ওয়াগনার গ্রুপ একটি বহুল আলোচিত রুশ মার্সেনারি সংগঠন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই সংগঠনটি ইউক্রেন, সিরিয়া, সুদান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, লিবিয়া, মোজাম্বিক, মালি এবং আরো কয়েকটি রাষ্ট্রে রুশ সরকারের হয়ে নানাবিধ সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। ২০২২ সালে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীকে পরাজিত করে সোলেদার ও আর্তিয়োমভস্ক (বাখমুৎ) শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। কয়েকদিন আগেও ওয়াগনার গ্রুপকে রুশ সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু গত ২৪ জুন ওয়াগনার গ্রুপ বিদ্রোহ করে এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে আলোড়নের সৃষ্টি করে।
বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বেশ কিছুদিন ধরেই ওয়াগনার গ্রুপ ও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো। ওয়াগনার গ্রুপের নিয়ন্ত্রক রুশ ধনকুবের ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন বেশ কয়েকবার ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অভিযোগ করেন যে, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়াগনার গ্রুপকে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ করছে না এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য যুদ্ধে নিহত হচ্ছে। তিনি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুদ্ধ পরিচালনার ধরনেরও কঠোর সমালোচনা করেন। এসবের জন্য তিনি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর্মি-জেনারেল সের্গেই শোইগু ও রুশ সশস্ত্রবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ আর্মি-জেনারেল ভালেরি গেরাসিমভকে দায়ী করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আনয়ন করেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়াগনার গ্রুপের প্রভাব সীমিত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। ইতিপূর্বে ওয়াগনার গ্রুপের রুশ কারাগারগুলো থেকে যোদ্ধা রিক্রুট করার যে সুযোগ ছিল, সেটি তারা বন্ধ করে দেয়। ২০২৩ সালের জুনের মাঝামাঝি তারা নির্দেশ দেয় যে, ১ জুলাইয়ের আগে ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যদেরকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। প্রিগোঝিন এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন, কারণ এই নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে ওয়াগনার গ্রুপের ওপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হতো এবং প্রিগোঝিনের প্রভাব হ্রাস পেতো।
২৩ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিও বার্তায় প্রিগোঝিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের জন্য রুশ সরকার যে যৌক্তিকতাগুলো দেখিয়েছিলো সেগুলোকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি দাবি করেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু রুশ ধনকুবেরদের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি পুতিন ও রুশ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে এই যুদ্ধ শুরু করিয়েছেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনে রুশ ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য গোপন করছে। এরপর তিনি ওয়াগনার গ্রুপের একটি ঘাঁটির ওপর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ পরিচালনার দায়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে অভিযুক্ত করেন, কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় উক্ত অভিযোগ অস্বীকার করে। অবশ্য প্রিগোঝিনের এই দাবির কোনো প্রমাণও ছিল না। এমতাবস্থায় প্রিগোঝিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের ঘোষণা দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার ইউক্রেনীয় সীমান্তবর্তী রোস্তভ প্রদেশে প্রবেশ করে এবং প্রদেশটির রাজধানী রোস্তভ শহরে অবস্থিত রুশ সশস্ত্রবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক জেলার সদর দপ্তরসহ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী কর্নেল-জেনারেল ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভ রোস্তভে প্রিগোঝিনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের আলোচনা ব্যর্থ হয়। ওয়াগনার গ্রুপ ভরোনেঝ প্রদেশের সামরিক স্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং তাদের সামরিক বহর ক্ষিপ্রগতিতে রাজধানী মস্কো অভিমুখে অগ্রসর হয়। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন একে ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং দমন করার নির্দেশ দেন। রুশ ন্যাশনাল গার্ড মস্কোর নিকটে ওয়াগনার গ্রুপকে বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় এবং রুশ ন্যাশনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত চেচেন আখমাৎ স্পেশাল ফোর্সেস ইউনিটকে রোস্তভ অভিমুখে প্রেরণ করা হয়।
