(পর্ব ৪-এর পর থেকে)
ভেতরে ভেতরে এলসাইদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলেন কেউ আঘাত পায় কিনা চিন্তা করে। তার এক ছেলেও কাজ করছিল একটা টাগ বোটে। খাল কর্তৃপক্ষের অন্তত পাঁচটি টাগ বোট এভার গিভেনের নাক ধরে টানত। অন্যান্যরা ক্যাবল ধরে টানত। জাহাজ যদি হঠাৎ স্থান পরিবর্তন করত, তাহলে ছোট নৌকাগুলো খেলনার মতো ছিটকে পড়ত। প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই তারা কাজ করছিল। এছাড়া এভার গিভেনের নাক অন্যদিকে ঘুরে বিপরীত তীরের মাটির সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারত। এতে এক ফাঁদ থেকে আরেক ফাঁদ তৈরি হতে পারত। এলসাইদ জাহাজের ক্রুদের চারটি ১০০ মিটার দড়ি নিয়ে তীরের দিকে থাকতে বললেন। এতে জাহাজের নাক হঠাৎ মুক্ত হলে খুব বেশি দূর যেন না যেতে পারে, তা রোধ করা যাবে। তিনি ভাবছিলেন এটাই যথেষ্ট হবে।
২৮ মার্চ রবিবার, এভার গিভেন আটকা পড়ার প্রায় ছয় দিন পর আল্প গার্ডের দেখা মিলল। সেদিন ছিল পূর্ণিমা রাত। চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি থাকায় এর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে লোহিত সাগরের জোয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েছিল। স্যালভেজ ক্রুরা যদি এভার গিভেনকে কার্গো সরানো ছাড়া উদ্ধার করতে চায়, এটাই ছিল সেই মুহূর্ত।
এলসাইদ তখন এক নতুন ধারণা প্রস্তাব করেন। টাগ বোটগুলোকে শুধুমাত্র জোয়ারের সময় ব্যবহারের পরিবর্তে ভাটার সময়ও টানার প্রস্তাব দেন। তারা আশা করছিলেন পানির প্রবাহ এভার গিভেনকে উদ্ধারে সাহায্য করবে। এটা উদ্ধারের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি নয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে যুদ্ধ করার পর এলসাইদ ও তার সহকর্মীরা ভাবলেন এটা কাজ করতেও পারে।
মধ্যরাতে পানির প্রবাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ২৯ মার্চে দিনের শুরুর দিকে ক্রু সদস্যরা জাহাজ থেকে আল্প গার্ডে একটা ক্যাবল সংযোগ করে। টাগ বোটটি এতই শক্তিশালী ছিল যে, তারা এভার গিভেনের কাঠামোতে চারটি দড়ি বাঁধার ধাতব বোলার্ড ক্যাবল দিয়ে বেঁধে দিলো, যেন টানের প্রভাবে ভেঙ্গে না যায়। তারপর আল্প গার্ড আগানো শুরু করল।
ভোরের দিকে জোয়ারের পরিমাণ কমে আসলো। কয়েকজন টাগ ক্যাপ্টেন উপলব্ধি করলেন ধীরে ধীরে তারা স্থান পরিবর্তন করতে পারছেন। এভার গিভেনের পেছনের অংশ নিঃশব্দে তীর থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সরে আসছে। জাহাজের সামনের অংশ বালিতে আটকে থাকলেও এখন কেবল অর্ধেক অংশই আটকানো।
খুব দ্রুত দ্বিতীয় টাগ বোট কার্লো ম্যাগনো এসে আল্প গার্ডের সাথে যোগ দিলো। এটা টানা শুরু করল পেছন দিক থেকে। কয়েক ঘণ্টা ধরে পানিতে সাদা ফ্যানা তৈরি করে দুই বোটের টানাটানি চলল। কিন্তু তারা তখন জোয়ারের বিপরীত দিকে কাজ করছিল। দুপুরের খাবারের সময় তারা হাল ছেড়ে দিলো কোনো দৃশ্যমান উন্নতি ছাড়াই।
তখন এসএমআইটি টিম প্রস্তাব করল এভার গিভেনের লেজের দিকে ২,০০০ টন ব্যালাস্ট ওয়াটার রাখতে, যেন এর নাককে বালু থেকে অতিরিক্ত কয়েক ইঞ্চি সরিয়ে আনতে পারে। দুপুর ২টায় এলসাইদ সব টাগ বোটকে আবার চেষ্টা করতে নির্দেশ দিলেন। এবার জোয়ারের দিক বদলে গেছে, যা তাদের পক্ষে। এই জোয়ারই ছিল যথেষ্ট, তিনি যেটা ভাবছিলেন।
এলসাইদ তখন এভার গিভেনের ব্রিজে ক্যাপ্টেন কান্থাভেলের সাথে ছিলেন। জাহাজের নাক শুরুতে ধীরে ধীরে সরে আসছিল, এরপর পুরোপুরি সরে আসে। চিফ পাইলট তখন রেডিওতে তার টাগ ক্যাপ্টেনদের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পান। জাহাজ তীর থেকে যখন সরে আসছিল, এখন কূলের সাথে জাহাজের নাককে বেঁধে রাখা দড়িগুলোর একটি রাইফেলের শটের মতো আওয়াজ করে ছিড়ে গেলে। এরপর আরেকটি ছিড়ল, তারপর আরেকটি। তবে শেষ দড়িটি যথেষ্ট ছিল এভার গিভেনকে খালের মধ্যে দোল খাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য। এলসাইদ তখন কান্থাভেলকে বলেন ইঞ্জিন চালু করতে এবং জাহাজকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে যেন সামনে থাকা স্যালভেজ শিপগুলোকে নিরাপদের অতিক্রম করতে পারে।
