ইন্টারনেটে ‘খাঁটি হৃদয়ের মানুষ’ শিরোনামটি লিখে খুঁজলে যে মানুষটির ছবি আসে, আবার ‘বলিউডের ব্যাড বয়’ শিরোনাম লিখে খুঁজলেও কিন্তু একই মানুষ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। পুরো ভারতবর্ষে তিনি ‘ভাইজান’ নামে সমধিক পরিচিত, আবার তাকে নিয়ে নানা সময়ে উঠে আসা বিভিন্ন রকম বিতর্কেরও কোন কমতি নেই। তার চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলে ভক্তদের মধ্যে যেমন একধরনের উৎসব শুরু হয়ে যায়, ঠিক তেমনি নানা সময়ে আদালতের কাঠগড়ার সাথে তার পরিচয়টাও বেশ পুরনো। বলিউডের তুমুল জনপ্রিয় ব্যবসা সফল সিনেমার নায়ক, রহস্যময় ব্যক্তিত্ব সালমান খানের কথা বলছি।
১৯৯৮ সালের বেআইনি অস্ত্র মামলা, একই সালের কৃষ্ণসার হরিণ এবং চিংকারা হত্যা মামলা, ২০০২ সালের ‘হিট অ্যান্ড রান’ মামলাসহ বেশ কিছু কারণে আদালতের সাথে তার পরিচয়টা প্রায় বিশ বছর ধরে। বিভিন্ন সময়ে তিনি আইনি লড়াই লড়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে অব্যহতিও পেয়েছেন। সম্প্রতি যোধপুর জেলা এবং দায়রা জজের আদালতে বিশ বছর আগের ‘কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা’ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং দশ হাজার রুপি আর্থিকভাবে জরিমানা করা হয়েছে। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা যোধপুর কারাগারে ‘কয়েদি নম্বর ১০৬’ হিসেবে কাটানোর পর দ্রুততম সময়ে তিনি জামিনও পেয়েছেন। বিশ বছরের পুরনো এই মামলার বিভিন্ন সময়ের বিচার প্রক্রিয়ায় আছে নানা রকম উত্থান-পতন। আজকের আয়োজন নাটকীয়তা এবং উত্তেজনায় ভরা এই ‘কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা মামলা’ এবং এই মামলায় সালমানের অবস্থান নিয়েই।
কী ঘটেছিল সেই রাতে
অক্টোবর, ১৯৯৮। বলিউডের ‘হ্যাম সাথ সাথ হ্যাইন’ চলচিত্রের চিত্রায়ন চলছিল রাজস্থানে। অক্টোবরের ২ তারিখে রাত আনুমানিক দেড়টায় যোধপুরের কানকানি গ্রামের বাসিন্দা পুনমচান্দ বিশনোই হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে তার বাড়ির পাশের ভাঙ্গা রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনতে পান। মনে সন্দেহ জন্ম নিলে তিনি তার প্রতিবেশী বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাইকে বিষয়টি অনুসন্ধানে বের হন।
গাড়িটির কাছে গেলে তারা আবিষ্কার করেন, গাড়িটিতে চলচ্চিত্র জগতের পরিচিত কয়েকজন মানুষ বসে আছেন। তারা সিনেমায় মানুষগুলোকে দেখেছেন অনেকবার। জিপ্সি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন অভিনেতা সালমান খান, তার পাশের আসনটিতে বসে ছিলেন আরেক বলিউড তারকা সাইফ আলি খান। পিছনের আসনে ছিলেন আরও তিন বলিউড তারকা সোনালি বেন্দ্রে, টাবু ও নীলম এবং আরও দুজন পথ প্রদর্শক। একপর্যায়ে পিছনের আসন থেকে কেউ একজন সালমানকে একটি বন্দুক দেন এবং সালমান খান পরবর্তীতে দুটি গুলিতে একটি কৃষ্ণসার হরিণ এবং একটি চিংকারা আহত করেন।
পুনমচান্দ এবং তার বন্ধু বাইকে করে তাদের ধাওয়া করলে গাড়িটি বেশ দ্রুততার সাথে মৃত হরিণ এবং চিংকারাটি রেখে পালিয়ে যায়। পরের দিন সকালে পুনমচান্দ এবং তার প্রতিবেশী গ্রামবাসীরা সবাই মিলে বন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করেন এবং এলাকাটি ‘পশুপাখির জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকা’ বিধায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
বিশনোই সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মদর্শন
বিশনোই হলো রাজস্থানের একটি প্রাচীন ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়। পঞ্চদশ শতকের দিকে বিকানেরের ধর্মগুরু জম্ভেশ্বর এই সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মটির মূল স্তম্ভ হিসেবে তিনি প্রকৃতি ও প্রাণী রক্ষা ও ধর্মাচরণের জন্য ২৯টি বিধান দেন। মূলত এই ২৯টি অর্থাৎ ২০+৯টি বিধান মেনে চলার ধর্মীয় অনুশাসন থেকেই এই সম্প্রদায়ের অনুগামীরা ‘বিশনোই’ নামে পরিচিত।
যেকোনো ধরনের প্রাণীহত্যা করা এবং বৃক্ষচ্ছেদন বিশনোই সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ধর্মীয় গুরুর কথামত এই ধরনের কাজ তাদের ধর্মের নীতি অনুসারে সরাসরি গুরুতর পাপ বলে গণ্য করা হয়। এই সম্প্রদায়ের সবাই পুরোপুরি নিরামিষাশী, কোনো প্রাণীর মাংস তাদের জন্য নিষিদ্ধ এবং তারা কখনো মাংস ছুঁয়েও দেখেন না। এমনকি কোনো হরিণ শাবক যদি তার মা হরিণকে হারায় তবে একজন বিশনোই মা বাচ্চা হরিণ শাবকটিকে নিজের বুকের দুধ দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না!
