নিজের বাসস্থান সবসময়ই পরম শান্তির একটা জায়গা। সকল আবেগ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আস্থা, প্রশান্তি ও স্মৃতি জড়িয়ে থাকে এই একটি শব্দে। যদিও বা জীবিকার তাগিদে কখনও দূরে যেতেও হয়, তবুও মনের সবটা জায়গা জুড়ে থাকে নিজের কক্ষ, নিজের বাসা এবং সেই এলাকাটা। এখানে যে কত মায়া জড়িয়ে আছে, তা একবার ঘর থেকে দূরে গেলেই বোঝা যায়। কিন্তু সবার এই মায়া ধরে রাখার ভাগ্য থাকে না। সবাই পারে না, জন্মস্থানে সারাটা জীবন পার করতে। কিছু মানুষকে যাযাবর জীবনের মধ্যে নিজস্ব নিবাস খুঁজে নিতে বা তৈরি করে নিতে হয়। উয়াং ইয়ং-ফু এমনই একজন।
চীনের কুয়াংচৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রায় ৯৭ বছরের উয়াং ইয়ং-ফুর বয়স যখন ১৫ ছিল, তখন তিনি প্রথম ঘর ছাড়েন দ্বিতীয় সিনো-জার্মানিজ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য। এর পর থেকেই শুরু হয় তার যাযাবর জীবন। ১৯৩৭ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই উয়াং যোগ দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এই যুদ্ধেও আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু যুদ্ধের নেশাটা তার মধ্যে থেকেই যায়। তাই চীনের গৃহযুদ্ধের রেশ ধরে তিনি মাও জিডং-এর কম্যুনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধেও অংশ নেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তারা অর্থাৎ ন্যাশনালিস্ট পার্টি হেরে যায় এবং মাও জিডং পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না তৈরি করেন। হতাশ হয়ে উয়াংসহ ন্যাশনালিস্ট পার্টির ২০ লক্ষ সমর্থক চাং কাই-শেখের সান্নিধ্যে তাইওয়ানে বসতি স্থাপন করেন।
তাইওয়ান দ্বীপটি চীনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এই দ্বীপ প্রথমে জাপানের আওতায় থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি চীনের মালিকানাধীন হয়ে যায়। ২০টা বছর, অর্ধেকের বেশি জীবন যুদ্ধ করে কাটিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে উয়াংয়ের ভাগ্যে জুটে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একটি স্থায়ী ঠিকানা। বেশ কয়েকটা বছর তার স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যায় অচেনা এই তাইওয়ান দ্বীপে। যখন এই দ্বীপটা যখন ধীরে ধীরে তার মাতৃভূমি হয়ে উঠছিল, তখন কিনা উয়াং জানতে পারলেন, এই আবাসভূমিটাও ত্যাগ করতে হবে তাকে! তবে কি হার মেনে নিয়েছিলেন উয়াং, নাকি রক্ষা করতে পেরেছিলেন বহুদিন পর পাওয়া সেই বাসস্থান?
যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছিল উয়াংয়ের আবাসস্থল
মাও জিডংয়ের কাছে হেরে চাং কাই-শেখ তার সৈন্যদের নিয়ে তাইওয়ানে আসেন। ন্যাশনালিস্ট পার্টির আর্মি পরিবারদের জন্য তৈরি করা হয় প্রায় দুই হাজার বাড়ি। চাংয়ের এখানে আসার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই- সুযোগ পেলেই তারা মাওয়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং ছিনিয়ে নেবে তাইওয়ান দ্বীপ, গড়ে নেবেন স্বাধীন একটি দেশ। কিন্তু এমনটা হয়নি। ধীরে ধীরে যুদ্ধের তেজস্বিতা কমে আসে, ন্যাশনালিস্ট পার্টির আর্মিরা এখানে সংসার সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে থাকেন। ১৯৪০ শতকের শেষের সময় থেকে ১৯৫০ শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত এই দ্বীপে বসতি গড়ে প্রায় ১.২ মিলিয়ন মানুষ। দুটি ভিন্ন ঘটনার উপর ভিত্তি করে পিপল’স রিপাবলিক অব চায়নার সৈন্যরা ১৯৫০ সালে হঠাৎ তাইওয়ানে বোমা ফেলে রিপাবলিক অব চায়নার, অর্থাৎ ন্যাশনালিস্ট পার্টির সৈন্যদের সুখে বসতি তছনছ করতে চান। কিন্তু এবারে পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না সফল হতে পারেনি। কম্যুনিস্ট পার্টির কাছ থেকে তাইওয়ান ছিনিয়ে আনেন উয়াং ইয়ং-ফু এবং এই পারদর্শিতার জন্য ১৯৭৮ সালে অর্জন করেন স্বর্ণপদক। তাইওয়ান স্ট্রেট ক্রাইসিস সমাধান হওয়ার পর তিনি নিজের জন্য একটা বাংলো তৈরি করেন তাইওয়ানের তাইচুং গ্রামে। সেখানে অনায়াসে ৪০টা বছর কাটিয়ে দেন।
রংধনু দাদু হয়ে ওঠার গল্প
তাইওয়ান সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের আর্মিদের নতুন আবাসস্থল দেওয়া হবে। গ্রামাঞ্চলে সৈন্যদের সকল বসতি উচ্ছেদ করে সেগুলো ডেভেলপারের দায়িত্বে দেওয়া হবে। নতুন আঙ্গিকে তৈরি করা হবে সকল গ্রাম। এক এক করে সকলেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন! কারও বাড়ি কেড়ে নিলো ডেভেলপাররা, কেউবা তাদের কাছ থেকে দালানবাড়ির আশায় সাময়িকভাবে গ্রাম ছাড়লেন, আবার কেউ একেবারে এই তাইওয়ান ছেড়ে চলে গেলেন জন্মস্থানে। কিন্তু উয়াংয়ের তো কেউ নেই। তিনি বিয়েও করেননি, তাই পরিবার তো দূরেই থাক; কোনো পরিজনও তার নেই। তাইচুং গ্রামের যে ১,২০০ পরিবারকে আঁকড়ে ধরে উয়ং একাকিত্ব দূর করেছেন এতটা বছর, সেই পরিবারগুলোও আর নেই।
২০০৮ সাল। পুরো গ্রামে তিনি একা। তাইওয়ান সরকারের পক্ষ থেকে তার কাছেও এলো গ্রাম ছাড়ার নোটিশ। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? কীভাবে বাঁচাবেন নিজের একমাত্র বাসস্থান।
উয়াং ছোটবেলায় বাবাকে দেখতেন ছবি আঁকতে। স্কুলে থাকতে তিনিও ছবি আঁকতেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর থেকে আর ছবি আঁকা হয়নি তার। প্রায় ৭১ বছর পর আবার হাতে নিলেন রঙের কৌটা আর তুলি। আঁকতে শুরু করলেন তার বাংলোর দেয়াল থেকে। প্রথমে আঁকলেন পাখি, বিড়াল, মানুষ, উড়োজাহাজ। এভাবে আস্তে আস্তে পুরো গ্রাম জুড়ে আঁকতে থাকলেন ছবি। ছোটবেলায় যা দেখেছেন, যা ভালোবাসতেন, এসবই ফুটে ওঠে উয়াংয়ের চিত্রকর্মে। এই স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে দিতে গ্রামের রাস্তাগুলোও বাদ দেননি তিনি। রাঙিয়েছেন গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলো।
