সম্প্রতি ইউরেশিয়ায় গৃহীত একটি ভূরাজনৈতিক প্রকল্প বিশ্বব্যাপী জল্পনা–কল্পনার সৃষ্টি করেছে। অনেকের ধারণা, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও ভূ–অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। কেউ কেউ তো এমনও ধারণা করছেন যে, এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষভাবে এতদঞ্চলের এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে দেবে। আবার অনেকের ধারণা, এই অতি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, এবং এটি যদি কোনোভাবে বাস্তবায়িত হয়ও, এটি থেকে প্রাপ্ত লাভের পরিমাণের চেয়ে এর ফলে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। এই বহুল আলোচিত–সমালোচিত প্রকল্পটি হচ্ছে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান কর্তৃক গৃহীত ‘ইস্তাম্বুল খাল’ (তুর্কি: Kanal İstanbul, ‘কানাল ইস্তানবুল’) প্রকল্প, যার মূল লক্ষ্য ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল শহর ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশকে দ্বিখণ্ডিত করে একটি খাল খনন করা এবং এর মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করা।
ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে কী, সেই আলোচনার আগে তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া জরুরি। তুরস্ক একটি দ্বি–মহাদেশীয় (bi-continental) রাষ্ট্র, অর্থাৎ তুর্কি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দুটি মহাদেশে অবস্থিত। ইউরেশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত এই রাষ্ট্রটি আয়তন ৭,৮৩,৩৫৬ বর্গ কি.মি.। রাষ্ট্রটির মোট ভূখণ্ডের ৯৭% পশ্চিম এশিয়ার আনাতোলিয়ায় অবস্থিত, আর বাকি ৩% দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপের পূর্ব থ্রেসে অবস্থিত। রাষ্ট্রটির প্রায় ৮ কোটি ৩৬ লক্ষ অধিবাসীর ৮৬% এশীয় ভূখণ্ডে এবং ১৪% ইউরোপীয় ভূখণ্ডে বসবাস করে। রাষ্ট্রটির দক্ষিণ–পশ্চিমে গ্রিস ও বুলগেরিয়া, উত্তরে কৃষ্ণসাগর, উত্তর–পূর্বে জর্জিয়া, পূর্বে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও ইরান, দক্ষিণ–পূর্বে ইরাক, দক্ষিণে সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিমে ঈজিয়ান সাগর অবস্থিত।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা মধ্য আনাতোলিয়ায় অবস্থিত, কিন্তু রাষ্ট্রটির বৃহত্তম শহর ইস্তানবুল (প্রাক্তন কনস্টান্টিনোপল; পূর্ব রোমান/বাইজান্টাইন ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাক্তন রাজধানী) একটি দ্বি–মহাদেশীয় শহর। শহরটির একাংশ এশিয়ায় এবং অপর অংশ ইউরোপে অবস্থিত। ইস্তানবুলের এশীয় ও ইউরোপীয় অংশদ্বয়কে (এবং সমগ্র এশীয় তুরস্ককে ইউরোপীয় তুরস্ক থেকে) পৃথক করেছে যে সংকীর্ণ জলপথ, সেটি হচ্ছে বসফরাস প্রণালী। বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগর পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। এদিকে, দার্দানেলিস প্রণালী মার্মারা সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরকে যুক্ত করেছে। অর্থাৎ, বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগর ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
সহজ ভাষায়, যদি তুরস্ক বাদে কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অন্য রাষ্ট্রগুলোর (রাশিয়া, ইউক্রেন, রুমানিয়া, জর্জিয়া ও বুলগেরিয়া) জাহাজ ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করতে হবে। অন্যদিকে, কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত নয়, এমন কোনো রাষ্ট্র যদি কৃষ্ণসাগরে তাদের জাহাজ প্রেরণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকেও দার্দানেলিস ও বসফরাস প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে যে রাষ্ট্র এই প্রণালীদ্বয় নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই রাষ্ট্র কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের (এবং ভূমধ্যসাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের) পথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বর্তমানে প্রণালীদ্বয় তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৯৩৬ সালে সম্পাদিত ‘মোন্থ্র কনভেনশন’ (Montreux Convention) অনুযায়ী, বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের সামরিক কর্তৃত্ব তুরস্কের ওপর ন্যস্ত এবং যুদ্ধ চলাকালে তুরস্ক প্রণালীদ্বয়ে বিদেশি যুদ্ধজাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, কোনো রাষ্ট্র তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সেক্ষেত্রে তুরস্ক প্রণালীদ্বয়ে সেই রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক জাহাজের প্রবেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
