৯৫ বছর আগে, জাপানের এক বেলবয় বা পত্রবাহককে দুটো টিপস দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। দুটো মাত্র উপদেশ বাণী লেখা ছিল সে কাগজ দুটিতে, যার মধ্যে একটির সারাংশ হলো-
‘ভদ্র-সভ্য জীবনযাপন করো’
গত মঙ্গলবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে এই চিরকুটটি একটি নিলামে বিক্রি হয়েছে পাক্কা দেড় মিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশী টাকার হিসাবে তা প্রায় ১২ কোটি ৪২ লাখ টাকারও বেশি!
১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে আইনস্টাইন যাচ্ছিলেন জাপানে। সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি লেকচার দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাকে। পথিমধ্যে একটি টেলিগ্রাফের মারফত খবর আসে তার কাছে, ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। প্রখ্যাত এই পদার্থবিদের কাছে কখনো দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়া তত্ত্বের অভাব না হলেও, তরল টাকার বেশ ভালোই অভাব ছিল। কাজেই ছোট্ট যে বালকটি টোকিওতে ইম্পেরিয়াল হোটেলের কক্ষে এমন খুশির একটি সংবাদ তার হাতে তুলে দিলেন, তাকে একটু খুশি করার মতো উপঢৌকন বা অর্থ কোনোটাই দেয়ার সামর্থ্য সেই মুহূর্তে আইনস্টাইনের ছিল না।
তাৎক্ষণিকভাবে বেলবয়কে কী টিপস দেয়া যায় তা ভাবতে গিয়ে আইনস্টাইন লিখে ফেলেন বেশ জ্ঞানগর্ভ দুটি চিরকুট। বখশিশের পরিবর্তে টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলের ছাপ দেয়া এক কাগজের ওপর ছোট্ট নোট দুটি লিখে তাতে সই করেন। গাল উইনার, নিলাম প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, নিজের খ্যাতির বিস্তৃতি উপলব্ধি করে ছেলেটিকে তিনি বলেছিলেন কাগজ দুটো যত্ন করে রেখে দিতে। আপাতদৃষ্টিতে এটি দু’টুকরো কাগজ ছাড়া আর কিছু মনে না হলেও, অদূর ভবিষ্যতে তা সাধারণ টিপসের তুলনায় বেশ ভালো দামেই বিকোবে এ কথা ছেলেটিকে জানিয়ে দেন তিনি। সে কথাই যেন প্রায় শতবর্ষ পরে বাস্তবে রূপ নিল উইনার আয়োজিত জেরুজালেমের এক নিলামে।
বড় যে নোটটি তিনি লিখেছিলেন, সেটি ‘হ্যাপিনেস লেটার’ বা ‘সুখের চিঠি’ নামেই বহুল পরিচিত। সেখানে লেখা আছে-
‘অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সাফল্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে যে খুশি তোমার হাতে ধরা দেয়, তারচেয়ে সাধারণভাবে, ভদ্র-সভ্যভাবে যাপিত একটি জীবন বেশি খুশি বয়ে আনতে পারে।’
জার্মান ভাষায় চিঠিটি ছিল অনেকটা এরকম-
“Stilles bescheidenes Leben gibt mehr Glueck als erfolgreiches Streben, verbunden mit bestaendiger Unruhe.”
এই সুখবরটি যেন দাবানলের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আইনস্টাইন জাপানে পৌঁছানো মাত্রই তাকে বরণ করে নেন সবাই। আজ এত বছর পর যেন তারই প্রতিফলন ঘটল উইনার আয়োজিত এই নিলামে। চিরকুটটি নিলামে ওঠার পর বিক্রি হতে সময় লাগে মাত্র ২৫ মিনিট। অজ্ঞাতনামা কোনো এক খেয়ালি ধনী পাক্কা ১৫,৬০,০০০ ডলার দিয়ে কিনে নেন এটি। সঙ্গে ক্রেতার প্রিমিয়াম হিসেবে আরও বাড়তি কিছু খরচাপাতি করতে হয়েছে তার।
বেলবয়কে দেয়া অপর একটি নোটে তিনি লিখেছিলেন চিরায়ত এক বাণী-
‘ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়’
জার্মান ভাষায় লেখাটি ছিল এরকম:
“Wo ein Wille ist, da ist auch ein Weg.”
