প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তর-উদারীকরণ ভারতের সবচেয়ে বড় আর্থিক সিদ্ধান্তটি নেন ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের ৮ তারিখে। জাতীয় টেলিভিশনে এসে আচমকা তিনি ঘোষণা করেন যে, ঐদিন মাঝরাত্তির থেকে দেশের ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হবে। নেতৃত্বের দাবি ছিল, এই আকস্মিক পদক্ষেপে কালো টাকার কারবারি এবং দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে এক মস্ত আঘাত নেমে আসবে। ওই দুই বড় নোট বাতিল হওয়া মানে দুর্জনদের নগদের কারবার নিমেষে লণ্ডভণ্ড হবে। কিন্তু সরকার পাশাপাশি নতুন নোট বাজারে ছাড়তে শুরু করবে যাতে সাধারণ মানুষ অসুবিধা ভোগ না করে।
সেই ঘোষণার প্রায় বাইশ মাস পরে ভারতের সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া বা আরবিআই তার বার্ষিক রিপোর্টে ঘোষণা করল যে, মোদীর ‘ডিমনিটাইজেশন’ বা নোটবন্দির সেই সিদ্ধান্তের পর বাতিল হয়ে যাওয়া নোটের ৯৯ শতাংশেরও বেশি অংশ ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, কালো টাকার কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।
সাধারণ মানুষ, যারা খেটে খান, তারা নিয়ম পালন করাতেই সব বাতিল নোট ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কের ঘরে। তাহলে, সেই সব দুর্নীতিবাজ বা উগ্রপন্থায় আস্কারা দেওয়া সংগঠনগুলোর কাছে থাকা নোটগুলির কী হলো? যদি তারাও সাধু সেজে নোট ফেরত দিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মোদী সরকারের কালো টাকার কারবারিদের হাতেনাতে পাকড়াও করার দাবীর কী হলো? সব কালো টাকাই নিমেষে সাদা হয়ে গেল?
সাম্প্রতিক সময়ে মোদীর নোটবন্দির মতো বিতর্কিত আর্থিক সিদ্ধান্ত শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তেই আলোড়ন ফেলেছে। একজন পপুলিস্ট নেতার মতো তিনি সহজে মানুষের বিশ্বাস কিনতে এই প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে, অসংখ্য মানুষ কাজ হারান, সাধারণ ঘরে বিয়ে-শাদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বিঘ্ন ঘটে, এমনকি টাকা তোলা বা বিনিময় করতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও ঘটে। এছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে নানা বাস্তবিক সমস্যার ব্যাপার তো রয়েছেই।
মোদীর কাছে নোটবন্দি ছিল এক রাজনৈতিক অস্ত্র
কিন্তু মোদীর কাছে এইসমস্ত বিবেচনা প্রধান ছিল না তখন। বেশ কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েই প্রধানমন্ত্রী এই গুরুতর সিদ্ধান্তটি নেন এবং একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে এক বড় সংখ্যক মানুষের সমর্থনও পেয়ে যান। মোদীকে খুবই ভাগ্যবান বলতে হবে যে তিনি এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েও মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েননি; উল্টো তার এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বিপাকে পড়ে বিরোধীরাই।
কী ছিল মোদীর অভিষ্ঠ লক্ষ্য?
প্রথমত, অবশ্যই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। ২০১৪ সালে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিপুল জয় পাওয়াটা যে কাকতালীয় ছিল না, সেটা প্রমাণ করতে মোদীর বিজেপিকে ২০১৭-র শুরুতে ঘটিত উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনেও ভালো করে দেখানো জরুরি ছিল। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বিজেপির অবস্থা যে খুব ভালো ছিল তা নয়। জাত-পাতের রাজনীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এই রাজ্যে বিরোধীদের হারাতে তাই মোক্ষম চাল হিসাবে করা হলো নোটবন্দি। ভারতে ভোট বৈতরণী পার করতে নোটের ভূমিকা অপরিসীম আর বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে তো আরও বেশি। অতএব, আচমকা এই আঘাত নেমে আসতে মুহূর্তে বিঘ্নিত হয় বিরোধীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি। সুবিধা হয় বিজেপির।
দ্বিতীয়ত, ২০১৫-র শুরুর দিকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারত সফরে এলে তার সঙ্গে দেখা করাকালীন মোদী তার নিজের নামাঙ্কিত স্যুট নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষের মুখে পড়েন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে বাজেট পাশের পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও প্রধানমন্ত্রীকে এই নিয়ে ব্যঙ্গ করেন; তার সরকারকে ‘স্যুট বুট কি সরকার’ বলেন।