রুশ বিমানবাহিনী অগ্রসরমান ওয়াগনার গ্রুপ বহরের ওপর সীমিত মাত্রায় বোমাবর্ষণ করে, কিন্তু এর বাইরে রুশ সশস্ত্রবাহিনী বা ন্যাশনাল গার্ড ওয়াগনার গ্রুপের অগ্রযাত্রায় কোনো ধরনের বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকে। ওয়াগনার গ্রুপের অগ্রযাত্রা চলমান থাকা অবস্থাতেই প্রিগোঝিন রুশ সরকারের সঙ্গে এবং বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু পুতিন সরাসরি প্রিগোঝিনের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং তার পরিবর্তে রুশ রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের চিফ অফ স্টাফ আন্তন ভায়নো, রুশ নিরাপত্তা পরিষদের সচিব নিকোলাই পাত্রুশেভ ও বেলারুশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত বোরিস গ্রিজলভ প্রিগোঝিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। অবশেষে বেলারুশীয় রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় রুশ সরকার ও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে একটি সমঝোতা স্থাপিত হয়। সমঝোতা অনুযায়ী ওয়াগনার গ্রুপের মস্কোমুখী অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়, প্রিগোঝিন ও ওয়াগনার গ্রুপের একাংশ বেলারুশে চলে যায় এবং রোস্তভ ও ভরোনেঝে মোতায়েনকৃত ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। বিনিময়ে রুশ সরকার ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদেরকে শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৯৯৩ সালের রুশ সাংবিধানিক সঙ্কটের পর এটি ছিল রাশিয়ায় সংঘটিত প্রথম অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। রুশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেল ফাইটার-বম্বারের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, এই সংঘাত চলাকালে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা রুশ বিমানবাহিনীর একটি ইল-২২এম এয়ারবোর্ন কমান্ড-সেন্টার বিমান, তিনটি মি-৮এমপিটিআর-১ ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার হেলিকপ্টার, একটি মি-৮ ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার, একটি মি-৩৫ অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও একটি কা-৫২ অ্যালিগেটর অ্যাটাক হেলিকপ্টার ধ্বংস করে এবং এর ফলে অন্তত ১৩ জন রুশ বৈমানিক নিহত হয়। তদুপরি, সংঘাতের প্রারম্ভে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের হাতে দুইজন রুশ সীমান্তরক্ষী নিহত হয়। অন্যদিকে, সংঘাত চলাকালে রুশ এয়ারস্ট্রাইকের ফলে ওয়াগনার গ্রুপের অন্তত পাঁচটি সামরিক যান ধ্বংস হয়।
বিদ্রোহের সম্ভাব্য কারণ
ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্লেষক বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ এর জন্য প্রিগোঝিনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দায়ী করেছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, প্রিগোঝিন রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের স্বার্থে কাজ করছিলেন। আবার কেউ কেউ এমনটা ধারণা করছেন যে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল পুতিনের একটি সাজানো নাটক এবং পুতিন তার নিয়ন্ত্রিত সেইন্ট পিটার্সবার্গ চক্রের ক্ষমতার প্রতি শোইগু–গেরাসিমভের নিয়ন্ত্রিত মস্কো চক্রের ক্ষমতাকে সম্ভাব্য হুমকিকে নির্মূল করার জন্য প্রিগোঝিনকে ব্যবহার করে এই ঘটনা মঞ্চস্থ করেছেন।
কার্যত ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের কোনো ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। প্রিগোঝিন পুতিন বা রুশ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। কার্যত তিনি তার ভিডিও বার্তাগুলোতে পুতিনের নাম নেয়া থেকেই বিরত থেকেছেন। পুতিন একে সশস্ত্র বিদ্রোহ আখ্যা দেয়ার পরেও প্রিগোঝিন নিজে কেবল এটুকুই বলেছেন যে, পুতিন ভুল করছেন এবং ওয়াগনার গ্রুপ পুতিনের কথায় অস্ত্র সমর্পণ করবে না। ওয়াগনার গ্রুপের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু ও চিফ অফ জেনারেল স্টাফ গেরাসিমভকে অপসারণ করা। কিন্তু যদি তারা মস্কো দখল করে নিতে সক্ষম হতো, সেক্ষেত্রে তারা কেবল শোইগু ও গেরাসিমভকে অপসারণের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতো, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, এসব ঘটনাকে একটি নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায়। ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আপাতদৃষ্টিতে পুতিনের অনুগত ধনকুবের প্রিগোঝিন সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে শুরুর আগে তিনি ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করতেন এবং এমনকি যারা তাকে ওয়াগনার গ্রুপের নিয়ন্ত্রক বলে দাবি করতো তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও দায়ের করতেন। অন্যদিকে, রুশ সরকারও ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা কখনো স্বীকার করতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর রুশ সরকার ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যাপক হারে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এমতাবস্থায় প্রিগোঝিন প্রথম বারের মতো ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপ বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে এবং এর ফলে যুদ্ধের সমর্থক রুশদের একাংশের মধ্যে ওয়াগনার গ্রুপের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বিশেষত ২০২২ সালে খারকভ ও খেরসন থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের পর যুদ্ধের সমর্থক রুশদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নিকট রুশ সশস্ত্রবাহিনী দুর্বল হিসেবে এবং রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অকর্মণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হতে থাকে। এর বিপরীতে সোলেদার ও আর্তিয়োমভস্কে (বাখমুতে) ওয়াগনার গ্রুপের সাফল্য সংগঠনটির ও প্রিগোঝিনের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধি করে। প্রথম বারের মতো প্রিগোঝিন রুশ অভিজাতদের মধ্যে একটি শক্তিশালী অবস্থান লাভ করেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও অভিজাতদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি নিজে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিভিন্ন ধরনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যুদ্ধ শেষে ওয়াগনার গ্রুপকে ইরানি ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর মতো একটি আদর্শভিত্তিক সৈন্যদলে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন।
কিন্তু রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়াগনার গ্রুপের ক্রমবর্ধমান প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে এবং সম্প্রতি রুশ সশস্ত্রবাহিনী পশ্চিমা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর আক্রমণাভিযান রুখে দিয়ে যুদ্ধের সমর্থক রুশদের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেতে শুরু করে। এর ফলে ওয়াগনার গ্রুপ ও প্রিগোঝিনের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তদুপরি, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রিগোঝিনের হাত থেকে ওয়াগনার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে। সর্বোপরি, প্রতীয়মান হয় যে, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ওয়াগনার গ্রুপের এই দ্বন্দ্বে পুতিন শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে সমর্থন করেন। রুশ সূত্রগুলোর ভাষ্যমতে, প্রিগোঝিন বেশ কিছুদিন যাবৎ পুতিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। এটি সম্ভব যে, প্রিগোঝিন আশঙ্কা করছিলেন, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে রাজনৈতিকভাবে (এবং সম্ভবত ব্যক্তিগতভাবে) নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালাবে, এবং এই আশঙ্কা থেকেই তিনি বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, প্রিগোঝিনের বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিল রুশ সরকারের কাছ থেকে কিছু ছাড় আদায় করে নেয়া, কিন্তু বিদ্রোহ শুরুর পর তিনি রুশ সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন মহল থেকে যতোটা সমর্থন পাবেন বলে ধারণা করেছিলেন, ততোটা পাননি। বিশেষত রুশ বিমানবাহিনীর অধিনায়ক আর্মি-জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যবর্তী সংযোগ স্থাপনকারী এবং ওয়াগনার গ্রুপের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু বিদ্রোহের শুরুতেই সুরোভিকিন বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্য প্রিগোঝিনের প্রতি আহ্বান জানান। শীর্ষ রুশ রাজনীতিবিদরা এবং রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রদেশ ও প্রজাতন্ত্রগুলোর সরকারগুলো রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। রুশ সশস্ত্রবাহিনীর খুবই স্বল্প সংখ্যক সদস্য প্রিগোঝিনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেয়। এমতাবস্থায় প্রিগোঝিন মস্কোর ওপর আক্রমণ চালালে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হতো এবং সেটি সকল পক্ষের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনতো। এমতাবস্থায় প্রিগোঝিন রুশ সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছে বিদ্রোহ বন্ধ করতে বাধ্য হন।
অবশ্য ভুলে গেলে চলবে না, ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ সংক্রান্ত এই বিশ্লেষণটি কার্যত অনেকগুলো সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে একটি। অভ্যুত্থান/বিদ্রোহের ঘটনাগুলো এমনিতেই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়, তদুপরি, মার্সেনারি গ্রুপগুলো যে ধরনের গোপনীয়তার মধ্যে কাজ করে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিস্থিতি বাইরের পর্যবেক্ষকদের জন্য যতোটা জটিল, সেসব বিবেচনায় রেখে এই বিদ্রোহের প্রসঙ্গে সুনিশ্চিত কোনো তত্ত্ব প্রদান করা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
রুশ সরকার ও প্রিগোঝিন ঠিক কোন কোন শর্তে সমঝোতায় পৌঁছেছে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। ওয়াগনার গ্রুপের সাধারণ সদস্যরা শাস্তি পাচ্ছে না — এটি ব্যতীত রুশ সরকার ওয়াগনার গ্রুপকে আর কোনো ছাড় দিয়েছে কিনা, সেটিও এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত। প্রিগোঝিন বেলারুশে চলে গেছেন, কিন্তু তার শেষ পরিণতি কী হবে, সেটিও অজানা। কার্যত এই বিদ্রোহের ফলে বহু সংখ্যক প্রশ্নের উৎপত্তি হয়েছে, এবং সেগুলোর সিংহভাগেরই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু যে বিষয়টি স্পষ্ট, সেটি হচ্ছে: এতদিন সমস্ত রুশ সামরিক প্রতিষ্ঠানের ওপর রুশ সরকারের অন্তত বাহ্যিক যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, এই বিদ্রোহের ফলে সেটিতে ফাটল ধরেছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি রুশ ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কীরকম প্রভাব ফেলে, সেটি দেখার বিষয়।