দৃশ্যপট ০১
৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২০, চীন থেকে আসা বা চীনে গত ১৪ দিনে ভ্রমণ করেছেন এমন সকল পর্যটকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নিউজিল্যান্ড। ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেশটিতে প্রথম কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়, একইসাথে ইরান থেকে আগত সকল পর্যটকের ভাগ্যেও একই নিষেধাজ্ঞা জোটে। ১৫ই মার্চ কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ জন অতিক্রম করে এবং দেশটি নিজেদের সীমানা বহিরাগতদের জন্য বন্ধ করে দেয়। এর দশদিনের মাথায় দেশজুড়ে জারি করা হয় লকডাউন।
দৃশ্যপট ০২
২২শে মে থেকে ১৫ই জুন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে নতুন করে কেউ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত না হওয়ার মাঝে ৯ই জুন থেকে দেশটিতে লকডাউন তুলে দেওয়া হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবারও শুরু হয়। ১৬ই জুন ভ্রমণরত দুই ব্রিটিশ নাগরিকের কোভিড-১৯ পজিটিভ আসার পর থেকে ২২শে জুন পর্যন্ত নতুন করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ৭ জন।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সফল দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান সন্দেহাতীত। পুরো পৃথিবী যখন হন্যে হয়ে ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভের জন্য সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত, তখন এই দেশটি যে সেই সমাধান সফলভাবে খুঁজে বের করেছে এবং তা সফলভাবে প্রয়োগও করেছে, তা নির্দ্বিধায় যে কেউ স্বীকার করবে। ২৭শে মে যখন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসের জন্য মৃত্যুর সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়ালো, নিউজিল্যান্ডে তখন গত পাঁচ দিনে একজনও নতুন করে আক্রান্ত হয়নি। এমনকি সেই সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একমাত্র রোগীকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও নেয়া শুরু করে কর্তৃপক্ষ। গত ২২শে জুন পর্যন্ত দেশটিতে কোভিড-১৯ এ সর্বমোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ১,১৬৩ জন এবং মাত্র ২২ জন মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ভয়াল রুপ ধারণ করলেও নিউজিল্যান্ড আপাতত এর বিস্তার রোধ করে দক্ষতার পরিচয়ই দিয়েছে।
কিন্তু মাত্র ৭৫ দিনে কীভাবে আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাতে ফিরে যেতে পারলো দেশটির অধিবাসীরা? প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্নের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি একটি ‘দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই প্রচেষ্টা’ যার জন্য দেশটির সকল নাগরিককে ধন্যবাদ দেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের এই সফলতার মূলমন্ত্রগুলো একবার দেখে নেয়া যাক।
স্থানীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বন্ধ করা
নিউজিল্যান্ডের প্রথম লক্ষ্য ছিল, যেভাবেই হোক, সারাদেশে করোনা ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করতে হবে। ফলে লোকাল ট্রান্সমিশন বা স্থানীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বন্ধ করার জন্যই তাদের সবচেয়ে বেশি প্রচেষ্টা ছিল।
১৫ই মার্চ নিউজিল্যান্ডে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা যখন ১০০ জন অতিক্রম করলো, তখনই দেশটি নিজেদের সীমানা বন্ধ করে দেয় এবং বিদেশফেরত সকলকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা সেদিন তার বিবৃতিতে বলেন, “আমাদেরকে দ্রুততার সাথে কঠোর অবস্থানের দিকেই যেতে হবে।”
এর ১০ দিন পর দেশজুড়ে ৪ সপ্তাহের জন্য লকডাউন জারি করা হলেও তা পরবর্তীতে ৭৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই দীর্ঘ সময়ে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান, ফার্মেসি, হাসপাতাল এবং গ্যাস স্টেশন খোলা ছিল। গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়, নিজের বাসা ব্যতীত অন্য কোথাও যাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সীমিত আকারে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল চালু থাকে।
দ্রুততার সাথে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে দেশটিতে করোনা ভাইরাসের বিস্তারও সীমিত হতে শুরু করে। দেশটির ৯০% মানুষ নিজেদের চলাচল কমিয়ে দেয়। লকডাউন দেয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে ‘R0’ (আর নট) এর মান ২.৫ থেকে কমে ০.৪ হয়ে যাওয়া এরই প্রমাণ। ( R0 হলো একটি রোগ কতজনের মাঝে সংক্রমিত হতে পারে তার মানদণ্ড, যা ১ এর বেশি হলে রোগটি মহামারী হবে।)
জনগণের সাথে যথাযথ যোগাযোগ
