লন্ডনের লিয়াম উইলেট, প্রতিদিন ভোরে আরম্ভ হয় তার কাজ। এক সম্পদশালী পরিবারের ন্যানি (বাচ্চা দেখাশোনার কাজ করেন যারা) উইলেট আটটা বাজতে না বাজতেই তাদের দুই বাচ্চাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করান। এরপর বড়জনকে নিয়ে যান স্কুলে, আর ছোটজনকে সাথে করে যান পার্কে হাঁটতে। বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি যা যা লাগে সবই উইলেট করেন সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। আর করবেনই না বা কেন! তিনি যে প্রসিদ্ধ নরল্যান্ড কলেজের একজন গ্র্যাজুয়েট, যাদের জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকে এমনকি রাজপরিবারও।
নরল্যান্ড কলেজ
যুক্তরাজ্যের সমারসেটের বাথে এই কলেজের অবস্থান। কেবল ন্যানিদের প্রশিক্ষণ দিতেই এই কলেজের প্রতিষ্ঠা। বহু নামীদামী মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য নরল্যান্ড কলেজের সার্টিফিকেটধারী ন্যানিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। প্রিন্স উইলিয়ামের তিন ছেলে-মেয়ে জর্জ, শার্লট আর লুইয়ের ন্যানি মারিয়া বোরাল্লো (Maria Borrallo) এখানকারই এক গর্বিত গ্র্যাজুয়েট।
ভিক্টোরিয়ান যুগের ব্রিটিশ এক ভদ্রমহিলা, এমিলি ওয়ার্ড, ১৮৯২ সালের অক্টোবরে কলেজের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। তখনকার দিনে শিশু বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করতেন তাদের মধ্যে এমিলি ছিলেন প্রথমসারির। তিনি লক্ষ্য করেন, মূলত ধনী সমাজে প্রচলিত শিশু লালনপালনের পদ্ধতিতে ত্রুটি আছে। এসব পরিবারের গৃহভৃত্যরাই বাচ্চার দেখাশোনা করেন, তবে ঘরবাড়ির অন্যান্য কাজের ভিড়ে এই বিষয়টা তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। তদুপরি শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য ঠিক কীভাবে তাদের বড় করা উচিত সেই সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে তাদের।
এমিলি চিন্তা করলেন, কেবল বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য দক্ষ একদল পেশাজীবী তৈরি করলে কেমন হয়? যেই ভাবনা সেই কাজ, তিনি নরল্যান্ড কলেজ স্থাপন করলেন। জার্মান এক চিকিৎসক, ফ্রোবেলের মতাদর্শ তাকে অনুপ্রাণিত করে, যিনি মনে করতেন জন্মের পর থেকেই শিশুর সঠিক বিকাশ ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ১৯৩০ সালে তার মৃত্যু হলেও বিকশিত হতে থাকে তার প্রতিষ্ঠিত কলেজ।
ভর্তি প্রক্রিয়া
বেশ কঠিন ভর্তি প্রক্রিয়া পূরণ করতে হয় কলেজের জন্য। লেখাপড়ার নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড মিললেই কেবল ভর্তির আবেদন করা যায়, তারপরেও শতকরা ত্রিশ ভাগ আবেদনকারী বাদ পড়ে যান প্রাথমিক বাছাইয়েই। যারা টেকেন, তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় ইন্টারভিউয়ে। কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল ড. জ্যানেট রোজ জানান, প্রত্যেক ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীকে এককভাবে একটি বোর্ডে ভাইভা দিতে হয়। এরপর দলগতভাবে আরেকটি প্রেজেন্টেশন থাকে। বর্তমানে সাধারণত ১০০ আসনের বিপরীতে প্রার্থী ভর্তি করা হয়।
যদিও নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নেই, তারপরও যেহেতু ন্যানির কাজটা সাধারণত নারীরাই করে থাকেন, তাই ভর্তির জন্য আবেদন তারাই করে। তবে ইদানীং পুরুষরাও আসছে এই কলেজে। আগেই বলা হয়েছে উইলেটের কথা। সে এবং হ্যারি প্র্যাট নামে দুজন ২০১৮ সালের গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত। তাদের ছয় বছর আগে মাইকেল কেনি নামে আঠার বছরের একজন সর্বপ্রথম পুরুষ হিসেবে নরল্যান্ড কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন।
শিক্ষা কার্যক্রম
