জগতবিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পোর্শের সত্তর বছর পার হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। প্রতিষ্ঠানটি মুগ্ধতা ছড়ানো ডিজাইন আর নানা রকমের অসাধারণ সব গাড়ি দুনিয়াকে উপহার দিয়ে চলছে সুদীর্ঘ সত্তর বছর ধরে। বেশ কিছু মডেলের গাড়ি পেয়েছে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা।
গাড়ি নির্মাতা হিসেবে পোর্শের শুরু না হলেও, এই সময়ে এসে সব ধরনের গাড়ি তৈরির ব্যবসায় শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম পোর্শে। কালজয়ী এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত ফার্দিনান্দ পোর্শে ও একে এগিয়ে নেনে তার ছেলে ফেরি পোর্শে। এর সাথে শুরুতে আরেকজন ব্যক্তির আনুকূল্য পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তিনি অ্যাডলফ হিটলার।
এবার চলুন জানা যাক পোর্শের দীর্ঘ পথচলার কিছু অংশ।
ফার্দিনান্দ পোর্শে: পোর্শের স্বপ্নদ্রষ্টা
পোর্শের স্বপ্নদ্রষ্টা ফার্দিনান্দ পোর্শের জন্ম ১৮৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বোহেমিয়ায়, যা এখন পড়েছে চেক প্রজাতন্ত্রে। তিনি অস্ট্রো-ডেমলার কোম্পানির পরিচালক হিসেবে জার্মানির স্টুটগার্টে স্থানান্তরিত হন। ১৯১৬ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কাজ করেন। ১৯৩১ সালে তিনি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন এবং স্পোর্টস কার ও রেসিং কার ডিজাইনে মনোযোগ দেন। এর আগে তিনি ১৮৯০ সালে একদমই তরুণ বয়সে প্রথম ইলেকট্রিক/গ্যাসোলিন হাইব্রিড ডিজাইন করেছিলেন। তারপর কর্মজীবনে ড্যামলার, মার্সিডিজ, ড্যামলার-বেঞ্জ, ভক্সওয়াগন, অটোনিয়ন এর মতো বিখ্যাত কোম্পানিতে কাজ করেছেন সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর।
সর্বশেষ কর্মস্থল ডেমলার ছেড়ে তিনি তিনি ১৯৩১ সালে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জার্মান শাসক অ্যাডলফ হিটলারের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিজেও নাজি পার্টির সদস্য ছিলেন। পোর্শে হিটলারের ‘পিপলস কার’ প্রকল্পেও যুক্ত ছিলেন, যেটি ছিল হিটলারের একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। হিটলারের উদ্যেগ ও পরিকল্পনায় ১৯৩১ সালে তৈরি হওয়া ব্যাপক জনপ্রিয় ভক্সওয়াগন বিটলের ডিজাইনেও ছিল তার নিজস্ব গাড়ি ডিজাইন প্রতিষ্ঠানের অবদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোর্শে ও তার প্রতিষ্ঠান, ট্যাংক সহ বিভিন্ন সামরিক যান ও নানা ধরনের অস্ত্রাদি ডিজাইনেও ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি গ্রেফতার হন ও ফ্রান্সের দিজন কারাগারে তাকে বেশ কিছুকাল বন্দী রাখা হয়। পোর্শের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে এই সময়টাতেই, ফার্দিনান্দ পোর্শের ছেলে ফেরি পোর্শের হাত ধরে।
ফেরি পোর্শে ও পোর্শের দ্বিতীয় উত্থান
ফেরি পোর্শে তার বাবার কোম্পানিতে প্রথমে ড্রাফটসম্যান ও পরীক্ষামূলক চালক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফার্দিনান্দ পোর্শের সাথে ফেরি পোর্শে যদিও গ্রেফতার হয়েছিলেন, তবে কিছুদিন পরই তিনি ছাড়া পান। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভক্সওয়াগন কোম্পানি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ফার্দিনান্দ পোর্শেকে তার পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বদলে ইভান হার্স্ট নামক একজন ব্রিটিশ মেজরকে তার পদে বসানো হয়।
সেই বছরই ১৫ ডিসেম্বর পোর্শে গ্রেফতার হন। তিনি প্রায় বিশ মাসের মতো বন্দী থাকেন। বাবাকে ছাড়া ফেরি যদিও খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তবু সেই সময়টাতেই ফেরি পোর্শে নিজস্ব গাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ফার্দিনান্দ মুক্তি পান। ১৯৪৮ সালে অবমুক্ত করা হয় পোর্শে কোম্পানির প্রথম গাড়ি পোর্শে ৩৫৬। পোর্শের প্রথম বিক্রি হওয়া গাড়ির মডেল ছিল এটিই।
পোর্শে ৩৫৬: পোর্শের প্রথম গাড়ি
পোর্শে ৩৫৬ অবমুক্ত করার আগে আরো একটি গাড়ি বানিয়েছিল, যেটি ছিল ৩৫৬/১। শুধুমাত্র একটি গাড়িই বানানো হয়েছিল এই মডেলের, যা ডিজাইন করেছিলেন পোর্শের কর্মকর্তা এরউইন কমেন্ডা। কমেন্ডা এর আগে পোর্শের সাথে ভক্সওয়াগনেও ছিলেন। যা-ই হোক, সেই মডেলটিকে সামান্য যোগ-বিয়োগ করে পোর্শে ৩৫৬ নামে প্রথমবারের মতো গাড়ি তৈরির বাজারে প্রবেশ করে পোর্শে।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, পোর্শে ৩৫৬ মূলত তৈরি করা হয়েছিল ভক্সওয়াগন বিটলের ইঞ্জিন সহ নানা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে, যেটি পোর্শেই ডিজাইন করেছিল বিশ্বযুদ্ধের আগে ও বিশ্বযুদ্ধের সময়টাতে। এর সামরিক সংস্করণও বের করা হয়েছিল, যা উৎপাদিত হয়েছিল অর্ধ লক্ষেরও বেশি। পোর্শে নিজের নকশা করা জনপ্রিয় এই গাড়ির মডেলটিকে নিজের প্রয়োজনে আরো একবার ব্যবহার করে ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছিলেন। পোর্শের প্রথম গাড়িটি ছিল চারটি সিলিন্ডারের, চল্লিশ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন আর ইঞ্জিন ছিল পেছনে। প্রথম গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ছিল K45-286।
পোর্শে তাদের নিজস্ব ইঞ্জিন তৈরি করে ১৯৫০ সালে, যা ৩৫৬ মডেলের পরবর্তী গাড়িগুলোতে ব্যবহার করে। পোর্শে ৩৫৬ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, যা পোর্শেকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। এই সময়টাতে তারা ছিলেন অস্ট্রিয়াতে। এই বছরই পোর্শে কোম্পানি অস্ট্রিয়া থেকে জার্মানিতে আবার ফিরে আসে।
পোর্শের এগিয়ে যাওয়া
জার্মানিতে ফেরার পরের বছর ১৯৫১ সালের ৩০ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ফার্দিনান্দ পোর্শে। তার প্রতিষ্ঠানটি তখন সাফল্যের দিকেই হাটছিল। এই বছরেই প্রতিষ্ঠানটি ৩৫৬ এসএল মডেলের স্পোর্টস কার পরিচয় করায়, যা “24 Hours of Le Mans” কার রেসিং প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সারা দুনিয়ার নজর কাড়ে। সেই সাথে একই সালে ৩৫৬ মডেলের গাড়িটির অারো উন্নয়ন সাধন করে ৪০ হর্স পাওয়ার থেকে ৬০ হর্স পাওয়ারে রুপান্তরিত করা হয়।
এর দুই বছর ১৯৫৩ সালে পোর্শে তাদের রেসিং কার ৫৫০ স্পাইডার প্যারিস অটো শো-তে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা সমসাময়িক রেসিং কারগুলোকে পেছনে ফেলে গাড়ির ইতিহাসে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ২৫ বছর পূর্ণ করে ও উৎপাদন করে তাদের দশ হাজারতম গাড়ি।
সুদীর্ঘ সাফল্যের ইতিহাস
পোর্শের এরপরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। ১৯৬০ সালে ৭১৮ আর এস ৬০, ১৯৬২ সালে পোর্শে ৮০৪, ১৯৬৩ সালে পোর্শে ৯০১ মডেলের গাড়ি বাজারজাত করে তারা। তবে সবচেয়ে অভাবনীয় মডেলটি পোর্শে বাজারে আনে ১৯৬৪ সালে, সেটি ছিল পোর্শে ৯১১। এটি ছিল ১৩০ হর্সপাওয়ারের এবং ছয়টি সিলিন্ডারবিশিষ্ট। এই সিরিজের গাড়িগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
৯১১ মডেলের সফলতার পর ১৯৬৫ সালে এসে পোর্শে ৩৫৬ মডেলটির উৎপাদন বন্ধ করে। এই মডেলের মোট উৎপাদিত গাড়ির পরিমাণ ছিল ৭৭৩৬১টি। এই বছরই পোর্শে খানিকটা সস্তায় ৯১১ এর বডিতে পূর্বের ৩৫৬ মডেলের ইঞ্জিন যোগ করে বাজারে আনে ৯১২ মডেলের গাড়ি। এর মূল্য ছিল প্রায় চার হাজার ডলার, যেখানে ৯১১ মডেলের একেকটি গাড়ির মূল্য ছিল ৫৫০০ ডলার।
৯১১ মডেলটিই পোর্শেকে ব্রান্ড হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। এই মডেলের গাড়িটির উৎপাদন এখনো ধরে রেখেছে পোর্শে। সবচেয়ে সফল ও পরিচিত মডেল হিসেবে এটি পোর্শেকে নিয়ে আসে অনন্য অবস্থানে। ১৯৭২ সালে পোর্শে স্থাপন করে নিজেদের গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, যার উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ফেরি পোর্শে।
১৯৮৪ সালে পোর্শে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তরিত হয়। ফার্দিনান্দ পোর্শের জামাতা আর্নেস্ট পিচ ও পোর্শে পরিবার নিজেদের জন্য পঞ্চাশভাগ শেয়ার বরাদ্দ রাখে। ১৯৮৭ সালে ৯১১ মডেলের গাড়িটির উৎপাদন আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপরের বছর ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন ফেরি পোর্শে।
পোর্শের মৃত্যুর পরেও তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেমে থাকেনি, বরং নজরকাড়া ডিজাইন, নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্যের গাড়ি তৈরি করে সবসময় প্রতিষ্ঠানটি সামনের কাতারে থেকেছে। এখনো তাদের সাফল্য ধরে রেখেছে সমানতালে।
পোর্শে ও ভক্সওয়াগন
পোর্শে ও ভক্সওয়াগনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। ২০০৯ সালে এসে পোর্শে ও ভক্সওয়াগনের মধ্যে ২০১১ সালের মধ্যে একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভক্সওয়াগন কর্তৃক পোর্শেকে অধিগ্রহণ করার পর পোর্শে ভক্সওয়াগন গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রুপান্তরিত হয়।
বর্তমান সময়ে পোর্শে
গত সত্তর বছরে পোর্শে বাজারে এনেছে অসংখ্য মডেলের রেসিং কার, এসইউভি, সুপার কার, হাইপার কার, সেডান সহ নানা জাতের উঁচু মানসম্পন্ন গাড়ি। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় মডেলগুলোর মধ্যে ৭১৮ বক্সস্টার/কেমান, ৯১১, প্যানামেরা, ম্যাকান, ক্যায়নে উল্লেখযোগ্য। ডিজাইনের জন্য পোর্শে ডিজাইন নামে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গত পঁচিশ বছরের ৯৭.৪ ভাগ পোর্শে গাড়ি এখনো সচল রয়েছে রাস্তায়। এ থেকে বোঝা যায় পোর্শের নির্ভরযোগ্যতা। এই বছরই তারা ঘোষণা দিয়েছে ডিজেলচালিত আর কোনো গাড়ি না উৎপাদন করার। তার বদলে পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ি নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি সম্প্রতি তারা ঘোষণা দিয়েছে উড়ুক্কু গাড়ি নির্মাণের।
পোর্শের বর্তমান গাড়ির বাজারও বেশ ভালো। ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেছে ১,৩০,৫৯৮টি গাড়ি। যেখানে ২০১৭ সালে মোট বিক্রয় ছিল ২,৪৬,৩৭৫টি। ধরাই যায়, গত বছরের হিসাবকে হয়তো সহজেই ছাড়িয়ে যাবে পোর্শে।
ডিজাইনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি নির্মাণতায় পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন আধিপত্য করছে দুনিয়াজুড়ে। পোর্শের সামনে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার দিন।