‘জেলখানা’ শব্দটা শোনার সাথে সাথেই আমাদের চোখে ভাসে গোটাকয়েক শিকের ভেতর আটকানো আলো-বাতাসহীন বদ্ধ বাসস্থান, আবার কারো কারো মাথায় আসে সাদা কাপড়ের উপর কালো ডোরাকাটা পোশাকসহ একদল আসামীর কথা। কেউ কেউ হয়তো স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ উপন্যাসে একবার চোখ বুলিয়ে নেন। বারবার নতুন করে আউড়াতে ভালোবাসেন,
“Hope is a good thing, maybe the best of things, and no good thing ever dies.”
কিন্তু আসলেই কি জেলখানার পরিবেশ এমন কঠিন? এই কারাবন্দী জীবনের কোথাও কি এক ফোটা স্বস্তি নেই? এর মধ্যে কি কোনো বৈচিত্র্য নেই? এ গ্রহের ভূগর্ভ থেকে তারকারাজি – সবক’টা জিনিসেই ব্যতিক্রম বলতে একটা কথা আছে। তেমনই পৃথিবীর মানচিত্রজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ব্যতিক্রমধর্মী জেলখানা, যার তথ্য রীতিমতো অবাক করে দেয়ার মতো। কেমন? চলুন, জেনে আসা যাক ভিন্নধর্মী কিছু কয়েদখানার কথা।
চ্যাম্প ডোলন প্রিজন, সুইজারল্যান্ড
জায়গাটি জেল হলেও এখানে আপনি পাবেন নিজের বাড়ির চেয়ে অধিক সুযোগ সুবিধা। আপনি আপনার পারসোনাল সিকিউরিটি রুম থেকে শুরু করে পাবেন হর্স রাইডিং, টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্টসহ সবরকম আউটসাইড গেমিংয়ের ব্যবস্থা। আবার আপনি চাইলে বরফের উপর স্কিইং করতে পারবেন, কিংবা নিজের পছন্দের খাবার বানাবার জন্য মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে যেতে পারবেন শেফ।
২০১১ সালের আগ পর্যন্ত এ জেলখানা ছিল সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জেলের একটি। অল্প পরিসরে অত্যধিক জনসংখ্যার কারনে নানারকম সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে থাকে কয়েদীরা। এ কারণে সুইস সরকার ২০১১ সালে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এই কয়েদখানাকে পরিমার্জিত করে। এরপর থেকেই জায়গাটি আগের তুলনায় বহুগুণ চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে।
অ্যারানহুয়েজ প্রিজন, স্পেন
সত্যিকার অর্থে একে জেলখানা বলার থেকে পারিবারিক পাঁচ তারকা হোটেল বলাই বোধহয় ভালো। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভিন্নধর্মী জেলের একটি, যেখানে ৩ বছরের ছোট বাচ্চারা তাদের শাস্তিপ্রাপ্ত বাবা মায়ের সাথে জেলে বসে সময় কাটাতে পারবে। এজন্য শিশুদের জন্য আলাদা করে রয়েছে ‘কিডস প্লেগ্রাউন্ড’, আর দেয়ালজুড়ে রয়েছে চোখ ধাঁধাঁনো সব ডিজনি ক্যারেক্টার। এ সকল জিনিস একজন শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
এ বিষয়ে জেল কর্তৃপক্ষের ধারণাটা এমন যে, সন্তানদের সবচেয়ে বড় শিক্ষার মাধ্যম হলো তার নিজ পিতামাতা। তাই তাদের মানসিক বিকাশের সর্বোচ্চটা অর্জনের জন্য বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটানোর বিকল্প নেই।
ঠিক কতটা প্রভাব রেখেছে এই ধারণাটা? একটা সম্যক ধারণা পেতে পারেন ভিক্টর ম্যানুয়েল লোজানো নামের এক শিশুর থেকে। ছেলেটা প্রতিদিন স্কুলে যায়, ড্রয়িং শেখে, নার্সারি রাইম আউড়ায়। আর এরপর ফেরে এই জেলখানায়, সেটাই তার পৃথিবী। কারণ, তার মা একজন খুনের আসামী আর বাবা মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত। তবে তাই বলে ভালোবাসা বুঝি বেঁধে রাখা যায়? ভিক্টরের বাবা-মায়ের পরিচয় হয় এই জেলের ভেতরেই। বাকিটা তো দেখতেই পাচ্ছেন!