লকডাউন শুরু হওয়ার আগে দেশটির সকল নাগরিকের ফোনে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি মেসেজ পাঠানো হয় এবং সেখানে বলা হয়, ২৪শে মার্চ রাতে তারা যেখানে অবস্থান করবেন, সেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার কোনো সুযোগ কারো থাকবে না এবং পরদিন থেকে সারাদেশে লেভেল-৪ এর অ্যালার্ট জারি করা হয়। মেসেজে আরো বলা হয় সরকার জনগণের উপর আস্থা রাখছে যেন সকলে নিয়ম মেনে চলে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলার পাশাপাশি এটাও বলা হয় যেন সকলে নিজেদের বাসায় থাকে, নিজের পরিবার বাদে আর কারো সাথে দেখা না করে। কয়েক সপ্তাহের জন্য আগাম প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে বলা হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য নিউজিল্যান্ড সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিনিয়ত মেসেজ পাঠানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা নিজে প্রত্যেকদিন করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে জনগণকে আপডেট দেন। এমনকি নিয়মিত ফেসবুক লাইভে এসে সবাইকে বাসায় থাকার জন্য অনুরোধও করেন। নিউজিল্যান্ডের জনগণও আস্থা রাখেন প্রধানমন্ত্রীর কথায়।
টেস্টিং এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডার দেয়া তথ্যমতে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজার জন করে টেস্ট করার সক্ষমতা নিউজিল্যান্ডের আছে, যা জনসংখ্যা অনুযায়ী পরীক্ষার দিক থেকে অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন লক্ষের উপর টেস্ট সম্পন্ন করেছে তারা। শ্বাসতন্ত্রের যেকোনো সমস্যা থাকলেই টেস্ট করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, পাশাপাশি দেশজুড়ে গণহারে পরীক্ষা করার ব্যাপারেও সরকার উদ্যোগ নেয়।
শুধু পরীক্ষা নয়, এর পাশাপাশি কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যাপারে আলাদা তহবিল গঠন করে বানানো হয় নিউজিল্যান্ড কোভিড ট্রেসার নামক মোবাইল অ্যাপ, যা গত ২০শে মে যাত্রা শুরু করে। সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়াতে অনেক আগেই এই অ্যাপ ছাড়া হয়েছিল, নিউজিল্যান্ডে দেরিতে ছাড়া হলেও ফলাফল অতি দ্রুতই দেখা দেয়। ফলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা সবাইকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করা সম্ভব হয় এবং দরকার হলে আইসোলেশনেও পাঠানো হয়। এছাড়াও পরবর্তীতে যদি কখনো করোনা ভাইরাস ছড়ানো শুরু করে, তখনও এই অ্যাপ এর সাহায্যে কনট্যাক্ট ট্রেসিং করে তা বন্ধ করা সম্ভব। অর্থাৎ শুধুমাত্র বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের জন্যও এই মোবাইল অ্যাপ অনেক উপকারী।
ভৌগলিক অবস্থান এবং জনসংখ্যার নিম্ন-ঘনত্ব
নিজেদের ভৌগলিক অবস্থান একরকম আশীর্বাদ হয়ে ওঠে এই দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য। তাই অন্য রাষ্ট্রের মতো নিজেদের স্থল সীমানা দিয়ে কোভিড-১৯ এর প্রবেশ নিয়ে বেশি চিন্তাও করতে হয়নি তাদের। এছাড়াও আকাশ এবং নৌপথে দেশে আসা ভ্রমণকারীদের জন্য ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনকে অবহেলা করার সুযোগ কেউ পায়নি।
বিশাল দেশটির প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৪৭ জন লোক থাকাও একটা বড় সুবিধা তাদের জন্য, কেননা এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের সংক্রমণ আটকানো আরো সুবিধাজনক হয়ে যায় দেশটির সরকারের জন্য। রাজধানী ওয়েলিংটন এবং অকল্যান্ডের মতো বড় শহর বাদে বাকি সব শহরের মানুষের জন্য সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাটা সহজ বৈকি!
অর্থনৈতিক দূরদর্শীতা
করোনাকালে দেশের জনগণ যেন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে, সেজন্য স্বাস্থ্যখাতকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় জেসিন্ডা আর্ডার্নের সরকার। জেসিন্ডা তার ও তার সরকারের সকল মন্ত্রীর বেতন ২০% কমিয়ে দেন। স্বাস্থ্যখাতে বাড়ানো হয় বরাদ্দ। নিজেদের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ সমান আইসিইউ থাকার পড়েও বাড়ানো হয় আইসিইউ এর সংখ্যা। ডাক্তারদের জন্য নিশ্চিত করা হয় উচ্চমানের পিপিই।
এছাড়াও লকডাউনের সময় বন্ধ থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩ বিলিয়ন নিউজিল্যান্ড ডলারের একটি বিল সংসদে পাশ করা হয়। নিউজিল্যান্ডের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করোনার ফলে দেশটির মোট জিডিপি ৬% কমে যাওয়ার আশংকা করলেও লকডাউন দেয়া থেকে ওঠানোর পর পর্যন্ত মাত্র ৩.৮% ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অর্থাৎ করোনা তাদের অর্থনীতিতে অতি সামান্য প্রভাবই ফেলেছে, যেখানে অন্য দেশগুলোর বেলায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
আগে থেকেই অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়া বা ভৌগলিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা, এমন সব সুবিধা থাকার পরেও নিউজিল্যান্ডের করোনা মোকাবিলার কৌশলগুলো দেশটিকে পৃথিবীর সব দেশের জন্যই রোল মডেল করে তুলেছে। টাইম-এ নিউজিল্যান্ডের কৌশলগুলোকে একসময় ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ ও ‘ব্যয়বহুল’ বলা হলেও এখন এটা স্পষ্ট, কখনো কখনো সফলভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ব্যয়বহুল হওয়াটাই জরুরি।