মনে করছেন- কী এমন শেখায় ন্যানিদের এই কলেজ? জেনে রাখুন, তাদের দেয়া হয় তিন বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি, যার সাবজেক্ট প্রাথমিক শিশু বিকাশ। যেনতেন ডিগ্রি নয়, রীতিমতো ইউনিভার্সিটি অব গ্লস্টারশায়ার থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রি। এর মধ্যে শিশু সাইকোলজি, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে বিশদভাবে পড়ানো হয়। চতুর্থ বছরে তাদের দেয়া হয় হাতে-কলমে কঠিন প্রশিক্ষণ, যার সমাপ্তিতে আলাদা করে একটি ডিপ্লোমাও প্রাপ্ত হন তারা।
ঠিক কীভাবে প্রস্তুত করা হয় তাদের? প্রথমেই ধরিয়ে দেয়া হয় একটি যান্ত্রিক পুতুল, যা কিনা যেকোনো মানবশিশুর মতো আচরণ করে। এই পুতুলকে শিক্ষার্থীরা পরিচর্যা করেন, তাদের আবার পর্যবেক্ষণ করেন শিক্ষকেরা। এমনকি রাতে বাসাতেই পুতুল নিয়ে যেতে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের, যাতে রাতবিরেতে বাচ্চা কাঁদলে কীভাবে শান্ত করতে হবে সেই প্র্যাক্টিসও হয়ে যায়। নরল্যান্ড ন্যানির জানতে হয় অবাধ্য বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কী করে। কোন বয়সে কী খেলাধুলা ভালো সেটাও থাকে তাদের পাঠ্যসূচিতে। বাচ্চার জন্মদিন, স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে পার্টি? নরল্যান্ড ন্যানি প্রস্তুত থাকে অল্প সময়ের নোটিশে সব ঠিকঠাক করার জন্য।
মনে রাখতে হবে, কেবল অতিধনী এবং রাজপরিবারের সদস্যরাই নরল্যান্ড ন্যানির খরচ যোগাতে সক্ষম। এসব পরিবারের বাচ্চাদের আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। ন্যানিরাও যাতে তাদের রক্ষা করতে ভূমিকা রাখতে পারেন সেজন্য সম্প্রতি কলেজে চালু হয়েছে আলাদা কোর্স, যা পরিচালনা করেন ব্রিটিশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের অফিসারেরা। তিন ঘন্টার সেলফ-ডিফেন্স কোর্সও করতে পারেন তারা একজন তায়কোয়ান্দো এক্সপার্টের অধীনে।
কলেজের খরচ চালানো কিন্তু কঠিন কাজ। প্রথম বছরে কেবল কোর্স ফি হিসেবেই যাবে ১৪,৮৫০ পাউন্ড, পরের বছর বাড়ে বৈ কমে না। এর বাইরে রেজিস্ট্রেশন ফি, বইপত্র, ইউনিফর্ম ইত্যাদির আলাদা খরচ তো আছেই।
কেমন আয় করেন তারা?
নরল্যান্ড কলেজ থেকে প্রতি বছর ১০০ জন গ্র্যাজুয়েট বের হন। কারো ঘরে নরল্যান্ড ন্যানি আছে এটাই উঁচুতলায় একটা স্ট্যাটাস সিম্বল। কাজেই রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় তাদের নিয়ে, প্রত্যেকের জন্য অন্তত ১৪টি কাজের সুযোগ থাকে! তবে কেবল ধনী পরিবারগুলোই তাদের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে পারে, আর নরল্যান্ড কলেজে প্রতিষ্ঠা হয় তাদের কথা ভেবেই। বাথ, যেখানে কলেজের ক্যাম্পাস, সেই এলাকা ইংল্যান্ডের বনেদী আর সম্পদশালী পরিবারের আবাস।
বেতন? যুক্তরাজ্যের একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার গড়ে যা আয় করেন, নরল্যান্ড ন্যানিরাও তার থেকে কম যান না। সপ্তাহে ১,৫০০ পাউন্ড তো কেবল শুরু। লন্ডনে বছরে ৩৫,০০০ থেকে ক্ষেত্রভেদে ৬০,০০০ পাউন্ড কামাতে পারেন এই ন্যানিরা, যা যুক্তরাজ্যের মাথাপিছু আয় থেকে বেশি। সাধারণ ন্যানিরা এর ধারেকাছেও নেই।
ঠিক কী কী কাজ করেন তারা? কলেজের এক কর্মকর্তা জুলিয়া গ্যাস্কেল জানিয়েছেন- এটা নির্ভর করে পরিবারের উপর। কেউ কেউ নয়টা পাঁচটা সময়ের জন্য সার্ভিস দেন, অনেকে একেবারে চব্বিশ ঘন্টাই থাকেন পরিবারের সাথে।কেউ কেউ আবার বিশেষায়িত সেবা প্রদান করেন, যা শিশুর ছয় সপ্তাহ থেকে তিন মাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
ব্রিটিশ রাজপরিবার নরল্যান্ডের ন্যানিদেরকেই সাধারণত নিয়োগ দিয়ে আসছে। এর বাইরে বিনোদন জগতে তারকারাও তাদের সার্ভিস নেন, যেমন- ব্রিটিশ ব্যান্ড রোলিং স্টোনসের অন্যতম সদস্য স্যার মিক জ্যাগার ও তার প্রাক্তন স্ত্রী জেরি হল তাদের সন্তান লিজি আর জেমসের জন্য নরল্যান্ড ন্যানি নিযুক্ত করেছিলেন।
বাচ্চাদের বিভিন্ন ভাষাশিক্ষা, নানারকম খেলাধুলার তালিম দেয়া ইত্যাদিতে নরল্যান্ড ন্যানির জুড়ি নেই। বলা হয়, শিশুদের এমন কিছু নেই যেটা নরল্যান্ড ন্যানি ম্যানেজ করতে পারেন না। তাদের প্রশিক্ষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ের, এবং কাজকর্মেও সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়।