ঘুরতে তো কম-বেশি সকলেই পছন্দ করে। তবে লম্বা সফরে বা অভিযানে টিকে থাকার তাগিদে বেশ কিছু নিয়ম-কানুন জানতে ও মানতে হয়। একজন অভিযাত্রীর এগুলো অবশ্যই মেনে চলা উচিত।
রাস্তা হারিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা
আধুনিক যুগে মোবাইল থাকতে আর মোবাইলে জিপিএস এবং ম্যাপ থাকতে রাস্তা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে বেশি চিন্তা করার কথা ছিল না। তবে সমস্যা হলো মোবাইল নিতান্তই একটি ডিভাইস যা সময়মতো চার্জ করার দরকার হয়। লম্বা সফরে এমন ডিভাইসে চার্জ কতটুকু থাকবে কিংবা যে স্থানে আপনি যাচ্ছেন সেই স্থানে নেটওয়ার্ক থাকবে নাকি তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সেজন্য সাথে করে অবশ্যই টপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ ও কম্পাস নিয়ে যেতে হবে। আর এই ম্যাপ কীভাবে পড়তে হয় বা কম্পাস কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানতে হবে। ম্যাপ কেনার সময় বা ডাউনলোড করে প্রিন্ট করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তা কোনো বিশ্বাসযোগ্য সাইটের হল বা সোর্সের হয়।
একা ঘুরুন, তবে নিরাপদে ঘুরুন
আপনি যে দেশে বা যে স্থানে ঘুরতে যাবেন সেই জায়গা সম্পর্কে অবশ্যই আগে থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন। চেনা-জানা মানুষদের জানিয়ে রাখবেন আপনি কোথায় যাচ্ছেন এবং ঐ স্থানে যাওয়ার কারো পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে তার সাথে কথা বলে নেবেন। ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলেও নিজ দায়িত্বে সেই জায়গা সম্পর্কে একদম প্রাথমিক কিছু জ্ঞান রাখা দরকার। প্রাথমিক যোগাযোগ ও প্রয়োজনের তাগিদে। আর যেসব স্থানের লোকজন সামাজিক ও ধার্মিক বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত সংবেদনশীল সেসব স্থানে একা যাওয়ার পূর্বে কোন কোন আচরণ, ব্যবহার বা পোশাক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে তা জেনে নিয়ে নিজেকে সেসব থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। সম্ভব হলে সেই জায়গার ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে কথা বলে নেওয়া ভালো। আর প্রয়োজন মনে হলে গাইডের তত্ত্বাবধানেও ঘুরে আসা যেতে পারে। আর অবশ্যই সেই স্থানের নিরাপত্তা বাহিনীর নম্বর এবং বিপদে পড়লে লাগতে পারে এমন সব নাম্বার টুকে নিয়ে যেতে হবে।
আগুন জ্বালানো
রাতের বেলা আলো সঞ্চার করতে টর্চ কখনোই যথেষ্ট নয়। তাই দরকার অগ্নিকুণ্ড। সবচাইতে ভালো হয় যদি আগে থেকে প্রস্তুত কোনো অগ্নিকুণ্ড বা ফায়ার পিট পাওয়া যায়। তবে তা সবসময় সম্ভব নয়। নিজে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে নিলে মনে রাখতে হবে ভেজা বা জীবন্ত ডাল ভেঙে এই কুণ্ড তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না। এতে করে অনেক বেশি ধোঁয়া সৃষ্টি হবে, তবে আগুন ঠিকমতো জ্বলবে না। আগুন জ্বালানোর জন্য তিনটি জিনিস খুবই দরকার। অক্সিজেন, তাপ এবং জ্বালানি। শুষ্ক খড়কুটো, শুষ্ক ডালপালা, গুঁড়ি, দিয়াশলাই, ভ্যাসলিনে ভরানো তুলার বল ইত্যাদি এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যাগ গোছানোর সময় প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া
নিরাপত্তার খাতিরে পরিচয়পত্র বা এ ধরনের কিছু সবসময় ব্যাগে রাখা উচিত। পাওয়ার ব্যাংক, টর্চ, চার্জার তো রাখতেই হবে। টর্চের ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত টর্চই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি সুবিধাজনক। কারণ চার্জ করার ঝামেলা নেই। কাপড়ের ক্ষেত্রে কোন জায়গায় যাওয়া হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে। প্রয়োজন ও স্থান অনুসারে গরম কাপড়, সাধারণ জামাকাপড় বা রেইনকোট নিতে হবে। তাবু, স্লিপিং ব্যাগ, তোয়ালে, টয়লেট টিস্যু, স্যানিটাইজার, লাইটার, সানগ্লাস এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকারি ঔষধপত্রও সাথে রাখা দরকার। তবে ব্যাগ যেন ভারী না হয় সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রসাধনী, যেমন- শ্যাম্পু, লোশনের মতো দ্রব্যাদি ছোট ছোট প্লাস্টিকের বোতল বা ট্রাভেল কিট ব্যবহার করে নেওয়া যেতে পারে। এতে করে ব্যাগ হালকা হবে। সবকিছু হাতের নাগালে যেন থাকে বা খুঁজে পেতে যেন সুবিধা হয় সেজন্য একই ধরনের জিনিস আলাদা করে প্যাক করে ব্যাগে নেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে ছোট ছোট জিনিসগুলো। ভারী জিনিসপত্র একদম নিচে বা উপরে না রেখে মাঝে রাখা উচিত।
সঠিক কাপড় পরা
