“আমরা ‘লা টের লা মার’ (ভূমি এবং সমুদ্র) হাতে পাই, যা আমাদের পেশাদারী শেফদের নতুন এবং সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে সহায়তা করে।”
উক্তিটি ইয়ানিক হিউডের। ফ্রান্সের সেইন্ট মালো শহরের অতি পরিচিত ওয়াইনের দোকান কেভ দে আই’আবায়ে সেইন্ট জিনের মালিক এবং স্থানীয় রান্নার স্কুল লা’ইকোল ডু গোউটের অংশীদার। আর তিনি এখানে যে ব্যাপারে কথা বলেছেন তা ফ্রান্সের একটি শহর সেইন্ট মালোর এক অনন্য কিন্তু অদ্ভুত ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। এই নতুন উৎসবটির নাম আই’ইমারসন, যা শুরুর পেছনে হিউড এবং তার বন্ধুদের অবদান রয়েছে। তাদের ছোট একটা আয়োজন বিশ্ববাসীর নিকট, মূলত ওয়াইন প্রেমিকদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে শুরু হয় এই উৎসব? কী করা হয় এই দিনে? একে অদ্ভুত বলার পেছনেই বা কী কারণ আছে? আজকের এই লেখা আপনাদের এসব প্রশ্নের উত্তরই দেবে।
আই’ইমারসন আরম্ভ হওয়ার গল্পটা বেশি পুরনো নয়, মাত্র ১৫ বছর আগের ঘটনা। এ সম্পর্কে জানার আগে আমরা একটু সেইন্ট মালো নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নিই, যেখানে এই বিশেষ ঐতিহ্যের দেখা মেলে।
সেইন্ট মালো
সেইন্ট মালো একটি ঐতিহ্যবাহী ফরাসি বন্দর, যা ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক অঞ্চল ব্রিটানির যে জায়গায় রান্স নদী এবং ইংলিশ চ্যানেল মিলিত হয়েছে সেখানে অবস্থিত। দেয়ালে ঘেরা শহরটির রয়েছে জলদস্যুতা, চাঁদাবাজি এবং বিদেশ অভিযানের রোমাঞ্চকর ইতিহাস। পর্যটকদের কাছে সেইন্ট মালো আকর্ষণীয় হওয়ার একটি বিশেষ কারণ হলো, এখানে ইউরোপের সর্বোচ্চ জোয়ার-ভাটা দেখা যায়।
গ্র্যানাইটের তৈরি মধ্যযুগীয় কেল্লা এবং লবণাক্ত রাস্তাগুলোতে জোয়ার-ভাটার দেখা মেলে। অবশ্য সেইন্ট মালোর আঞ্চলিক সম্প্রদায় ‘মালোইন’ এরকম চরম জলপ্রবাহকে বিরক্তির চোখে নয়, বরং আত্মার সম্পর্কের মতো মনে করে এই প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে নেয়। তারা এই জোয়ার-ভাটার সাথে জন্মসূত্রেই আবদ্ধ।
ব্রিটানির উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বন্দরটি খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে ফরাসিরা দখল করে নেয়। যেহেতু পানি সবসময় সমুদ্রে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে, তাই এর উঠতি জোয়ার-ভাটাও একটু বেশি।
মালোইন জাতি
সেইন্ট মালো বন্দরে বসবাসরত মূল জাতি মালোইন। একসময় তারা পূর্বে কুইবেক এবং ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত ব্যবসা করার জন্য বা চাকরির খোঁজ করতে যেত। ১৫৯০ সালে সেইন্ট মালোর এই সম্প্রদায় ফ্রান্স থেকে মুক্তি লাভের আশায় যুদ্ধ করে, যা দ্য ওয়ার্স অব রেলিজিয়নের অন্তর্ভুক্ত। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের উপকূলীয় অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতি ফরাসিদের হাত থেকে রক্ষা করা। মালোইনদের নীতিবাক্য ছিল- “ফরাসি নয়, ব্রিটন নয়, আমরা মালোইন”। তবে এত কিছুর পরও তারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। মাত্র তিন বছরের মাথায় স্বশাসিত রিপাবলিক অব সেইন্ট মালো তাদের স্বাধীনতা ফ্রান্সের কাছে আবার হারায়।
কিন্তু মালোইনদের আছে ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য ও অফুরন্ত সাহস, যা সমুদ্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব বিষয়ের জন্য বিশ্বদরবারে সেইন্ট মালো বেশ পরিচিতি লাভ করে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সেইন্ট মালো তার ওয়াইন উৎপাদনের কলাকৌশল ও উপকূলবর্তী ঐতিহ্যের জন্য এতটাই পরিচিত যে এ সম্পর্কে কিছু সাহিত্যও রচিত হয়েছে। শহরটি এবং তার আশেপাশের অঞ্চল পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে, যখন ফরাসিরা এখানে মরিচের ব্যবসা শুরু করে এবং সেইন্ট মালোকে এই ব্যবসার প্রধান বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর এর অন্যান্য ইতিহাস এবং সমুদ্রযাত্রার বিষয়গুলো তো আছেই।
বর্তমানে পর্যটকদের নিকট সেইন্ট মালো একটি প্রখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, যার ফেরি টার্মিনাল পোর্টসমাউথ, ওয়েমাউথ এবং পুলে রয়েছে। গ্রীষ্মকালে রোদ পোহাতে বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা, বিশেষ করে ইংরেজরা এখানে আসে।