আরেক অজ্ঞাতনামা ক্রেতা এই চিরকুটটি কিনে নিয়েছেন ২,৪০,০০০ ডলারের বিনিময়ে। এক্ষেত্রেও ক্রেতার চার্জ স্বরূপ প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিলাম কর্তৃপক্ষ। দুটি চিরকুটেই আইনস্টাইনের তারিখ সহ স্বাক্ষর বিদ্যমান। কর্তৃপক্ষ জানান, নোবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ডাক পেয়েও সেখানে যাননি আইনস্টাইন। জাপানের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে স্টকহোমকে বিদায় বলে দিয়েছিলেন তিনি। সে বছর ডিসেম্বরে স্বশরীরে হাজির থেকে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেননি বলেই জানা গেছে।
নিলামে চিরকুট দুটির দর হাঁকা হয়েছিল ২,০০০ ডলার করে। মাত্র মিনিটের মধ্যে সেই দর দেড় মিলিয়নে গিয়ে ঠেকলে বিস্মিত হয়ে যান কর্তৃপক্ষও। চিরকুট দুটির নিলাম পূর্ব অনুমিত মূল্য ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার ডলার। ক্রেতাদের কারো পরিচয় জানতে না পারায় আফসোস করেন উইনার। তবে তাদের গোপনীয়তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোনো ধরনের খোঁজও চালাননি উইনার। নিলামে উপস্থিত এক খদ্দেরের মতে, ক্রেতাদের একজন ছিলেন ইউরোপিয়ান। অবশ্য সেই পত্রবাহক ছেলেটির হাত থেকে উইনারদের হাতে কীভাবে চিরকুট দুটি এসে পৌঁছাল, সে বিষয়েও মুখ খোলেননি তারা। আইনস্টাইনের নোট দুটি এত দিন ছিল জার্মানির হামবুর্গের এক ব্যক্তির কাছে। নোটটি সেই বেলবয়ের ভাতিজা উইনারদের কাছে বিক্রি করেছেন বলেও গুজব রটেছে।
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আইনস্টাইন। তিনি তার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, ব্যক্তিগত পেপার সব দান করে দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির কল্যাণে। পরবর্তীতে ইজরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন আইনস্টাইন। ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন মহান এই পদার্থবিদ।
নিলাম শেষে উইনার এএফপিকে দেয়া এক বিবৃতিতে জানান,
“এখনো যে বিজ্ঞান, ইতিহাসের পাশাপাশি মানবতা, সুখের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধান করার মতো আগ্রহী মানুষ বেঁচে আছে, জেনে খুব ভালো লাগছে। নাম না জানিয়েও নিজের পরিচয় ঠিকই তুলে ধরেছেন এই ক্রেতা।”
জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। শুধু বিজ্ঞানী হিসেবেই নয়, চিন্তাবিদ হিসেবেও তিনি বাস্তবিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নানা জিনিস নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। তারা পুরো শৈশব আর কৈশোরটাই তো ছিল এমন দারুণ সব চিন্তাভাবনায় ঘেরা। আইনস্টাইন আর কম্পাসের গল্পটি হয়তো অনেকেরই জানা। আইনস্টাইনের বয়স যখন বছর পাঁচেক, তখন অসুস্থ হয়ে একবার শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। সময় কাটানোর জন্য বা ছেলের সাথে গল্পচ্ছলেই বাবা তাকে দেখালেন একটি ছোট পকেট কম্পাস। ছোট্ট আইনস্টাইন সেটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ আর বিস্মিত হয়ে যায়। যন্ত্রটি যে দিকেই ঘোরানো হোক না কেন, কম্পাসের কাঁটা ঠিক উত্তরমুখী হয়ে স্থির হয়ে যায়। তার বারবার মনে হতে থাকে, নিশ্চয়ই কোনো অজানা রহস্যময় শক্তি কম্পাসটিকে একদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। তার শিশুমনে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তৎক্ষণাৎ- স্কুলের পড়া এতো তেতো লাগে কেন? সেদিনের সেই ছোট শিশুটিই কালক্রমে বের করে ফেলে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মতো যুগান্তকারী এক তত্ত্ব।