অবশ্য কনভেনশনের শর্তাবলি অনুসারে, শান্তিপূর্ণ সময়ে বিদেশি বেসামরিক জাহাজ বিনা শুল্কে প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী নয় এমন রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধজাহাজের উক্ত প্রণালীদ্বয়ে প্রবেশের ওপর নানান বিধিনিষেধ রয়েছে। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী নয় এমন কোনো রাষ্ট্র যদি প্রণালীদ্বয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে উক্ত যুদ্ধজাহাজ প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করার ৮ দিন আগে এই বিষয়ে তুরস্ককে অবহিত করতে হয়। ৯টির বেশি বিদেশি যুদ্ধজাহাজ এক সময়ে প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করতে পারে না, এবং কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে যেসব বিদেশি যুদ্ধজাহাজ প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করে, তাদের ওজন ১৫,০০০ টনের বেশি হতে পারে না। তাছাড়া, ১০,০০০ টনের বেশি ওজনবিশিষ্ট কোনো বিদেশি যুদ্ধজাহাজ প্রণালীদ্বয় অতিক্রম করতে পারে না। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী নয় এমন রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক একটি নির্দিষ্ট সময়ে কৃষ্ণসাগরে মোতায়েনকৃত যুদ্ধজাহাজগুলোর মোট ওজন ৩০,০০০ টনের (ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫,০০০ টনের) বেশি হতে পারে না এবং এগুলো তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কৃষ্ণসাগরে অবস্থান করতে পারে না। কেবল কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো প্রণালীদ্বয় দিয়ে যেকোনো ওজনের যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সেটির সঙ্গে কেবল ২টি ডেস্ট্রয়ার থাকতে পারে।
অবশ্য বসফরাস (ও দার্দানেলিস) প্রণালী দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই। প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের ভাষ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ৫৬,০০০ জাহাজ বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে, যেগুলোর মধ্যে প্রায় ১০,০০০ হচ্ছে তেলবাহী ট্যাঙ্কার। সংখ্যাগত দিক থেকে বসফরাস প্রণালী দিয়ে প্রতি বছর যাতায়াতকারী জাহাজের সংখ্যা সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজের সংখ্যার তিনগুণ! হংকংভিত্তিক ইংরেজি পত্রিকা ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিদিন গড়ে ১১৫টি জাহাজ বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে। উল্লেখ্য, বসফরাস প্রণালী খুবই সংকীর্ণ এবং এজন্য প্রায়ই এতে সামুদ্রিক যানজটের সৃষ্টি হয়। কেবল তা-ই নয়, এর সংকীর্ণতার কারণে ও বিপুল সংখ্যক ট্যাঙ্কার চলাচলের ফলে সেখানে দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৯ সালে বসফরাস প্রণালীতে দুটি ট্যাঙ্কারের মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে প্রণালীটিতে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে সেখানে চলমান একটি মালবাহী জাহাজ যথাসময়ে গতি রোধ করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রণালীর তীরে অবস্থিত অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি ওসমানীয় প্রাসাদের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্দেশ্যে তুর্কি সরকার বসফরাস প্রণালীতে চলমান জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রণালীটিতে নতুন করে এরকম দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তদুপরি, ইলদিরিমের মতে, তুরস্কের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো বসফরাস প্রণালীতে নৌ চলাচল বৃদ্ধির জন্য তুরস্ককে চাপ দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘আদালেত ভে কালকিনমা পার্তিসি’র (তুর্কি: Adalet ve Kalkınma Partisi, ‘AKP’) নিয়ন্ত্রণাধীন তুর্কি সরকার বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমানো এবং কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের মধ্যে নতুন একটি সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রকল্পটিই হচ্ছে ‘ইস্তাম্বুল খাল’ প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে বসফরাস প্রণালীর সমান্তরালে ৪৫ কি.মি. (বা ২৮ মাইল) দীর্ঘ, ২৭৫–৩৫০ মিটার (বা ৯০০–১,১৫০ ফুট) প্রশস্ত এবং ২০.৭৫ মিটার (বা ৬৮ ফুট) গভীর একটি খাল নির্মিত হবে, যেটি কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করবে। এই খাল নির্মিত হলে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশ কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং এদের মধ্যে একটি ভাগ দ্বীপে পরিণত হবে। কৃষ্ণসাগর, মার্মারা সাগর, ইস্তাম্বুল খাল ও বসফরাস প্রণালীর সঙ্গে উক্ত দ্বীপটির সীমানা থাকবে।