এভার গিভেন যখন এর নিজের ইঞ্জিন দিয়ে চলা শুরু করল, টাগ ক্রুরা উচ্ছ্বাসিত ধ্বনিতে তাদের হর্ন বাজাতে থাকল। ব্রিজে থাকা ভারতীয় অফিসাররা উল্লাসে চিৎকার করছিলেন এবং এসএমআইটি উদ্ধারকর্মীদের জড়িয়ে ধরছিলেন। রাবি প্রেসিডেন্ট সিসিকে ফোন করে শুভ সংবাদটি দেন। এল সাইদ তখন বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।” তিনি অনিচ্ছা নিয়ে কয়েকটি ছবি তুলেন, তারপর কর্মক্ষেত্রে চলে যান। ৪০০টিরও বেশি জাহাজ তখন খালে প্রবেশের অপেক্ষা করছিল।
এভার গিভেন মুক্তি পাওয়ার পর বহির্বিশ্ব দ্রুতই সুয়েজ নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এলসাইদ ও তার পাইলটদের জন্য সঙ্কট তখনো অনেক বাকি ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পিছিয়ে থাকা জাহাজগুলোর একটা বিরাট অংশকে দ্রুত খাল অতিক্রম করিয়ে দেওয়া হয়। খাল কর্তৃপক্ষ দিন-রাত কাজ করতে থাকে। দিনে ৮০টি পর্যন্ত জাহাজ অতিক্রম করতে হচ্ছিল তখন। এলসাইদ জানতেন অতিরিক্ত কাজ করা ক্লান্ত পাইলটদের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। কিন্তু তার কাছে খুব বেশি বিকল্প ছিল না। এভার গিভেন মুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর খাল কর্তৃপক্ষের এক নৌকা ডুবে একজন কর্মী মারা যায়। অত্যন্ত চাপের মধ্যে সামুদ্রিক চেকপয়েন্টে কাজ করার বিপদটাকেই যেন নির্দেশ করছিল।
জাহাজের সারি হালকা করতে ছয় দিন সময় লেগেছিল। এরপর এলসাইদ আলেক্সান্দ্রিয়াতে তার পরিবারের সাথে দেখা করতে যান। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পর এটা ছিল তার প্রথম ছুটি।
নেদারল্যান্ডের হেগে থাকা এপিএম টার্মিনালের নির্বাহী জভেন্ডসেন তখন বিপুল পরিমাণ কার্গোর ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি জাহাজগুলোর ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সর্বাত্ত্বক চেষ্টা করছিলেন। কোম্পানি তখন ইউনিয়নের সাথে সমঝোতায় আসে কর্মঘণ্টা বাড়ানোর জন্য। জাহাজগুলোতে গুদামের জন্য রাখা জায়গা খালি করা হয় অতিরিক্ত হাজার হাজার কন্টেইনার জায়গা দেওয়ার জন্য।
সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের ভ্যালেন্সিয়াতে। বন্দরের সংরক্ষাণাগার ইতোমধ্যে প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল স্প্যানিশ পণ্য দিয়ে যা শিপমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল। যে কন্টেইনারগুলো আসছিল, তা পণ্য দিয়ে পূরণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ভ্যালেন্সিয়া টার্মিনালকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে এক মাস ধরে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা শিফটে কাজ করতে হতো।
এসব বিষয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। এভার গিভেনের ঘটনায় কোভিড-১৯ থেকে বিশ্বের মনোযোগ কিছু সময়ের জন্য সরে গিয়েছিল, যা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য আশীর্বাদের মতো। তারা এই অবস্থার সমাধান হয়ে যাওয়ায় ‘শোক’ প্রকাশ করছিল। টুইটারে #PutItBack হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড হয়ে যায়। বেশিরভাগ মানুষের কাছে সুয়েজ খাল আবার পূর্বের মতো বিশ্ব বাণিজ্যের অদৃশ্যমান অবলম্বনের অবস্থানে ফিরে যায়।
অন্যদিকে শিপিং ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্ধার অভিযানের মধুচন্দ্রিমা শেষ হলে বিতর্ক তখন রূপ নেয় ব্লেম গেমে। এই দুর্ঘটনার দায় ছিল কার? যে পরিমাণ শারীরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দেবে কারা?
(পরবর্তী অংশ শেষ পর্বে)