২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও বর্তমান পরিস্থিতি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বিশ্ব অর্থনীতি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা হানা দিয়েছে। বাংলাদেশও এই মন্দার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। উপরন্তু, ২০১৯ সালের কোভিড মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলেছে। ২০১৯ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের (২০২২) জুলাইয়ে ফরেইন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ছিল ৩,৯৪৯ কোটি ডলার (৩৯.৪৯ বিলিয়ন)। কিন্তু এতে নানা পাওনা যুক্ত থাকায় এর পুরোটা ব্যবহারযোগ্য নয়। ইডিএফ, জিটিএফএ, এলটিএফএফ, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমানে রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার দেয়া আছে, যা চাইলেই সহজে ফেরত পাওয়া যাবে না। তাই রিজার্ভের নিট পরিমাণ প্রায় ৩,১০০ কোটি ডলার।

বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশি যেসব কাজ করেন, তার মধ্যে রয়েছে কায়িক শ্রমসেবা, নানাবিধ ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, পর্যটন খাত ইত্যাদি। যেহেতু এসব সেক্টর বিদেশে খারাপ যাচ্ছে, ফলে বাংলাদেশিদের আয় কমছে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণে গত অর্থবছরে রেমিটেন্স অতীতের তুলনায় কম এসেছে

বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমছে; Image source: ceicdata.com

করোনার আক্রমণ শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা চাপের মধ্যে আছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যের দাম। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও তা আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেই অনুপাতে রপ্তানি বৃদ্ধি না পাওয়ায় এবং রেমিটেন্স কমে যাওয়া ও ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন- প্রভৃতি কারণে রিজার্ভ কমে গেছে। আবার, জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভও কমে গেছে।

বিভিন্ন বৈদেশিক খাত থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে বলে ২০২৩ সাল থেকে সেই ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। ঋণ নেওয়া যত সহজ, তা শোধ করা ঠিক ততটাই কঠিন। ২০২৩ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন হবে সেটা বলা কঠিন, তবে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমান করা যেতে পারে যে দেশের নানা খাতে স্থিতিশীলতার অভাব দেখা দিতে পারে। যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমতে থাকে বা রপ্তানি আশানুরূপ না হয় বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। তখন অনেকেই পরামর্শ দেবে নতুন করে ঋণ নিতে।

জ্বালানি গ্যাস ও তেলের দামের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ও দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমাদের ২০০৮ সালের মহামন্দার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানের অর্থনীতির সাথে সেই সময়ের তুলনা করলে আসন্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ২০০৮

২০০৭ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রায় ৫% রেকর্ড গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার দেখেছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাবপ্রাইম মর্টগেজ বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সূত্রপাত ঘটায়। বিশ্বের বৃহত্তম দেশের অর্থনীতি এই সময়ে গড়ে মাত্র ১% বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাড়ির দাম বাড়তে থাকবে এই চিন্তা করেই সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ির মালিকরা ব্যাপক হারে ব্যাংক লোন নেয়া শুরু করে। কিন্তু যখন বাড়ির দাম কমে গিয়েছিল, তখন ২৩% বাড়ির মালিকের বন্ধকী ঋণের অর্থ তাদের বাড়ির মূল্য অপেক্ষা কম ছিল। উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এই সময় কমে যায়। শিল্প, সেবা ও রপ্তানি খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ সব খাতে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। ব্যাংক ঋণের চাহিদা কমে যায় ও দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে।

২০০৮ সালের মন্দায় বিশ্বের সব দেশেই জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল; Image source: The World Economic Forum

সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা চালু করে, যেমন- জনপ্রশাসন খরচ বৃদ্ধি, ক্ষতির মুখে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজি দিয়ে সহায়তা প্রদান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য বৃদ্ধি করা, ঋণ দেওয়ার নিয়ম সহজ করা ইত্যাদি। নগদ টাকা হস্তান্তর, বিশেষ খাতে ভর্তুকি এবং রেয়াতি ঋণের মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো প্রসারিত করা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার বিরূপ প্রভাব থেকে দরিদ্রদের রক্ষা করার জন্য সাধারণ কর্মসূচি।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অন্যান্য সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০০৭ সালের কয়েক বছর আগে থেকে প্রায় ৬% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের আর্থিক সঙ্কট মূলত রপ্তানি, রেমিটেন্স এবং বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশি পণ্য ও শ্রমিকের চাহিদা দ্রুত সঙ্কুচিত হতে থাকে এই সময়ে

২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় টানাপোড়েনে পড়েছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরে এখন আবার অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের এই সংকট মূলত বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণেই। অর্থনীতিতে এ ধরনের সংকট হলেই হয়তো টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাঠামোগত মৌলিক যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেদিকে সবার নজর পড়ে

২০০৮ সালের মন্দায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো অবস্থানে ছিল; Image source: apjjf.org