প্রকল্পটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং এটি এখন পর্যন্ত একেপি কর্তৃক গৃহীত সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প। তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান নিজেই একে ‘উদ্ভট প্রকল্প’ (তুর্কি: Çılgın Proje) নামে অভিহিত করেছেন, এবং তুর্কি জনসাধারণ ও প্রচারমাধ্যম এই শিরোনাম গ্রহণ করে নিয়েছে। বিদেশি প্রচারমাধ্যমেও উক্ত প্রকল্পটি পরিচিতি লাভ করেছে ‘এরদোয়ানের উদ্ভট প্রকল্প’ (Erdogan’s crazy project) হিসেবে। তুর্কি সরকারের ভাষ্যমতে, বিস্তৃত এই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমানো। কিন্তু বহু বিশ্লেষকই ধারণা করছেন, এই প্রকল্পের পশ্চাতে তুর্কি সরকারের গূঢ় ভূরাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে। বস্তুত প্রকল্পটির ব্যাপ্তি, প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে, এবং প্রকল্পটি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে কিনা, সেই ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত বিশ্লেষকরা দ্বিধাবিভক্ত।
অবশ্য কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি বিকল্প জলপথ নির্মাণের প্রচেষ্টা এবারই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে ওসমানীয় ও তুর্কি শাসকদের অনেকেই অনুরূপ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের কেউই উক্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করতে পারেননি।
প্রথম যে ওসমানীয় সুলতান এরকম একটি জলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন প্রথম সুলেইমান, যিনি ‘মহামতি সুলেইমান’ (Suleiman the Magnificent) নামে সমধিক পরিচিত। তার শাসনামলে (১৫২০–১৫৬৬) সাকারিয়া নদী থেকে সাপাঞ্জা হ্রদ ও ইজমিত উপসাগর পর্যন্ত কৃষ্ণসাগরকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেসময় ওসমানীয় প্রধানমন্ত্রী সোকোল্লু মেহমেত পাশা একটি খাল খনন করে সাপাঞ্জা ও ইজনিক হ্রদদ্বয়ের মাধ্যমে সাকারিয়া নদীকে ইজমিত উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তদানীন্তন প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। উক্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ওসমানীয় নৌবাহিনীর জাহাজ নির্মাণ ও ইস্তানবুলের জ্বালানির চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ উক্ত খাল দিয়ে জাহাজযোগে পৌঁছানো যেত। এই প্রকল্পের জন্য মিমার সিনান ও গ্রিক পর্যটক গিরেজ নিকোলা সাপাঞ্জা হ্রদ থেকে ইজমিত উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু সেসময় ওসমানীয় সাম্রাজ্য বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
সুলতান প্রথম সুলেইমানের নাতি সুলতান তৃতীয় মুরাতের শাসনামলে (১৫৭৪–৯৫) দ্বিতীয়বারের মতো উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৫৯১ সালের ৬ মার্চ সুলতান তৃতীয় মুরাত উক্ত জলপথ নির্মাণ সম্পর্কে একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেন এবং প্রকল্পের কাজও আরম্ভ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে প্রকল্পটি স্থগিত রাখা হয়।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর সুলতান চতুর্থ মেহমেদের শাসনামলে (১৬৪৮–৮৭) তৃতীয়বারের মতো উক্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৬৫৪ সালে খালটির নির্মাণকাজ পুনরায় আরম্ভ করার জন্য চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এবারও শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখা হয়।
প্রায় এক শতাব্দী পর সুলতান তৃতীয় মুস্তাফার শাসনামলে (১৭৫৭–৭৪) আবার উক্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সুলতান মুস্তাফা তার শাসনামলের প্রথমদিকে অন্তত দুবার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে প্রকল্পটি স্থগিত রাখতে বাধ্য হন।
সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের শাসনামলের (১৮০৮–৩৯) প্রথমদিকে পুনরায় উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সুলতান মাহমুদ প্রকল্পটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে একটি ‘রাজকীয় ওসমানীয় কমিটি’ গঠন করেন এবং ১৮১৩ সালে উক্ত কমিটি প্রকল্পটি সম্পর্কে সুলতানের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এটি ছিল ওসমানীয় শাসনামলে উক্ত প্রকল্প বাস্তনায়নের সর্বশেষ প্রচেষ্টা।
১৯৮০–এর দশক থেকে বর্তমান তুরস্কে উক্ত প্রকল্প নিয়ে নতুন করে আলোচনা আরম্ভ হয়। তুর্কি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ইয়ুকসেল ওনেম ১৯৮৫ সালে ‘তুর্ক সিতান্দার্তলারি এনস্তিতুসু’র (তুর্কি: Türk Standardları Enstitüsü) ম্যাগাজিনে এবং ১৯৯০ সালে ‘তুর্কিয়ে বিলিমসেল ভে তেকনোলোজিক আরাশতিরমা কুরুমু’র (তুর্কি: Türkiye Bilimsel ve Teknolojik Araştırma Kurumu) ‘বিলিম ভে তেকনোলোজি দার্গিসি’ (তুর্কি: Bilim ve Teknoloji Dergisi) জার্নালে ইস্তাম্বুল খাল সম্পর্কে দুটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে তিনি এই মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, রোমান আমল থেকে বসফরাস প্রণালীর বিকল্প একটি জলপথ সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে এবং ১৫৫০ সালে সুলতান সুলেইমানের শাসনামলে এটি নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, শীঘ্রই এই প্রকল্প নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হবে।
১৯৯১ সালে ‘ইস্তাম্বুল মেট্রোপলিটান পৌর পরিবেশ কমিশন’–এর প্রধান নুসরেত আভজি এই মর্মে প্রস্তাব করেন যে, কৃষ্ণসাগরকে মার্মারা সাগরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি ২৩ কি.মি. দীর্ঘ খাল খনন করা উচত। উক্ত খাল বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমাবে এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করবে। তদুপরি, উক্ত খাল খননের ফলে দানিউব নদীর নৌ চলাচল তুরস্কে স্থানান্তরিত হবে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি পরামর্শ দেন যে, উক্ত খালটির অর্থায়ন ‘বিল্ড–অপারেট–ট্রান্সফার’ পদ্ধতিতে করা যেতে পারে, অর্থাৎ তুর্কি সরকার উক্ত খালটি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব কোনো বেসরকারি কোম্পানির ওপর ন্যস্ত করতে পারে। অবশ্য সেসময় ‘ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র ‘ফ্যাকাল্টি অফ ন্যাভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক ডক্টর ইলহান আর্তুজ এবং ‘ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি’র ‘ফ্যাকাল্টি অফ জিওলজি’র অধ্যাপক ডক্টর ওকায় এরোস্কায় উক্ত প্রকল্পটির পরিবেশগত ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন এবং এই ধরনের কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
সর্বশেষ ১৯৯৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত তুর্কি স্থানীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৭ জানুয়ারি ‘দেমোক্রেতিক সোল পার্তি’র (তুর্কি: Demokratik Sol Parti) তদানীন্তন সভাপতি বুলেন্ত এজেভিত কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি বিকল্প জলপথ নির্মাণের প্রস্তাব করেন এবং এর কারণ হিসেবে বসফরাস প্রণালীতে ক্রমবর্ধমান নৌযান চলাচলকে উল্লেখ করেন। তার দলের নির্বাচনি প্রচারপত্রে এই প্রস্তাবের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। এই ঘটনার আগে ও পরে এজেভিত চারবার বিভিন্ন মেয়াদে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু সেসময় তিনি উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বলে জানা যায় না।
অর্থাৎ, এরদোয়ানের একেপি–নিয়ন্ত্রিত সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প গ্রহণের আগে অন্তত পাঁচ শতাব্দী ধরে ওসমানীয় ও তুর্কি রাষ্ট্রনায়করা বসফরাস প্রণালীর বিকল্প একটি জলপথ সৃষ্টির আগ্রহ দেখিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের আগ্রহ বাস্তবে রূপ নেয়নি। অবশেষে একবিংশ শতাব্দীতে তুর্কি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পকে পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পর্যায়ে উন্নীত করেছে এবং ২০২০–এর দশকের মধ্যেই উক্ত জলপথটি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে।