ছোটবেলা থেকেই আমরা পাঠ্যবইয়ে পড়ে এসেছি, সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। কিন্তু বড় হতে হতে আমরা দেখেছি, শুধু প্রাকৃতিকভাবে নয়, জাপান আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং উন্নয়নের কিরণ ছড়াচ্ছে চারদিকে। এসবের সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি এবং জাপানিদের অমায়িক ব্যবহার দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একটু খবরাখবর খেয়াল করলেই দেখা যাবে, জাপান তাদের নিজস্ব সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে এবং তারা এমন প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে, যাতে যেকোনো সময় তারা যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত থাকে। এতটুকু পড়ে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোনো দেশের সামরিক শক্তি থাকা এবং সেটি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি তো এমন কোনো আহামরি খবর নয়। তাহলে একে এত বড় সংবাদ বলা হচ্ছে কেন?
কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর থেকে জাপানের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। ধংসাত্মক এবং সহিংসতার পথ থেকে সরে এসে তারা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উন্নয়নে মনোযোগ দিতে চেয়েছিল এবং এতে তারা সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন তারা সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো? জাপান কি তাদের চিরচেনা শান্তিপ্রিয় মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বের অন্যান্য সুপার পাওয়ারদের মতো বল প্রদর্শনকে কৌশল হিসেবে নিতে যাচ্ছে? আমরা কি ভবিষ্যতে নতুন কোনো সুপার পাওয়ারের উত্থানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি?
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা: দ্য ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি
জাপানিরা খুবই শান্তিপ্রিয় এবং অমায়িক চরিত্রের অধিকারী কিন্তু এই মানসিকতা তারা হাজার বছর ধরে লালন করে আসেনি। কার্যত এই পরিবর্তন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খুবই আকস্মিকভাবে এসেছে। আজকের জাপানকে দেখলে মনেই হয় না যে, এরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনীর সবচেয়ে মারাত্মক, দক্ষ এবং বর্বর বাহিনীগুলোর একটি ছিল।
অথচ তারাই পার্ল হারবারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে সমালোচিত ঘটনার জন্ম দেয়। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্রপক্ষে যোগদানের মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে আসে। এরপর জাপানি সেনাবাহিনীর সহিংসতার চিত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই দেখা যায়।
তখনকার জাপানি সামরিক বাহিনীর নাম ছিল ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ মিলিটারি’। সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পেছনে যে লোকটির মাথা ছিল, তিনি জাপানের সম্রাট হিরোহিতো। তিনিই মূলত জাপানকে একটি শক্তিশালী মিলিটারি শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে পড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি নিজ দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে আসছিল।
আর তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল চীন। চীনাদেরকে জাপানিরা খুবই ছোট চোখে দেখতো। এরই ফলস্বরূপ ১৯৩১ সালে তারা জাপান-চীনের মধ্যবর্তী মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে আক্রমণ করে এবং ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ১৯৪৫ সালে রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার যৌথ অভিযানের আগপর্যন্ত মাঞ্চুরিয়া জাপানের অধীনে ছিল।
এরপরই আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, যেখানে তারা লুটপাট, গণহত্যা, মানব পরীক্ষণ, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যাকান্ড, নরমাংসভক্ষণ, জোরপূর্বক শ্রম আদায়, যৌন দাসত্ব– এমন কিছু নেই যা তারা বাদ রেখেছিল। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আগপর্যন্ত ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
যুদ্ধ-পরবর্তী জাপান
১৯৩৯ সাল থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এই বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি। যেখানে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই, নেই কোনো নিশ্চয়তা। শুধু মারামারি, আর হানাহানি। এই যুদ্ধ অনেক ক্ষেত্রেই পৃথিবীকে একটি নতুন সূচনার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ হয়তো আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারতো, যদি না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদম শেষে এসে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাধ্যমে পুরো দুনিয়াকে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং ভয়াবহতম আবিষ্কারের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিত। এই একটি ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা মানব সভ্যতাকে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে যে, হত্যা, সহিংসতা কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের পথ হতে পারে না।
বাকি সবার মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা জাপানিদেরকেও দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল। এমন ভয়াবহতা আর নয়– এই আদর্শ নিয়ে তারা সামনের দিকে এগোনোর প্রতিশ্রুতি নেয়। সেই সময়কার জাপানের সিংহভাগ মানুষ ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মির ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমকে সমর্থন করেনি। কিন্তু তখনকার জাপানের রাজনৈতিক অবস্থা বেশ টালমাটাল ছিল এবং ইম্পেরিয়াল আর্মি সরাসরি সম্রাটের নির্দেশে কাজ করতো। তাই তখনকার সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মিকে আটকাতে পারেনি, যার ফল ভোগ করতে হয়েছে হিরোশিমা-নাগাসাকিসহ জাপানের আপামর সাধারণ জনগণকে।