রপ্তানি এবং রেমিটেন্স উভয়ই বাংলাদেশের জন্য প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে এই সময় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এছাড়া, রেমিটেন্সের বড় অংশ যেসব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে আসত, সেটি ২০০৮ সালে বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেকাংশে অপরিবর্তিত ছিল, আর ২০০৯ সালে এসে তা কমে যায়। অধিকাংশ বাংলাদেশী শ্রমিক এ সময় চাকরি হারান।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহও কমে গিয়েছিল। খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ মূলত আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেও বিশেষ দামে এসব পণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যাতে দেশের অভ্যন্তরে দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্য থাকে

বর্তমান পরিস্থিতি

বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি

প্রাক-মহামন্দা যুগের সাথে সবচেয়ে বড় পার্থক্য এবং আমরা আজ মার্কিন অর্থনীতিতে যা দেখছি তা হলো মুদ্রাস্ফীতি। অধিকাংশ দেশেই মুদ্রাস্ফীতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। বিগত ৪০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এত বেশি মুদ্রাস্ফীতি ছিল না। এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি গড়ে ৮ শতাংশের ওপরে উঠে গিয়েছে। তাছাড়া, আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে।

ভারত এই বছর রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে পড়েছে। জুন ২০২১-এ ভারতে বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে ছিল ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জুলাই ২০২২ এ এসে তা দাঁড়িয়েছে ৩১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এর ফলে ভারতের মুদ্রার দর পতন ঘটেছে। যুক্তরাজ্যও এ বছর শেষে মন্দার কবলে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদের হার বৃদ্ধি করে ১.২৫ শতাংশ থেকে ১.৭৫ শতাংশে উন্নীত করেছে, যা বিগত ২৭ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ তুরস্কেও মুদ্রাস্ফীতি ৭৯.৯ শতাংশ, যা বিগত ২৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাই বলা যাচ্ছে, আগামীতে মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেয়াই হবে সব দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি।

২০২২ সালের মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বের অর্থনীতিকে কাবু করে রেখেছে; Image source: The World Economic Forum

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ

কোভিডের প্রকোপ ছাড়াও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে ফেলেছে। এই সংকট কতদিন দীর্ঘায়িত হবে তা বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, চীন-আমেরিকা উত্তেজনাও বড় কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বে খাদ্য যোগানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব দেশের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে খাদ্যের ৩০ শতাংশ রাশিয়া ও ইউকরেন সরবরাহ করে থাকে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে উৎপাদন কম হয়েছে। আবার, যুদ্ধের কারণে এসব দেশ থেকে পণ্য বাইরে যেতে পারছে না। এ বছর ইউক্রেনে মোট ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য উত্তোলন করা যাবে না। ইউক্রেনের গম এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ওপর মিসরসহ আফ্রিকার বহু দেশ নির্ভরশীল। রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছে।

বৈশ্বিক মন্দা

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সতর্কবার্তা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করছে। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইতোমধ্যে মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা দেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৫৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩৪ বার অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে। কিন্তু অতীতের মন্দার চেয়ে এবারের মন্দার রূপ ভিন্ন।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি সবাইকে দিশেহারা করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ-জুন ২০২২ সালে লেবাননের খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩৩২ শতাংশ, জিম্বাবুয়েতে ২২৫ শতাংশ, ভেনেজুয়েলায় ১৫৫ শতাংশ, তুরস্কে ৯৪ শতাংশ, ইরানে ৮৬ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৮০ শতাংশ, এবং আর্জেন্টিনায় ৬৬ শতাংশ। অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। খাদ্য ও নিত্যপণ্য আমদানির জন্য এসব দেশকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে।

এসব দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিশ্বের অন্তত ৯টি দেশ শ্রীলংকার মতো অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর মধ্যে জাম্বিয়ার ঋণ-জিডিপি অনুপাত ১০৪ শতাংশ হয়েছে। অন্যান্য দেশের মধ্যে মিশরের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৯৫ শতাংশ, কঙ্গোর ৮৩ শতাংশ, রুয়ান্ডার ৭৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৬ শতাংশ, এবং কেনিয়ার ৭১ শতাংশ। এসব দেশে যেকোনো সময় ঋণখেলাপিতে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের কী অবস্থা?

এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কিছু দ্রব্যের আমদানি কমানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে তেলের ব্যবহার হ্রাস করার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার উত্তরোত্তর অবমূল্যায়ন বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে; Image source: ceicdata.com

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্য আমদানি নিরুসাহিত করা হচ্ছে। এছাড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন আমদানি পণ্যের তালিকা বৃদ্ধি করে ১২টি থেকে ২৬টি করা হয়েছে। সাথে ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ এলসি (LC – Letter of Credit) মার্জিন শতভাগ ধরা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৩৯.৭২ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উক্ত তারিখ পর্যন্ত রয়েছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার ৭০০ কোটি ডলার নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে। এটি নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। অবশ্য এই ঋণ একসময় সরকার রিজার্ভ ফান্ডে ফেরত নিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য এই রিজার্ভ কম বলে তা পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে, মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে হলে এই রিজার্ভ সহায়ক হবে না। তাই রিজার্ভ অনেক বৃদ্ধি করতে হবে বলে সরকার আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছে।

রিজার্ভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের পণ্য চাহিদার ২৩ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের প্রধানতম খাত তৈরি পোশাকশিল্প। দ্বিতীয় জনশক্তি রপ্তানি খাত। করোনাকালে রপ্তানিখাত বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। বিগত তিন মাসে রপ্তানি কমেছে। জনশক্তি খাত থেকেও রেমিটেন্স কম এসেছে। তবে বর্তমানে রেমিটেন্স ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্ব মন্দার কারণে বিদেশে কম মূল্যের পোশাকের চাহিদা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ এখনও কম মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে। এখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ ক্রেতারা কম দামী পোশাক বেশি কিনলে আমাদের দেশে রপ্তানি চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।

প্রবাসীরা বৈধ পথে অর্থ না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। কারণ, তাতে প্রবাসীরা ৮-১০ টাকা করে বেশি অর্থ পান। সরকার মার্কিন ডলারের বিনিময় হার মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিলেই বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। তখন দেশে রিজার্ভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

উদ্যোগ

এত সব পদক্ষেপ নেয়ার ফলে জুন মাসের তুলনায় জুলাই ২০২২ সালে আমদানি ব্যয় প্রায় ২.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, এলসি খোলার হার ৩ শতাংশ কমেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও উপকার আসবে।

বাংলাদেশেও মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েই চলেছে; Image source: tradingeconomics.com

সরকার ইতোমধ্যে কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করার চিন্তা করছে। যেসব প্রকল্প কম গুরুত্ব পূর্ণ, সেসব প্রকল্পে বিনিয়োগ হ্রাস বা বন্ধ করার চিন্তা করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন উল্লেখ করেছেন, সরকারের গৃহীত প্রকল্পের মধ্যে ১১টি মেগা প্রকল্প গুরুত্ব কম। অর্থাৎ এসব প্রকল্প থেকে আয় খুবই কম হবে। কাজেই এই সকল প্রকল্প সরকার সম্পূর্ণ বাদ দেয়ার চিন্তা করতে পারে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক চাপের কারণে মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে হবে। যেসব প্রকল্প চলমান, সেসবের ঋণের কিস্তি বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদান করতে হবে।

করণীয়

দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধে সরকারের সব পর্যায়ে দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও বেশি তৎপর ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ঘোষিত জিরো টলারেন্সকে বাস্তবে কার্যকর করতে হবে।

অপচয়, দুর্নীতি ও অর্থ বিদেশে পাচার বন্ধ করতে পারলে দেশের দৈন্য অর্থনীতির সবল জোয়ার সম্ভাবনা দ্রুত দেখা দেবে। আমাদের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি খুবই সীমিত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের রপ্তানি ও রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিমুখী সব খাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ কম মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য কোনোভাবে বাড়ানো যাবে না। যদি রপ্তানি কমে যায় তাহলে রিজার্ভও কমবে এবং তা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

  • কৃষিতে ভর্তুকি চলমান রাখতে হবে। কৃষিতে সব ধরনের কর প্রত্যাহার করতে হবে যেন কৃষক কম মূল্যে ডিজেল, সার, কীটনাশক, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারে। খাবারের ঘাটতি মেটানোর জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে অর্থনীতির ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাই বিশ্বমন্দায় বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আগেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
  • ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অবিলম্বে বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে জ্বালানি পণ্যের ওপর চাপ কমবে এবং আমদানি ব্যয় কমে আসবে, যেহেতু পর্যাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
  • সিএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নতুন করে অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে। যেসব কেন্দ্র এখনও চালু হয়নি সেগুলো দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • দেশে বিদ্যুতের চাহিদানুযায়ী ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। কোনো রকমের দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। সঞ্চালন লাইন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন একই সময়ে করতে হবে যেন ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারকে বিরাট অর্থ ব্যয় করতে না হয়।
  • গ্যাস, সিএনজি, কয়লা ও আণবিক পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা থেকে সরে এসে সৌরবিদ্যুৎ বা নতুন কোনো উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা করতে হবে। দেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, উত্তোলন ও তা ব্যবহারে অধিক মনোযোগী হতে হবে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারের উত্থান-পতন; Image source: statista.com

সকল বিষয় বিবেচনায় এটা বলা যায় যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও খুব নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কাছে জনগণ এখন অসহায়। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানুষের জীবনমান নিম্ন থেকে নিম্নতর অবস্থায় চলে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এহেন পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুব দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

Language: Bangla
Topic: The global economic crisis of 2008 and the present condition
References: Hyperlinked inside the article

Related Articles

Exit mobile version