ব্যাস্টয় প্রিজন, নরওয়ে
জেলখানায় কোন জিনিসটি সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষন করা হয়? নিরাপত্তা নিশ্চয়ই? কিন্তু নরওয়ের এই জেলখানা এর ব্যতিক্রম। এর সুবিশাল অঞ্চলজুড়ে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে, তা এতটাই মৃদু যে একে বলা হয় ‘Largest low security prison’।
এখানকার কয়েদীদের জন্য ব্যক্তিগত সুবিধাসহ রয়েছে চার্চ, স্কুল, কিংবা লাইব্রেরিতে বই পড়ে কাটানোর সুযোগ। এছাড়াও এখানকার কয়েদীরা নিজেদের পছন্দের খাবার নিজেরা রান্না করে খেতে পারেন। আবার এ কাজের জন্য তাদেরকে প্রতি মাসে ৯০ মার্কিন ডলার করে বেতনও দেয়া হয়।
এ কয়েদখানার আরো একটি অবাক করা তথ্য হলো, এখানে কোনো আসামীকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় না। হোক সেটা চুরি, ডাকাতি, খুন, কিংবা ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধ। জেল কর্তৃপক্ষ মনে করে, শাস্তিই কেবল সকল সমস্যার নিরসন নয়। বরং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে যেসব সাধারণ মানুষ, তাদেরকে অপরাধজগত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের আলোকবার্তা পৌঁছে দিতে চান তারা।
নর্গারহ্যাভেন প্রিজন, নেদারল্যান্ডস
দেখলে মনে হতেই পারে, এটি হয়তো কোনো ফাইভ স্টার হোটেল। জেলখানা মনে হবার কোনো সুযোগই নেই। আপনি যদি এখানকার একজন কয়েদী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য থাকছে নিজস্ব বেডরুম, ওয়াশরুম, লাইব্রেরি, এমনকি ফ্রিজ-টিভি এবং টিভিরুমে সোফার ব্যবস্থা পর্যন্ত রাখা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসে প্রায় সকল ধরনের ক্রাইম কমে আসায় তাদের জেলখানাগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কয়েদী সংকটের কারণে ২০১৫ সালে জেল কর্তৃপক্ষ নরওয়ের সাথে চুক্তি করে কিছু কয়েদীকে তাদের জেলে আনানোর ব্যবস্থা করে! শুনতে অনেকটা ‘আসামী আমদানি’ও মনে হতে পারে।
সোলেন্টিউনা প্রিজন, সুইডেন
সুইডেনে অবস্থিত এই কয়েদখানায় রয়েছে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধাসহ নিজের পছন্দসই রান্নার ব্যবস্থা। টিভিরুমে আয়েশ করে সোফায় বসে দিনরাত অলস সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন। আবার এই জেলখানায় আসামীদের জন্য আর্ট জিম রয়েছে। ইচ্ছে করলে জেলে বসেই শারীরিক কসরতটা সেরে নিতে পারবেন।
পরিশিষ্ট
ঘনবসতিপূর্ণ এই দূষিত নগরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমরা হয়তো এসব জেলখানাকে স্বর্গীয় সুখের মতো ভেবে বসতে পারি। বিনামূল্যে এতসব সুযোগ সুবিধা কিংবা মনোরম পরিবেশ… আসলেই তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু মানবজীবনে সবচেয়ে সুখকর আধ্যাত্মিক যে বিষয়টি, তা হলো ‘স্বাধীনতা’। আপনি এসব জেলখানায় বসে হয়তো সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু বেলাশেষে আপনি একজন আসামী। হ্যাঁ, অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত একজন দাগী আসামি। আপনি চাইলেই এখান থেকে বের হয়ে মানব কোলাহলে ডুব দিতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেই শহরে গিয়ে প্রিয়জনের সাথে আড্ডায় মজে যেতে পারবেন না। শত আনন্দের পরও এখানে আপনি সম্পূর্ণ একা, যার একমাত্র লক্ষ্য একটা দীর্ঘ সময় একই রুটিনে খাপ খাইয়ে নেয়া। এই সময়ের ব্যাপ্তিকাল হতে পারে ১ বছর, আবার হতে পারে ২০ বছর।
বিলাসবহুল জীবন কিংবা অর্থসম্পদ সাময়িক লালসার সৃষ্টি করলেও মানুষ আসলে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকেই ভালোবাসে, ধনসম্পত্তি কিংবা এমন শত সুযোগ-সুবিধাকে নয়। তাই নরওয়ে কিংবা সুইস জেলখানার পরিবেশ দেখে সেখানে দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের ইচ্ছা পোষণ করাটা নিতান্তই বোকামি।