যে মোদীর উত্থানের কাহিনীকে এক সামান্য চা-ওয়ালার উত্থানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে; যেই আবেদনের মধ্যে দিয়ে মোদী নিজেকে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, তাকে হঠাৎ ‘স্যুট বুট’-এর খোঁচা দিলে যে তিনি ফোঁস করে উঠবেনই, তাতে আর অস্বাভাবিক কী? পাশাপাশি ২০১৫ সালের শেষের দিকে বিহার রাজ্যেও নির্বাচনে হারে বিজেপি এবং বলা হতে থাকে যে মোদী ক্রমশই নিজের জমির থেকেই দূরে সরে যাচ্ছেন।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে এই সমস্ত অভিযোগের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল একান্তভাবেই আর মোদী সেটা করতেই বেছে নেন নোটবন্দিকে। আর তার এই প্রয়াস এতটাই সূক্ষ্মভাবে প্রয়োগ করা হয় যে, আর্থিক নীতির চেয়েও বেশি এক সামাজিক অবস্থান হিসেবে তা প্রভাব ফেলে জনমানসে।
মোদী উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি জনসভায় ভাষণ দেন এবং তাদের মধ্যে তার মোরাদাবাদের ভাষণটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই জনসভায় মোদী জনগণের সঙ্গে এক আবেগঘন যোগাযোগ স্থাপন করেন। বার বার এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে তিনি গরিবের পক্ষে; গরিবের ভালোর জন্যে এই পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন; তার ‘শত্রু’রা যদি এই সিদ্ধান্তের জন্যে তাকে শূলেও চাপায়, তিনি কাউকে ভয় পান না। মোদী এই অবকাশে মানুষকে এও বোঝান যে যারা সরকারি চোখরাঙানির ভয়ে তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিজেদের কালো পয়সা জমা করেছে, তাদের সে টাকা যেন আর ফেরত না দেওয়া হয়। তাতেই জব্দ হবে প্রকৃত অসাধু ব্যক্তিরা।
মোদীর এই কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করে। সাধারণ মানুষ এমনিতেই রোজকার দুর্নীতি নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এবারে ভাবতে শুরু করে- এই তো একজন নেতা এসেছেন যিনি সেই দুষ্টচক্রদের শায়েস্তা করার এক মনমতো পথ বাতলে দিয়েছেন। অতএব, তার সমর্থনে আমরা রয়েছি!
এক ঢিলে অনেক পাখি মারার কৌশল
মোদী ভারতের রাজনীতিতে এক অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছেন সে কথা অনস্বীকার্য। গরিবের পাশে থাকার হুঙ্কার অতীতে ইন্দিরা গান্ধীও ছেড়েছিলেন এবং তাতে তিনি লাভবানও হয়েছিলেন, কিন্তু মোদী শুধু গরিবের আশীর্বাদ ধন্য হলেন তা-ই নয়, পাশাপাশি তিনি এমন এক ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন যে তার নিজের সমর্থন তো অটুট রইলই, পাশাপাশি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাণ্ডারী, অর্থাৎ অনলাইন কারবারিদের পথটিও প্রশস্ত করলেন এবং বিরোধীদেরও কোমর ভাঙলেন। এই এক ঢিলে এতগুলি পাখি মারার নিদর্শন ভারতীয় রাজনীতিতে শেষ কবে দেখা গিয়েছে তা মনে করা মুশকিল।
অর্থনীতি কারও পায়ের ভৃত্য নয়, সে প্রতিশোধ নেবেই
কিন্তু, অর্থনীতির নিজস্ব দেমাগ রয়েছে। রাজনীতি মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, উঠতি বিশ্বের অনেক দেশের শাসকরাই নানা সময়ে অর্থনীতিকে পায়ের ভৃত্য বানাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন। যেহেতু অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান, তাকে ‘ম্যানিপুলেট’ করার চেষ্টা করলে সে পাল্টা আঘাত দেবেই। আর সেটাই হয়েছে নোটবন্দির ক্ষেত্রে। মোদী উত্তরপ্রদেশে উতরে গিয়েছেন, নিজের সমর্থনটিকে পোক্ত করেছেন কিন্তু ২২ মাস পরে যখন পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে, তখন দেখা গিয়েছে যে তার এত পরিশ্রম আদতে দেশের কোনো কল্যাণে আসেনি।
নোটবন্দির সিন্ধান্ত মোদীর আর পাঁচটা সিদ্ধান্তের বা কর্মকাণ্ডের মতোই দেশের মধ্যে মেরুকরণ বাড়িয়েছে। কেউ কেউ এখনও বলছেন সিদ্ধান্তটির মধ্যে গলদ কিছু ছিল না, কেউ বলছেন এ এক সম্পূর্ণ ধাপ্পাবাজি কোটিপতি বন্ধুদের সাহায্য করার জন্যে।
উচ্চমহলে এই নিয়ে কী চর্চা চলছে জানি না, কিন্তু যে প্রান্তিক ঘরের মেয়েটির বাবা তার আদরের কন্যার বিয়ে দিতে গিয়ে হেনস্থা হলেন; যে সামান্য ব্যবসায়ী মেরামতির অসাধ্য লোকসানের সম্মুখীন হলেন; যে বিধবা তার ঘরের খুঁটিতে বাঁধা সামান্য কয়েকটি সাশ্রয় করা টাকা হারালেন অথবা যে বৃদ্ধ দীর্ঘক্ষণ টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রাণটিই হারালেন, তাদের হয়ে সওয়াল আজ কে তুলবে?
Featured Image Source: