ভিয়েতনামের এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাম সাউ ডক। গ্রামটিতে একদল আদিবাসী মুসলমানের বসবাস রয়েছে, নাম ‘চ্যাম মুসলমান’। তবে এদের ধর্মীয় সংস্কৃতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমান থেকে কিছুটা ভিন্ন। সময়ের পরিবর্তনে তাদের উপর দিয়ে নানাবিধ আগ্রাসন বয়ে গেলেও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রদায়টি।
ভিয়েতনামের কম্বোডিয়া সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে মেকং নদী। নদীর তীর ধরে গড়ে উঠেছে অ্যান গিয়াং প্রদেশ। প্রদেশের অন্যতম জেলা মেকং ডেল্টা। এই মেকং ডেল্টায় সাউ ডক নামক গ্রামটির অবস্থান। গ্রামটির আয়তন প্রায় ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। ২০১৩ সালের আদমশুমারি অনুসারে গ্রামটির মোট জনসংখ্যা ১,৫৭,২৯৪ জন। গ্রামের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ, দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম ইসলাম। এরা সবাই-ই এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
মূলত মেকং ডেল্টাসহ দক্ষিণ ভিয়েতনামের বর্তমান এলাকাগুলো একসময়ে চাম্পা রাজার অধীনে ছিল। এই রাজ্যে যারা বসবাস করতো তাদের সবাইকে চ্যাম বলা হতো। চাম্পা রাজত্বের সূচনা ঘটে ১৯২ খ্রিস্টাব্দে। দীর্ঘকাল পর ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে এই রাজত্বের পতন ঘটে। রাজত্বের পতন ও নানা নির্যাতনের কারণে চ্যাম আদিবাসীরা ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে।
আগেকার দিনে ধর্ম অনুসরণের ক্ষেত্রে রাজাদের সাথে প্রজাদের একটি বিশেষ মিল পাওয়া যেত, অর্থাৎ রাজা যে ধর্মের অনুসারী হতেন, অধিকাংশ প্রজাই সেই ধর্মের অনুসরণ করতো। শুরুর দিকে চাম্পা রাজারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন, ফলে চাম্পা রাজত্বের অধিকাংশ জনগণ হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন। নবম শতকে এসে অত্র অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। একাদশ শতকে এসে আরব বণিকদের আগমনের ফলে এই অঞ্চলে ইসলামের প্রভাব বাড়তে থাকে। সপ্তদশ শতকে এই প্রভাব পূর্ণতা লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে তা আবার হ্রাস পায়। বর্তমানে চ্যাম আদিবাসীদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম প্রভাবিত নিজস্ব ধর্মের অনুসারী।
চাম্পা রাজত্বের অধীনস্থ এলাকায় ইসলামের আগমন সম্পর্কে প্রধানত দুটি মত পাওয়া যায়। একদল ইতিহাসবিদের মতে, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা) এর শাসনামলে অত্র অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। তাদের মতে, হযরত উসমান (রা) ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন টাং সাম্রাজ্যে, তথা বর্তমান ভিয়েতনাম ও চীনে একজন ইসলামের দূত প্রেরণ করেছিলেন। তিনি চাম্পা সাম্রাজ্যে তার জাহাজ নোঙর করেছিলেন এবং অত্র অঞ্চলে প্রথমবারের মতো ইসলাম প্রচার করেছিলেন। তবে এ সময়ে চাম্পা রাজত্বে ইসলাম তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
আরেকদল ইতিহাসবিদ মনে করেন, উসমান (রা) এর আমলে নয়, বরং একাদশ শতকে চাম্পা রাজত্বে ইসলামের আগমন ঘটে। এ সময়ে অত্র অঞ্চলে আরব বণিকরা চন্দন কাঠের ব্যবসা করতে শুরু করে। এসব আরব বণিকদের অধিকাংশই ছিল ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তাদের হাত ধরেই চাম্পা অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। কিন্তু স্থানীয় রাজার ধর্মই অধিকাংশ প্রজাদের ধর্ম হওয়ায় তখনও ইসলাম তেমন প্রভাব বিস্তার সক্ষম হয়নি। পরবর্তীতে সপ্তদশ শতকে এসে এক চাম্পা রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাতে অত্র অঞ্চলে ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটে। এ সময়ে প্রায় সকল প্রজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
