পুরো অংশে বরফ একইরকম পুরু হবে তা নয়, বরং একটি স্থানে ছয় ইঞ্চি পুরু হলেও অন্য স্থানে তা এক ইঞ্চিও হতে পারে।
- একই অঞ্চলের সব জলাশয়ে, একই তাপমাত্রায়, একই রকম পুরুত্বের বরফ জমবে তা না-ও হতে পারে। কারণ এটি অনেকাংশে নির্ভর করে একটি জলাশয়ের আকৃতি ও গভীরতার উপর।
- যেখানে প্রবাহমান পানির উৎস আছে, সেখানকার বরফগুলো সাধারণত কম স্থিতিশীল হয়। হতে পারে এর অধিকাংশ জায়গাই নিরাপদ, কিন্তু বিপদও লুকিয়ে থাকে আশেপাশেই।
- নতুন বরফ পুরাতন বরফ থেকে বেশি ভার বহনে সক্ষম।
- কখনো কখনো বরফের নিচের পানিতে মাছের ঝাঁক কিংবা জলজ প্রাণীদের চলাচলের কারণেও বরফ অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।
যা-ই হোক চলার পথে পাতলা বরফেরর ঝুঁকি থেকে বাঁচতে, বরফের উপর দিয়ে চলার সময় এর রঙ, আশেপাশের ফাটল, দুর্বল বরফের বৈশিষ্ট্য, গর্ত এবং অস্বাভাবিক আস্তরের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি না থাকলেও অধিকাংশ সময়ই এসব বৈশিষ্ট্যের উপর চোখ বুলিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চেনা যায়।
রঙ দেখেও যায় চেনা
বরফের রঙের দিকে তাকিয়ে আপনি বরফের ভারবহন ক্ষমতা সম্পর্কে, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারবেন। তাপমাত্রা যা-ই থাকুক না কেন, ধূসর রঙের বরফ একেবারেই নিরাপদ নয়। কারণ বরফের এই রং বরফ জমাট বাঁধার প্রাথমিক স্তরে হয়ে থাকে। সাদা কিংবা ঘোলাটে রঙ জল সংশ্লেষিত বরফকে নির্দেশ করে, যার একটি স্তর গঠিত হওয়ার পর আরেকটি পাতলা স্তর গঠিত হচ্ছে। অধিকাংশ সময় এই বরফ দুর্বল ও ঝাঁঝড় বিশিষ্ট হয়। নীল কিংবা স্বচ্ছ বরফ সাধারণত পুরু ও নিরাপদ। এই বরফে মোটামুটি নিশ্চিন্তেই পা ফেলতে পারেন। তবে কর্দমাক্ত ও পচাগলা বরফ থেকে একেবারেই সাবধান। এমনকি পা ফেলে পরীক্ষা করাটাও হয়ে উঠতে পারে অনিরাপদ!
বরফের পুরুত্ব পরীক্ষা
চলার পথের নিরাপত্তার জন্য বরফের পুরুত্ব পরীক্ষা করাটা জরুরি। তবে তার আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, পরীক্ষার জায়গাটি নিরাপদ। পুরুত্ব পরিমাপের ছিদ্র করার জন্য আইস অগার (বরফ ছিদ্র করার যন্ত্রবিশেষ) কিংবা কর্ডলেস ড্রিল মেশিন ব্যবহার করা হয়। তারপর পরিমাপের ফিতা সেই গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে বরফের পুরুত্ব পরিমাপ করা যায়।
বরফের পুরুত্ব ৩ ইঞ্চির কম হলে পেছন দিকে হাঁটাই হবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আর পুরুত্ব কমপক্ষে ৪ ইঞ্চি হলে একজন মানুষের চলাচলের জন্য নিরাপদ ধরা হয়। কয়েকজনের হাঁটাচলার জন্য অবশ্যই তা ৫ ইঞ্চি হলে ভালো। তবে একদল মানুষের একসাথে হাঁটার জন্য বরফের পুরুত্ব অবশ্যই ৮-১২ ইঞ্চি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর এটিভি কিংবা বরফযানগুলোর জন্য ৮-১২ ইঞ্চি এবং বড় গাড়ির জন্য কমপক্ষে ১২ ইঞ্চি পুরু বরফ নিরাপদ।
ঝুঁকি মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতি
পাতলা বরফের উপর দিয়ে যদি আপনার পথ চলতেই হয়, তখন অবশ্যই আপনার প্রস্তুতি থাকতে হবে যেকোনো খারাপ সময়ের জন্য। কাজেই-
- ঝুঁকিপূর্ণ নির্জন স্থানে একা পাতলা বরফের উপর চলাচল করবেন না। এটি একটু বেশিই বিপদজনক, কারণ যেকোনো বিপদে সাহায্য করার কেউ থাকবে না।
- আপনার মোবাইল ফোন যাতে পানিতে ভিজতে না পারে সেজন্য অন্তত একটি পলিথিন ব্যবহার করতে পারেন। কখনো বিপদে পড়লে যাতে সাহায্য চাইতে মোবাইলের ব্যবহারটা অন্তত করতে পারেন।
- প্রতি দেড়শ মিটার পরেই বরফের পুরুত্ব মাপুন। আপনার জুতা নির্বাচনের দিকেও খেয়াল রাখুন। এর ধারালো সোল বরফকে যাতে ভাঙতে সহায়তা না করে।
- সাথে বরফের কুঠার (Ice Axe) জাতীয় কিছু রাখতে পারেন। দুর্ঘটনায় এর মাধ্যমে পিচ্ছিল এবং সমতল বরফের উপরে ওঠা সহজ হবে।
- লাইফ জ্যাকেট পরুন। এটি আপনাকে বরফমিশ্রিত পানিতে ভেসে থাকতে ও উপরে উঠতে দারুণভাবে সাহায্য করবে।