লম্বা সফরে পরিধান করার জন্য আরামদায়ক, স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই কাপড়ই সকলের পছন্দ। আর এমন ফাইবারের কাপড়ই সবার পছন্দ যা দেহের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা ঠিক রাখবে। সেক্ষেত্রে উলের কাপড়ের ভালো বিকল্প সাধারণত দেখা যায় না। শীতের সময় শরীর গরম রাখতে, গরমের দিনে শরীর আর্দ্র রাখতে সক্ষম উলের কাপড়। এখনকার সিনথেটিক কাপড়ও উলের মতো সবদিক একাই সামলাতে পারে না। উল হলো অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল। তাই কাপড় থেকে দুর্গন্ধ বের হবে এমন চিন্তা বাদ দিয়ে বারবার বা অনেকক্ষণ উলের কাপড় পরা যায়।
প্রয়োজনীয় খাবার
শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির সঞ্চার করতে এবং শক্তি যোগাতে যেকোনো সফরে সঠিক পরিমাণে ও সঠিক খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। শর্করার জন্য অফুটন্ত চাল, ইনস্ট্যান্ট নুডলস এবং ইনস্ট্যান্ট পটেটো সাথে নেওয়া যায়। প্রোটিনের জন্য বাদাম, বিভিন্ন ড্রাই ফ্রুট এবং মাংস নেওয়া যায়। তাছাড়া দেহে পুষ্টি, খনিজের ঘাটতি পূরণের জন্য ফলমূল ও কিছু সবজি নেওয়া যায়। পিনাট বাটার, কলা, আপেল দেহে সোডিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখে। সফরে নেওয়ার জন্য এগুলো উপযুক্ত। রান্না করার সবজি, মাছ, মাংস অবশ্যই পরিষ্কার ও খাওয়ার পানি দিয়ে ধুতে হবে।
হাইড্রেটেড থাকুন
নিয়মিত পানি পান করা খুবই জরুরি। তবে পরিষ্কার পানি পান না করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই ভ্রমণে যাওয়ার স্থানে নিরাপদ পানি কোথায় পাওয়া যাবে তা অবশ্যই জানতে হবে। পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ রয়েছে এমন স্থানে ঘুরতে যাওয়া একদমই উচিত নয়। বিশেষ কোনো কারণে যাওয়া লাগলে পানি পান করার ব্যাপারে বা সেই পানির মূল উৎস কী তা জানা অত্যাবশক। উন্নয়নশীল, অনুন্নত ও দুর্নীতিপ্রবণ দেশে অপরিচ্ছন্ন পানিও বিশুদ্ধ পানির নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা দরকার।
পানি বিশুদ্ধকরণে নিজ দায়িত্বে পানিতে ভাইরাস দূরীকরণের ওষুধ দিতে হবে কিংবা পানি বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। পানিশূন্যতার লক্ষণ সম্পর্কে জানতে হবে। যেমন- ক্লান্তি, অসুস্থতা, মাথাব্যথা, শুকনো চামড়া দেখলে বুঝতে হবে দেহে পানিশূন্যতা রয়েছে এবং বড় ধরনের কোনো বিপদ হওয়ার আগেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অপ্রত্যাশিত পশুদের হাত থেকে রক্ষা
যেখানে যাচ্ছেন সেখানে কী ধরনের পশু রয়েছে তা অবশ্যই জানতে হবে। আর কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হয় তা জানতে হবে। যেমন- বাদামি রঙের ভাল্লুক হলে মৃত সাজতে হবে, কিন্তু কালো ভাল্লুক হলে নিজেকে বাঁচাতে লড়াই করতে হবে। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের মরগান ওয়ারথিনের মতে, ভাল্লুক ও নেকড়ে থেকে কমপক্ষে ১০০ গজ দূরে এবং অন্যান্য পশু থেকে অন্তত ২৫ গজ দূরে থাকা উচিত। হিংস্র পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উত্তম উপায় হলো তাদের থেকে দূরে থাকা।
ধৈর্যশীল হওয়া
লম্বা সফরে কিংবা ভ্রমণে সর্বদাই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। ধরেই নিতে হয় যে, যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপদের আশংকা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে শুধু শারীরিকভবেই নয়, বরং মানসিকভাবেও শক্ত হতে হবে। প্রতিকূল আবহাওয়া, অসুখ-বিসুখ, আকস্মিক দুর্ঘটনা ইচ্ছাশক্তিকে কমিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে চলার মতো শক্তিও কমে যায়। তাই আগে থেকে সেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে এবং বিপদে পড়লেও হাল ছাড়া যাবে না।
সময় বুঝে থেমে যাওয়া
যেভাবে পরিকল্পনা করা হয় সবসময় সেভাবে সবকিছু হয় না। একটা লক্ষ্য ঠিক করে বাসা থেকে দুর্দান্ত কোনো অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলে যে তা সবসময় সফল হবে এমন কোনো কথা নেই। বিফলতা থাকতেই পারে। প্রতিকূল আবহাওয়া কিংবা পুরো অভিযান শেষ করার মতো জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিলে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব নয়।
অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। এরকম পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিয়ে জীবন বাঁচাতে পিছু হটে যাওয়াই ভালো। জীবন বাঁচলে তো অভিযানে আবার যাওয়াই যাবে।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/