সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে মোট কয়টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?

১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক ফেডারেশন–রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং বৃহৎ রাষ্ট্রটির ভূমি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সামগ্রিকভাবে, এই অঞ্চলকে ‘উত্তর–সোভিয়েত অঞ্চল’ (post-Soviet space) হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গঠিত রাষ্ট্রগুলোকে উত্তর–সোভিয়েত রাষ্ট্রসমূহ (post-Soviet states) হিসেবে অভিহিত করা হয়। সোভিয়েত ফেডারেশনের পতনের পর উত্তর–সোভিয়েত অঞ্চলে ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অঞ্চলটিতে আরো অন্তত ৬টি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থলে বর্তমানে রয়েছে মোট ২১টি কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সৃষ্ট সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রটি হচ্ছে রাশিয়া। বাল্টিক সাগরের তীর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে অবস্থিত রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র (successor state)। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব অধিকার ও দায়বদ্ধতা ছিল, সেগুলো (যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী সদস্যপদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব) বর্তমানে রাশিয়ার ওপর ন্যস্ত।

মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রসমূহ; Source: Wikimedia Commons

বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সেসময় বাকি যে ১৪টি রাষ্ট্র গঠিত হয়, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পূর্বে সেগুলো তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমান রাশিয়া যেহেতু নিজেকে রুশ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সভ্যতাগত উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে, সেহেতু এই বাকি ১৪টি রাষ্ট্রকে রাশিয়া নিজস্ব ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অ–রুশ ভূখণ্ডগুলোকে রাশিয়া একত্রিতভাবে ‘নিকট বিদেশ’ (near abroad) হিসেবে অভিহিত করে এবং নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।

এই ‘নিকট বিদেশে’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত পূর্ব স্লাভিক রাষ্ট্র ইউক্রেন ও বেলারুশ এবং কার্যত রুমানীয় রাষ্ট্র মলদোভা। বাল্টিক অঞ্চলে অবস্থিত তিনটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া এবং এস্তোনিয়াও এই ‘নিকট বিদেশে’র অংশ। অনুরূপভাবে, ট্রান্সককেশাস বা দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত আজারবাইজান এবং স্বতন্ত্র সভ্যতার অধিকারী জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া এই ‘নিকট বিদেশে’র অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি, মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং বৃহত্তর ইরানি জাতিভুক্ত তাজিকিস্তান এই ‘নিকট বিদেশে’র অংশ। ১৯৯০–১৯৯১ সালে রাশিয়ার পাশাপাশি এই ১৪টি রাষ্ট্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

মানচিত্রে প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, দক্ষিণ ওসেতিয়া, আবখাজিয়া ও আর্তসাখ (লাল চিহ্নিত)। এগুলো কার্যত স্বাধীন, কিন্তু জাতিসংঘের সদস্য নয়; Source: Wikimedia Commons

এই ১৫টি রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। অর্থাৎ এগুলো আইন (de jure) এবং কার্যত (de facto) স্বাধীন। অবশ্য এক্ষেত্রে আর্মেনিয়া কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম, কারণ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র পাকিস্তান আজারবাইজানি–আর্মেনীয় দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই ১৫টি রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও আইনত রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র উত্তরসূরী।

উল্লেখ্য, এই ১৫টি রাষ্ট্রের বাইরেও উত্তর–সোভিয়েত অঞ্চলে আরো অন্তত ৬টি রাষ্ট্র রয়েছে, যারা কার্যত স্বাধীন। কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলো হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেনি, নয়তো খুব কম সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অর্থাৎ, এগুলো কার্যত (de facto) স্বাধীন হলেও আইনত (de jure) স্বাধীন নয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনে এই রাষ্ট্রগুলোকে উত্তর–সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর কোনো কোনোটির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত পূর্ব স্লাভিক রাষ্ট্র প্রিদনেস্ত্রোভিয়া (ইংরেজিতে ট্রান্সনিস্ত্রিয়া), দনেৎস্ক ও লুগানস্ক এবং দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত আর্মেনীয় রাষ্ট্র আর্তসাখ, বৃহত্তর ইরানি জাতিভুক্ত রাষ্ট্র দক্ষিণ ওসেতিয়া ও উত্তর–পশ্চিম ককেশিয়ান জাতিভুক্ত আবখাজিয়া।

মানচিত্রে পূর্ব ইউক্রেনে অবস্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্র দনেৎস্ক ও লুগানস্ক; Source: Wikimedia Commons

সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির আগেই ১৯৯১ সালে প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, আর্তসাখ ও দক্ষিণ ওসেতিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এদের মধ্যে প্রিদনেস্ত্রোভিয়া মলদোভার কাছ থেকে, আর্তসাখ আজারবাইজানের কাছ থেকে এবং দক্ষিণ ওসেতিয়া জর্জিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে আবখাজিয়া জর্জিয়ার কাছ থেকে এবং ২০১৪ সালে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব সরকার, সংবিধান, আইনসভা, সশস্ত্রবাহিনী, রাষ্ট্রীয় পতাকা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রসূচক অন্যান্য সকল উপাদানই রয়েছে, এবং নিজস্ব ভূখণ্ডের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও রয়েছে।

কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলো ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেনি। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া জাতিসংঘের ৫টি সদস্য রাষ্ট্র (রাশিয়া, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও নাউরু) এবং আর্তসাখ ও প্রিদনেস্ত্রোভিয়ার স্বীকৃতি লাভ করার পাশাপাশি পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, আর্তসাখ, দনেৎস্ক ও লুগানস্ক জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেনি। প্রিদনেস্ত্রোভিয়া স্বীকৃতি পেয়েছে কেবল আর্তসাখ, আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়ার কাছ থেকে; আর্তসাখ স্বীকৃতি পেয়েছে কেবল প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়ার কাছ থেকে; আর দনেৎস্ক ও লুগানস্ক স্বীকৃতি পেয়েছে কেবল দক্ষিণ ওসেতিয়া ও পরস্পরের কাছ থেকে। এর ফলে রাষ্ট্রগুলো কার্যত স্বাধীন হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিংহভাগ তাদেরকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকার করে না।

তদুপরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত চেচনিয়া ও তাতারস্তান, ইউক্রেনের ক্রিমিয়া এবং মলদোভার গাগাউজিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু বর্তমানে অঞ্চলগুলো হয় তাদের মূল রাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৪ সালে তাতারস্তান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়, ১৯৯৫ সালে গাগাউজিয়া মলদোভার অন্তর্ভুক্ত হয়, ২০০০ সালে চেচনিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। এর ফলে এগুলো এখন আর কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। এজন্য সামগ্রিকভাবে, উত্তর–সোভিয়েত অঞ্চলে কার্যত ২১টি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে।

Related Articles

Exit mobile version