- সাথে লম্বা, দড়ি রাখুন যাতে পানিতে পরে গেলে, কেউ আপনাকে দূর থেকে টেনে তুলতে পারে।
- পাতলা বরফের উপর ঝাঁপ দেওয়া বা শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকুন।
- যদি আপনি অনুভব করেন আপনার পায়ের নিচের বরফ অনিরাপদ, তবে দ্রুততার সাথে প্রয়োজনে লম্বালম্বি শুয়ে আপনার ওজন ছড়িয়ে দিতে পারেন। তারপর নিরাপদ জায়গায় নিজেকে সরিয়ে নিন।
- সঙ্গে একাধিক গাড়ি থাকলে রাখার ক্ষেত্রে দুটো গাড়ির মাঝখানে অন্তত পঞ্চাশ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। গাড়ি রাখার কাছে গর্ত করুন, যদি পানি উপরের দিকে উঠে আসে তবে গাড়ি সেখানে রাখা নিরাপদ নয়। এছাড়া কয়েক ঘন্টা পরপর গাড়ি রাখার স্থান পরিবর্তন করুন।
বরফ পানিতে পড়ে গেলে কী ঘটে শরীরে?
যেকোনো কারনেই আকস্মিকভাবে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি প্রাথমিকভাবে মানুষের শরীরে যে প্রভাবটি ফেলে তাকে বলা হয় “ঠান্ডা পানির শক” বা “কোল্ড ওয়াটার শক”। এতে মানুষের রক্তচাপ, হার্টবিট নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়, এমনকি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে ফেলে। তবে প্রাথমিক এই শক দুই-তিন মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। কিন্তু তার মানে এই না যে, এরপর আপনি ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছেন। বরং সময়ের সাথে বাড়তে থাকবে হাইপোথার্মিয়া বা শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হ্রাস সংক্রান্ত ঝুঁকি।
দুর্ঘটনায় করণীয়
সবকিছুর পরেও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা যদি ঘটেই যায়, আর উদ্ধার করার মতো আশেপাশে কেউ না থাকে, তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আপনার সতর্ক থাকতে হবে। যেমন-
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে শান্ত রাখা। অযথা শক্তির অপচয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- আকস্মিক শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া ও ঠান্ডা পানির শকের কারণে শ্বাস নেওয়া এবং শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কষ্টকর হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
- মাথা পানির উপর রাখার চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব। মনোযোগ রাখতে হবে দ্রুত সেখান থেকে উঠে আসার দিকে। আর আসার পথ যেদিকে ছিল সেদিকে উঠতে চেষ্টা করাটাই সবচেয়ে ভালো, কারণ অন্যপাশের বরফগুলোর কী অবস্থা তা পরীক্ষা করার উপযুক্ত সময় সেটা নয়।
- দ্রুত বরফের কিনারায় পৌঁছে, প্রথমে দুই বাহু এবং তারপর লম্বালম্বিভাবে যতটা সম্ভব শরীরের ভার বরফের উপর তুলে দিয়ে, এরপর যতটা সম্ভব শক্তি দিয়ে নিজেকে পানি থেকে বরফের উপর তুলে আনার চেষ্টা করতে হবে। উপরে উঠতে পারলে উঠে দাঁড়ানো যাবে না, বরং গড়িয়ে চলতে হবে, যতক্ষণ না নিরাপদ বরফের উপর পৌঁছানো যায়।
- পরিধেয় কাপড় খুলে ফেলার আগে শুকনো বিকল্প খুঁজে নিতে হবে। দ্রুতই গরম জায়গা খুঁজে নিতে হবে। গরম কাপড়ে নিজেকে ঢেকে ফেলতে হবে। আগুনের পাশে বসে শরীরকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিতে চেষ্টা করতে হবে।
- গরম পানীয় পান এই সময় ভালো ফল দিতে পারে। গরম পানীয়র মগ আপনার হাতের তাপমাত্রাও বাড়াতে সাহায্য করবে।
- সর্বোপরি, দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
দুর্ঘটনায় পড়লে এই সময়ের প্রত্যেকটা মুহুর্ত আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীর হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়া কিংবা আপনি চেতনা হারানোর আগে, আপনার শরীরের অবস্থা, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া আর কতটা আক্রান্ত হয়েছেন তার উপর ভিত্তি করে পনের মিনিট থেকে এক ঘন্টা সময় পেতে পারেন। বাঁচতে হলে এই অল্প সময়কে কাজে লাগাতে হবে পুরোপুরি।