চোখের সামনে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার বিষয়টি মূলত তারা ধর্মীয়ভাবে মেনে নিতে পারেননি। বিষয়টিকে তারা তাদের ‘ধর্মীয় মর্যাদার উপরে এক আঘাত’ হিসেবে সবসময় বিবেচনা করেছেন। ঠিক এ কারণেই সালমান খান প্রবল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন তারা। সেই ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর ধরে সমান তালে এই মামলায় আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
মামলার বিচার প্রক্রিয়া
এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ার রয়েছে প্রায় ২০ বছরের ইতিহাস-
- ১২ অক্টোবর, ১৯৯৮: বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী ‘কৃষ্ণসার হরিণ এবং চিংকারা’ হত্যার অভিযোগে তারকা সালমান খানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তিনি জামিন পেয়ে যান।
- ১০ এপ্রিল, ২০০৬: বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইনের আওতায় এই মামলার বিচারের রায় দেয়া হয়। সালমান খানের পাঁচ বছরের সাজা ঘোষণা করা হয় এবং তাকে পঁচিশ হাজার টাকার আর্থিক জরিমানাও করা হয়।
- ৩১ আগস্ট, ২০০৭: রাজস্থান উচ্চ আদালতের রায়ে সালমানের পাঁচ বছরের কারাবাসের রায় বহাল রাখা হয়। এক সপ্তাহ তিনি যোধপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবাস করার পরে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই রায় স্থগিত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
- ২৪ জুলাই, ২০১২: রাজস্থান উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ সকল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জ দাখিল করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই মামলায় অভিযুক্ত সবার বিচার প্রক্রিয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।
- ৯ জুলাই, ২০১৪: উচ্চ আদালত রাজস্থান সরকারের অনুরোধে আগের প্রত্যাহার করা অস্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে এক অভিযোগ দায়ের করে। ফলশ্রূতিতে সালমানের বিরুদ্ধে আদালত থেকে একটি নোটিশ পাঠানো হয়।
- ২৫ জুলাই, ২০১৬: রাজস্থান উচ্চ আলালত সালমান খানকে ১৯৯৮ সালের কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। আদালতের তরফ থেকে বলা হয়, আদালতের সামনে ‘সালমানের নিবন্ধন করা অস্ত্র থেকে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা করা হয়েছে’ এমন কোনো প্রমাণ নেই।
- ১৯ অক্টোবর ২০১৬: রাজস্থান সরকারের তরফ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই অব্যাহতি নিয়ে আপিল করা হয়।
- ১১ নভেম্বর, ২০১৬: দেশের সর্বোচ্চ আদালত কৃষ্ণসার হরিণ এবং চিংকারা হত্যার মামলা দুটি দ্রুত নিস্পত্তির জন্য নির্দেশ প্রদান করে।
- ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭: এক বিবৃতিতে সালমান খান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তার আইনজীবী আগে প্রমাণ দাখিল করার কারণে নতুন করে কোনো ধরনের প্রমাণ দাখিলে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, পূর্বে দাখিল করা প্রমাণের ভিত্তিতে সালমান খান এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। ঐ বছরের মার্চ মাসের এক তারিখ থেকে এই মামলার শুনানি শুরুর আদেশ প্রদান করা হয়।
- ২৮ মার্চ, ২০১৮: আদালতে চূড়ান্ত যুক্তি উত্থাপন সম্পন্ন হয়। প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দেব কুমার চূড়ান্ত রায় প্রদান কাজটি সংরক্ষণ করেন।
- ৪ এপ্রিল, ২০১৮: ‘হ্যাম সাথ সাথ হ্যায়’ চলচ্চিত্রের কলাকুশলী সালমান খান, সাইফ আলি খান, সোনালি বেন্দ্রে, নীলম কোথারি এবং টাবু যোধপুর পৌঁছান।
- ৫ এপ্রিল, ২০১৮: বিচারিক রায়ে সালমান খানের ‘পাঁচ বছরের জেল এবং দশ হাজার রুপি’ আর্থিক জরিমানা করা হয়। তাকে যোধপুর কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার অন্যরা খালাস পান।
- ৬ এপ্রিল, ২০১৮: আদালত সালমান খানের জামিন আবেদন গ্রহণ করে। পরের দিন জামিনের সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য নির্ধারিত হয়।
- ৭ এপ্রিল, ২০১৮: প্রায় দুদিন কারারুদ্ধ থাকার পর সালমান খান জামিনে ছাড়া পান। জামানত হিসেবে তাকে ২৫ হাজার রুপির দুটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে হয়।
সালমান খানকে কারাগারে পাঠানো হলে গোটা ভারতসহ ইন্টারনেট দুনিয়া মূলত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে আইনের শাসন বাস্তবায়ন, অন্যদিকে সালমান খানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। ফেসবুক, টুইটারে আলোচনার ঝড় উঠে। বিশনোই সম্প্রদায়সহ সমাজের একপক্ষ থেকে বলা হয়–
“এই রায়ের মাধ্যমে আইন যে সবার জন্য সমান এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে।”
অন্যদিকে, বলিউডের একাংশসহ সালমান ভক্তদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়–
“সালমান খান তার তারকাখ্যাতির স্বীকার। তিনি নির্দোষ।”
তারা বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আহ্বান জানাচ্ছেন। আবার অনেকে বলছেন-
“সালমান অন্য কারও দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন।”
এখন দেখার বিষয়, বিশ বছরের এই পুরনো মামলায় ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। সালমান কি আসলেই দোষী, নাকি অন্য কারও দোষ তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন- ভবিষ্যতই এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
ফিচার ইমেজ- Indian Express