এভাবে দু’টি বছর সরকারের সাথে লড়ে তাইচুংয়ে একাই জীবন পার করে দিচ্ছিলেন উয়াং। ২০১০ সালের ঘটলো এক ঘটনা। এক পূর্ণিমা রাতে তিনি রঙের আঁচড়ে সাজিয়ে যাচ্ছিলেন তাইওয়ানের গ্রাম; এই দৃশ্য চোখে পড়ে লিং তাং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর। তিনি বেশ মুগ্ধ হন উয়াংয়ের প্রতিভা দেখে। তার সাথে কথা বলে সেই শিক্ষার্থী জানতে পারেন গ্রাম রঙ করার পেছনের গল্প। অনুধাবন করেন, একমাত্র বাসস্থান বাঁচাতে এই বৃদ্ধের লড়াইটা। তাই তিনি তাইওয়ানের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা উয়াংয়ের কাজগুলোর ছবি তুলে নেন এবং সেগুলো প্রকাশ করেন। সাথে উয়াংয়ের সাহায্যের জন্য ফান্ড চেয়ে প্রচারণাও করেন,“উয়াংয়ের ছবিগুলো যত পারুন, তত কিনুন এবং তার গ্রাম রক্ষা করার জন্য আবেদন করুন।”
তাইচুং’স কালচারাল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর প্রধান সচিব, আন্ড্রে ই-শান ইয়াং বলেন,
“জনগণ উয়াংয়ের একাগ্রতা ও ঐ শিক্ষার্থীর সাহায্যের চেষ্টা দেখে বেশ আপ্লুত হয়েছেন এবং খুব দ্রুত এটি একটি জাতীয় ঘটনা হিসেবে রূপ নেয়। তাই আমাদের সকলকে এই বিষয়ে গুরুত্ব দিতেই হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“জনগণ ভালোবেসে উয়াংকে ‘গ্র্যান্ডপা রেইনবো’ নাম দিয়েছেন। আসলে তিনি তার বাড়িটাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তার কাজটা মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। তাছাড়া এটা দাবি আদায়ের অত্যন্ত নিরীহ একটা পদক্ষেপ।“
মাত্র কয়েকমাসে তাইচুংয়ের মেয়র জনগণের কাছ থেকে ৮০ হাজার ইমেইল পান। সবগুলো মেইলে একটাই আবেদন, উয়াংয়ের বাসা বাঁচাতে হবে। তাইওয়ান সরকার বাধ্য হন, উয়াংয়ের বাসা বাজেয়াপ্ত না করতে। এবং সে বছর অক্টোবর মাসে, রংধনু দাদুর বাংলোসহ তাইওয়ানে তার চিত্রকর্ম করা সকল অলিগলি, রাস্তাঘাট ও ১১টি বাড়ি জনসাধারণের পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বর্তমানে এই রংধনু গ্রাম, তাইচুং তাইওয়ানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। সবসময় এখানে লোকের সমাগম লেগেই থাকে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ গ্রামে প্রায় ১০ লক্ষ ২৫ হাজার দর্শনার্থী এসেছেন রংধনু দাদুর রঙের কারসাজি দেখতে। সকলেই এসে আগে উয়াংয়ের বাংলো খোঁজে; রংতুলি হাতে হাস্যোজ্জ্বল রংধনু দাদুকে এক ঝলক দেখার জন্য। দাদুও কলারওয়ালা শার্ট আর চিকন একটা টুপি পরে হাসিমুখ ও রঙমাখা হাত নিয়ে করমর্দন করতে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে।
সেনাজীবনে তৈরি হওয়া ভোরে ওঠার অভ্যাসটা উয়াংয়ের এখনও আছে। তিনি প্রতিদিন ভোরে উঠে রঙের কৌটা ও তুলি নিয়ে লেগে পড়েন ছবি আঁকতে। তবে দেয়াল এখন আর তার ক্যানভাস নয়। তিনি পোস্টকার্ড তৈরি করেন রংতুলির আঁচড়ে এবং সেগুলো বিক্রি করেন দর্শনার্থীদের কাছে। এই টাকাগুলো দান করেন স্থানীয় আশ্রমগুলোতে।
রংধনু দাদু এখন আর একা নন। তার পরিবার আছে, ছেলেপুলে আছে।
২০১৩ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাইওয়ানের এই রক্ষক। সেই সময় তিনি প্রেমে পড়েন এক নার্সের এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
রংধনু দাদু শুধু জেদি যোদ্ধাই নন; বেশ রসিকও বটে। বিবাহিত জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন,
“তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার হৃদপিণ্ডে আর কোনো সমস্যা নেই। বেশ সুস্থ-সবল আছে আমার হৃদপিণ্ড, তবে ফুসফুসে মাঝে মাঝে জটিলতা দেখা দেয়।”
অতীত জীবনকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা চিত্রকর্মগুলোই বেঁচে থাকার শক্তি ও জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ দেয় রংধনু দাদুকে। তাই যতদিন পারবেন, ছবি এঁকে যেতে চান তিনি।