প্রতি বছর অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি একটা নির্দিষ্ট শব্দকে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ আখ্যা দেয়। অক্সফোর্ডের তথ্যকেন্দ্রে প্রায় ১৯ বিলিয়ন শব্দ আছে সেখান থেকে নানা পরিসংখ্যান ঘেঁটে তাদের গবেষকেরা সাধারণত একটি বেছে নিতেন। তবে এই বছর থেকে অনলাইনে ভোটাভুটির মাধ্যমে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন শুরু হয়েছে।
এই বছর প্রায় ৩,৪০,০০০ ভোটের পর শতকরা ৯৩ ভাগ ভোট পেয়ে ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছে “গবলিন মুড” (goblin mode)। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেটাভার্স, আর তৃতীয় হয়েছে #আইস্ট্যান্ডউইথ (#IStandWith)। ২০২১ সালে এই খেতাব ছিল ভ্যাক্স (ভ্যাক্সিনের সংক্ষেপিত রূপ) আর ২০১৯ সালে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি‘র দখলে। কিন্তু গবলিন মুড মানে কী? অভিধানের ভাষায় একেবারেই অলস, ঘরকুণো ব্যক্তি, যে সামাজিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না, এমন কিছু বোঝানো হয়।
উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজ হয়। মনে করুন, অগোছালো ঘর, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিপসের প্যাকেট আর এর মাঝে ঢোলা জামাকাপড়ে বসে থাকা কেউ, যার কাছে বাহ্যিক চাকচিক্যের মূল্য নেই বললেই চলে। ডেভ ম্যাকনেমি নামে এক টুইটার ব্যবহারকারী, গবলিন মুড নিয়ে যার টুইট ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল, তিনি গার্ডিয়ান পত্রিকার কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন গবলিন মুড হলো যখন আপনি রাত দুইটার সময় ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকলেন স্ন্যাক খেতে, আপনার পরনে কেবল ঢোলা একটা টি-শার্ট।
লস অ্যাঞ্জেলসের সাইকোথেরাপিস্ট সুসান জিনের মতে, গবলিন মুডে মানুষ তার নিজের অনুভূতি দূরে সরিয়ে রাখতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে পারে। হয়তো পপকর্ন হাতে নিয়ে বসে পড়ল নেটফ্লিক্সে টানা কোনো সিরিজ দেখতে, অথবা সারাদিন অর্থহীনভাবে সোশ্যাল মিডিয়া হাতড়ে গেল কেবল।
২০০৯ সালে কোনো এক টুইটে গবলিন মুড প্রথম উঠে আসে। বেনামি সেই টুইটে কেউ একজন বলেছিলেন, গত রাতে তিনি গবলিন মুডে ছিলেন। এরপর প্রায় তের বছর কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। অনেকটা হঠাৎ করেই ২০২২ সালে এই শব্দ জনপ্রিয় হয়ে যায়। এবারেও সেই টুইটারের কল্যাণেই। গায়ক কেনিয়ে ওয়েস্ট আর অভিনেত্রী জুলিয়া ফক্স তখন তাদের সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। সেই সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি জুলিয়া ফক্সকে উদ্ধৃত করে এক ব্যবহারকারী লেখেন যে, তিনি জানিয়েছেন ওয়েস্ট তার গবলিন মুডে চলে যাওয়াকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় টুইট। শেষ পর্যন্ত ফক্স তার ইন্সটাগ্রামে লিখতে বাধ্য হন তিনি কখনোই এমন কিছু বলেননি। তবে কে শোনে কার কথা, গবলিন মুড তরতর করে উঠে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
কেন গবলিন মুড হঠাৎই এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠল? সময়টা চিন্তা করুন, প্যান্ডেমিকের বিধিনিষেধ কমে মানুষ তখন সবে আবার আগের জীবনধারায় ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু প্যান্ডেমিকের সময়কার জীবনযাত্রার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া অনেকেই এতে বিরক্ত হয়েছিলেন, বিশেষ করে হোম অফিস ছেড়ে সশরীরে অফিসে যাওয়া অনেকের কাছেই উপাদেয় ঠেকেনি।
অক্সফোর্ড ল্যাঙ্গুয়েজের একজন ডাইরেক্টর ক্যাথেরিন কনর মার্টিন (Katherine Connor Martin) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- গবলিন মুড এই ধারণাই দেয় যে প্যান্ডেমিক চলে গেলেও এর প্রভাব রয়ে গেছে এখনও। প্যান্ডেমিক-পূর্ব সময়ে যা স্বাভাবিক বলে ধরা হতো, সেই ব্যাপারগুলো প্যান্ডেমিকের সময় অনেকটাই উল্টে গেছে। এই উল্টে যাওয়াই অনেকের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
কিন্তু গবলিন মুড কেন? এটা উদ্ভুত ইউরোপিয়ান মিথোলজির প্রাণী গবলিনদের থেকে এসেছে। অনেকটা মানুষের মতো দেখতে ডানাওয়ালা ছোট এই প্রাণীগুলো নানা ধরনের দুষ্টু কাজকর্মের জন্য কুখ্যাত। বলা হয়, এরা আরামদায়ক কোনো স্থানে থেকে খেতে আর খেলতে ভালোবাসে। প্যান্ডেমিকের সময় ঘরের কোণায় আবদ্ধ হয়ে পড়া আমরাও হয়তো তাদের মতোই হয়ে গিয়েছিলাম খানিকটা।
অক্সফোর্ডের মতো অন্যান্য অভিধান প্রণয়নকারী সংস্থাও কিন্তু ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নিয়ে কাজ করে। মিরিয়াম-ওয়েবস্টার ‘গ্যাসলাইটিং’ (মানসিকভাবে কাউকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করা যে সে নিজেকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে মনে করতে থাকে) আর কলিন্স ডিকশনারি ‘পার্মাক্রাইসিস’কে (লম্বা সময় ধরে অস্থিতিশীলতা অথবা নিরাপত্তাবোধের অভাব) নির্বাচন করেছে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ বলে।
আবার ফিরে যাই গবলিন মুডের কথায়। অক্সফোর্ড ল্যাঙ্গুয়েজের প্রেসিডেন্ট ক্যাস্পার গ্রান্থওয়ল (Casper Grathwohl) মনে করেন, এই শব্দগুচ্ছ আরো অনেক দিন মানুষের মনে থেকে যাবে। ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার ঘোষিত হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে গেছে। তবে নিউ ইয়র্কের নিউরোসাইকোলজিস্ট ড. সানাম হাফিজের মতে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। মাঝে মাঝে গবলিন মুডে চলে যাওয়া স্বাভাবিক হলেও সবসময় এই মুডে থাকা বিষণ্নতার পূর্বলক্ষণ হতে পারে।