এর কিছুদিন পরেই অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে চাম্পা রাজত্ব ক্রমাগত পার্শ্ববর্তী নুয়িন সাম্রাজ্যের দখলে চলে যেতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের হাতেই চাম্পা রাজত্বের পতন হয়। রাজত্বের পতন হওয়ার সাথে সাথে চ্যামদের দুর্বিষহ দিন শুরু হয়। নেমে আসতে থাকে নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন। এ সময়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অধিকাংশ চ্যাম জনগোষ্ঠী আশেপাশের এলাকায় পালিয়ে যেতে থাকে। সবচেয়ে বেশি পালিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দেশ কম্বোডিয়ায়। কিন্তু সেখানেও তাদের শেষরক্ষা হয়নি। রোহিঙ্গাদের মতো সেখানেও তাদের উপর একটি বড়সড় গণহত্যা চালানো হয়। এরপর থেকে চ্যামদের বসবাসের স্থান পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রচুর ধর্মীয় পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। অনেকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। পাশাপাশি মুসলমানদের মধ্যেও দুটি গ্রুপ তৈরি হয়।
একদল সুন্নি ইসলামের অনুসরণ করে। আরেকটি দল আল্লাহর পাশাপাশি ‘হুই জিয়াও’ নামক এক আধ্যাত্মিক শক্তিধর প্রভুর ইবাদাত করে। এদেরকে ‘চ্যাম বানি মুসলিম’ বলা হয়। সুন্নি গ্রুপটি দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, অপরদিকে চ্যাম বানি গ্রুপটি সপ্তাহে একদিন নামাজ আদায় করে। সুন্নি গ্রুপকে বলা হয় ‘চ্যাম মুসলমান’। চ্যাম মুসলমানরা রমজান মাসে সবাই রোজা রাখলেও চ্যাম বানি গ্রুপটিতে শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় নেতা রোজা রাখলে সবার পক্ষ থেকে রোজা আদায় হয়ে যায়। চ্যাম বানি সম্প্রদায় সাধারণ মক্কায় হজ্জ করে না কিন্তু চ্যাম মুসলিম গ্রুপটির অনুসারীরা মক্কায় হজ্জ করতে গমন করে। তবে উভয় গ্রুপই চ্যাম আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।
ভিয়েতনামের সাউ ডক গ্রামের চ্যাম মুসলমানরা প্রধানত সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। গ্রামটিতে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের বেশ যাতায়াত রয়েছে। তাদের সহায়তায় এখানে একটি মসজিদ ও একটি মাদরাসা গড়ে উঠেছে। মসজিদের ও মাদরাসার খরচও মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার মাধ্যমে জোগাড় হয়। কেননা, স্থানীয় চ্যাম মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নিম্ন পর্যায়ের। পুরুষদের অধিকাংশ জেলে। বাকিরা মাছের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যবসার সাথে যুক্ত। নারীদের মধ্যে বেশিরভাগ তাঁতের কাপড় তৈরি করে। অনেকে আবার দোকান পরিচালনা করে আয় করে। কোনো কোনো পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য উপার্জনের লক্ষ্যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় গমন করে, সেখান থেকে অর্থ পাঠায়।
চ্যাম মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, সাধারণত তাদের কোনো চাকুরিতে নেয়া হয় না। এর পেছনে প্রধান কারণ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। সাধারণ শিক্ষা অর্জনের জন্য গ্রামটিতে ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। আবার দেশের অন্যান্য স্থানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে তারা ব্যপক নিগ্রহের শিকার হন। এজন্য চ্যাম মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় বেশ পিছিয়ে। তবে যারা এসব বাঁধা অতিক্রম করে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তারা সাধারণত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় গমন করেন; তা-ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করতে এসব দেশে যান।
গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ বাটিক লুঙ্গি ও লম্বা শার্ট পরিধান করেন। মাথায় সাধারণত টুপি থাকে। অনেক যুবককে আবার লম্বা আলখেল্লা ও রঙিন টুপি পরিধান করতে দেখা যায়। নারীরা সাধারণত হিজাব সহকারে তাঁতের বিভিন্ন পোশাক ব্যবহার করেন।
বসবাসের জন্য চ্যাম মুসলিমরা ছোট ছোট কাঠের ঘর তৈরি করেন। ঘরগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতে কনক্রিটের শিট ব্যবহার করা হয়। ঘরের দৈর্ঘ্য ২-৩ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে।
২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ভিয়েতনামে মোট ৭৫ হাজার মুসলমান রয়েছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশ এই চ্যাম মুসলমান। আদিবাসী হওয়া সত্ত্বেও এখনো তারা সেখানে পুরোপুরি নিরাপদ নয়। সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এই জনগোষ্ঠী তাদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পাক এটিই আমাদের কামনা।
ফিচার ইমেজ- mvslim.com