ফরাসি ও ব্রিটনবাসী এখানে আসেন গ্রীষ্মের মৃদু বাতাস উপভোগ করতে। ওয়াইন ব্যবসায়ী হিউড সেইন্ট মালোর একজন বাসিন্দা হিসেবে তার সাথে সমুদ্রের সম্পর্কে বোঝানোর জন্য বলেন, “যখন আমি সেইন্ট মালোতে থাকি, তখন আমি সমুদ্রকে দেখতে না পারলেও তাকে অনুভব করতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “আমি জানি, সে (সমুদ্র) এখানে আছে বা আশেপাশে কোথাও আছে। আমি দূরে থাকলে, সে-ও দূরে আছে।”
আই’ইমারসন
আই’ইমারসন প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় আজ থেকে আরও ১৫ বছর আগে। আসলে সেবার এটা কোনো উৎসব নয়, বরং কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য করা হয়। বলছি সেইন্ট মালোর অতি পরিচিত ওয়াইন ব্যবসায়ী ইয়ানিক হিউড ও তার বন্ধুদের কথা। হিউড তার বন্ধুদের সাথে তাদের সবচাইতে আপন স্থান সমুদ্রের বুকে সময় কাটানোর জন্য যান। “আমাদের মধ্যে একজন মৎস্যজীবী, একজন নাবিক, একজন রেস্তোরাঁর মালিক আছেন এবং আমি নিজে একজন ওয়াইন ব্যবসায়ী। আামার একজন বন্ধুর সন্তান সেই সময়ে জন্ম নেয়। তার সন্তান জন্ম নেওয়ার খবর পেয়ে বিষয়টি আনন্দের সাথে উদযাপন করার জন্য সে কয়েকটি ওয়াইনের বোতল সমুদ্রের নিচে জমিয়ে রাখতে চায়।” হিউড তার এই পরামর্শে সম্মত হন এবং এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও নেন। তার কাছে এই কাজটা বেশ মজার এবং নতুন মনে হয়।
তার বক্তব্য অনুসারে, যারা ওয়াইনের প্রতি অনেক বেশি আকৃষ্ট তথা ‘ইনোফাইল’, তারা সাধারণত খুশির কোনো সংবাদ পেলে সেই বিষয়ে নিজেদের আনন্দ প্রকাশের জন্য ওয়াইনের বোতল জমা করে রাখেন।
তবে সমুদ্রের তলে এ ধরনের কাজ আগে দেখা যায়নি। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই উৎসব ছিল বেশ ছোট পরিসরে। সেইন্ট মালো বন্দরের লায়োর উপত্যকার মাত্র ১২টি ফিফস ভেনডিনস ওয়াইনের বোতল দিয়ে এর আরম্ভ হয়। হ্যাঁ! এটাই সেই আই’ইমারসন। বর্তমানে এটি জাতীয় পরিচিতি লাভ করেছে। ওয়াইনভক্ত ভিনদেশিরাও অনেক সময় এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে চলে আসে। তাদের ছোট আয়োজনটা ১৫ বছর আগে জুন মাসের প্রথম সাপ্তাহিক ছুটির দিন, তথা ১০ জুন সংঘটিত হয়। তাই এখনও প্রতি বছর শুধুমাত্র জুন মাসের প্রথম সাপ্তাহিক ছুটির দিন আই’ইমারসন পালিত হয়।
হিউড প্রতি বছর সমুদ্রে ওয়াইনের বোতল রাখার জন্য যাওয়া শুরু করেন। আর গত বছরে রেখে যাওয়া বোতলগুলো বের করে নিয়ে আসেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে সেই পুরনো ওয়াইন পান করা শুরু করেন। তাদের মনে হলো, সমুদ্রে রাখার কারণে ওয়াইনের স্বাদ কিছুটা বদলে গেছে এবং নতুন এই স্বাদটা খারাপ নয়। তবে এর কারণ প্রথমেই তারা ধরতে পারেননি। তারা যে বিষয়টিকে ওয়াইন পান করার নিছক এক সংস্কার মনে করছিলেন, তার স্বপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও দেওয়া সম্ভব। ব্রিটানির উপকূলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ৯-১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যা ওয়াইন তৈরির উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং সমুদ্রের প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটা ওয়াইন তৈরির বিশেষ কৌশল ‘রেমুয়েজ’ এর মতো। এ কারণে সমুদ্রতলে ওয়াইন প্রক্রিয়াজাত হতে থাকে। এ ধরনের ওয়াইন বিভিন্ন খাবারেও ব্যবহার করা হয়।
হিউড এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরে আরও আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে থাকেন। প্রতি বছর প্রায় ১০০ জন ওয়াইনের ব্যবসায়ী এবং ভক্তরা টিকেট কিনে এই উৎসব উদযাপন করতে যান। দিনের শুরুতে পর্যটকেরা হিউড ও তার দলকে প্রায় ৭০০টি ওয়াইনের বোতল ট্যুর সলিডর থেকে মাছ ধরার নৌকায় রাখতে দেখেন। এই ট্যুর সলিডর হলো ১৪ শতকে নির্মিত টাওয়ার, যা রান্স নদীতে প্রবেশের মূল ফটক। বোতলগুলো খড়ে ভরা শেলফিশের জন্য তেরি বক্সে করে রাখা হয়। বক্সগুলোতে কিছু ছিদ্র থাকে, যাতে সমুদ্রের পানি এবং সমুদ্র-শৈবাল আসা-যাওয়া করতে পারে। পর্যটকেরা গত বছর রেখে আসা পুরনো ওয়াইন পান করার সুযোগ পান। এরপর তারা সেইন্ট মালোর বসতিহীন এক উপকূলীয় স্থানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন।
হিউড এবং তার বন্ধুদের ছোট একটা আয়োজন যে এভাবে বিপুল পরিচিতি পাবে তা হয়তো তারাও কখনও ভাবেননি। তবে এটা যে সেইন্ট মালোকে বিশ্বের নিকট জনপ্রিয় করে দিয়েছে, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিচার ইমেজ: homeaway.co.uk