জীবন সম্পর্কে বেলবয়টিকে উপদেশ দেয়ার পিছনে তার নিজের চিন্তাধারার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। মাত্র ষোল বছর বয়সেই নিজেকে তিনি জাতীয়তার উর্ধ্বে বসবাসকারী এক মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। তাই তো সে সময়ে তিনি জার্মানির নাগরিকত্ব অস্বীকার করে নিজেকে ‘বিশ্বনাগরিক’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯০১ সালে সুইডেনের নাগরিকত্ব পাওয়ার আগ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই তিনি একজন রাষ্ট্র পরিচয়বিহীন মানুষ ছিলেন। নিজেকে সুখী মানুষ ভাবতেন বলেই হয়তো এই জাতি-সীমানার ব্যাপারগুলো কখনোই তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠেনি।
১৮৯৫ সালে, মাত্র সতের বছর বয়সে সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তির জন্য আবেদন করেন তিনি। গণিত আর বিজ্ঞান বাদে বাকি সব বিষয় অর্থাৎ ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ভূগোল সবকিছুতে ফেল করেন সর্বকালের সেরা এই বিজ্ঞানী। বাধ্য হয়ে এক বছর ট্রেড স্কুলে কাটিয়ে পরেরবার আবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হন পলিটেকনিক্যাল স্কুলে। এরপর সারা জীবন নানা ধরনের বিচিত্র সব ঘটনার জন্ম দিয়ে সব সময় থেকেছেন মানুষের মুখে মুখে। একমাত্র মেয়ে ক্লাসমেটকে বিয়ে করা, এফবিআইয়ের ফাইলে নিজের নামে ১,৪২৭ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্টের হদিস পাওয়া, স্ত্রীকে তিন বেলা যথা সময়ে নিজের ঘরে খাবার হাজির করা থেকে শুরু করে তার জামাকাপড় জায়গা মতো রেখে দেয়া, চুপ করতে বললেই থেমে যাওয়ার মতো অদ্ভুত সব শর্ত জুড়ে দেয়া, নোবেল পুরস্কারের অর্থ প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার পেছনে ব্যয় করা, রাশিয়ান এক গোয়েন্দার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, বাইরে বেরিয়ে কখনও কখনও বাড়ি ফেরার পথও হারিয়ে ফেলা- কী না করেছেন তিনি! ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক ‘শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে মনোনীত হন তিনি, যদিও তা দেখার জন্য তখন আর বেঁচে ছিলেন না আইনস্টাইন।
আইনস্টাইনকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি এমন এক ব্যক্তি যার নাম এখনো পর্যন্ত শিক্ষক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবার মুখে সবচেয়ে বেশি বার উচ্চারিত হয়েছে বলে জানা যায়। কখনো গুজব, কখনো আবিস্কার, কখনো বা খামখেয়ালিপনা তাকে সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত মানুষদের মধ্যে একজন হিসেবে পরিগণিত করেছে। আজ তার মৃত্যুর ৬২ বছর পরেও মাত্র দু’লাইনের দুটি নোট তাকে আবারও যেন সবার সামনে নতুন করে হাজির করে দিল। আত্মভোলা হিসেবে বিজ্ঞানীদের যতই দুর্নাম থাকুক না কেন, জীবনকে তারাও উপভোগ করেন নিজের মতো করে। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় এই কথা যেমন আইনস্টাইন মানতেন, ঠিক তেমনি ধরাবাঁধা জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে সাফল্যের পিছনে না ছুটে একটি সাধারণ জীবনযাপন করাও তার ব্যক্তিগত জীবনাদর্শেরই একটি অংশ ছিল যা তিনি ভাগ করে নেন ছোট সেই বেলবয়ের সাথে।