জাপানের আধুনিক এবং অনন্য সংবিধান
আত্মসমর্পণের পরপরই জাপান নতুন করে তাদের নীতিমালা প্রণয়নে হাত দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই জাপান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার আভাস দিচ্ছিলো, যা যুদ্ধের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই জাপানের মানুষের শান্তিপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে তারা নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। এ সংবিধানকে ‘প্যসিফিস্ট কন্সটিটিউশন’ বা শান্তিবাদের সংবিধান বলা হয়ে থাকে, যা ১৯৪৭ সাল থেকে জাপানে কার্যকর করা হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরুর এ পুরো প্রক্রিয়ায় জাপানের সাথে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের মধ্যবর্তী বিভিন্ন কনফারেন্সে চার সুপার পাওয়ার- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং চীন একত্রে জাপানের সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা করে এবং আত্মসমর্পণের পর তারা একত্রে ‘সুপ্রিম কমান্ড অব অ্যালাইড পাওয়ার্স’ নামের একটি জোট গঠন করে। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সেনাপ্রধান ডগলাস ম্যাকআর্থারকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ম্যাকআর্থারই আধুনিক জাপানের রূপরেখা অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নে মূল ভূমিকা পালন করেন।
আর শান্তিবাদ সংবিধানের আর্টিকেল ৯ এ জাপানের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয়, যেখানে জাপানকে যেকোনো ধরনের যুদ্ধের আহ্বান এবং যুক্ত হওয়া থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। আর্টিকেলের শিরোনামেই ব্যাখ্যা করা আছে,
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহী জাপানী নাগরিকরা দেশটির সার্বভৌম অধিকারবলে আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় হিসাবে হুমকি বা যুদ্ধের ব্যবহারকে চিরতরে ত্যাগ করবে। অন্যান্য সম্ভাবনা বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাপান কখনোই ভূমি, সমুদ্র ও আকাশরক্ষা বাহিনীর সৃষ্টি বা রক্ষণাবেক্ষণ করবে না। এহেন কোনো কার্যক্রম কখনোই রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত হবে না।
এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জাপানকে সম্পূর্ণ সশস্ত্রবাহিনী মুক্ত করা হয়। শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য জাপানকে একটি প্যারা-মিলিটারি ‘সেলফ ডিফেন্স ফোর্স (এসডিএফ)’ গঠনের বিধান রাখা হয়, যারা শুধুমাত্র জাপানের অভ্যন্তরে কার্যক্রম চালাবে এবং শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে সহিংসতায় যুক্ত হতে পারবে।
কেন অর্থনৈতিকভাবে দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশটির কোনো মিলিটারি নেই?
আত্মসমর্পণ এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জাপানের নৃশংস ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মিকে নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু প্রতিনিয়তই বহিঃশত্রুর কাছ থেকে সুরক্ষার ব্যাপারটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, যা ১৯৫১ সালে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হওয়া ‘সানফ্রান্সিস্কো শান্তি চুক্তি’র মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, যেকোনো ধরনের বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে জাপান এবং জাপানের মানুষকে রক্ষা করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর বদলে তারা জাপান এবং পূর্ব-এশিয়ায় শান্তি রক্ষার্থে জাপানে নৌ এবং সেনাবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
বর্তমান অবস্থা
বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের শান্তিপূর্ণ সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক-সশস্ত্র চুক্তির মধ্যমেই চলে আসছিল। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরেই বর্তমান জাপান সরকারের কাছ থেকে এ চুক্তিকে পরিবর্তন অথবা বাতিল করার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তারা নিরাপত্তার জন্য সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আর ভরসা রাখতে পারছে না।
কারণ এখন জাপান এশিয়ার একমাত্র উন্নত দেশ নয়, প্রতিবেশী দেশ চীনের সাথে তদের বৈরিতার সম্পর্ক প্রতিদিনই নিত্যনতুন আশংকা তৈরি করছে। এ অবস্থায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং তার মন্ত্রীসভা সংবিধানের “শান্তিবাদ” বিষয়টিকে বাদ দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। জাপানিরা ক্রমশই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, যেকোনো সময় চীনের সাথে তাদের যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এজন্য তাদের নিজস্ব সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী আবশ্যক।
যদিও শিনজো আবে এখনও সংবিধান পরিবর্তনে সক্ষম হননি, কিন্তু তার সরকার ইতোমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবিমান এবং রণাঙ্গনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি ও আমদানির মাধ্যমে সেলফ ডিফেন্স ফোর্সকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একইসাথে মাথাব্যথার কারণ এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর চীন তো অনবরত তাদের হুমকি অব্যাহত রেখেছেই।
দুই প্রতিবেশীর এমন সাপে-নেউলে সম্পর্কের কারণে আমরা মনে হয় খুব শীঘ্রই এশিয়ায় একটি ক্ষমতার মেরুকরণের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।