করোনাভাইরাস নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতেছে দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে এ যুদ্ধের কোনো ময়দান নেই, পুরোটা হচ্ছে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে, আর নাহয় প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।
আজ চীন করোনাভাইরাসের বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করলে সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা চীনকে দোষারোপ করে। কে জিতবে এ যুদ্ধে? চীন না যুক্তরাষ্ট্র? ভবিষ্যদ্বাণী এত তাড়াতড়ি করা সম্ভব না হলেও পরস্পর দোষারোপের রাজনীতি করোনাভাইরাসের মধ্যে স্থবির বিশ্ব রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল মিলে দায়ী করছে চীনকে, আর চীন দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্রকে; আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দায়ী করছে ইসরাইলকে জৈব মারণাস্ত্র তৈরির উদ্ভাবক হিসেবে।
তবে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ চলছে ফেসবুক, টুইটার ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে। এ যুদ্ধে কারা জিতবে বলা মুশকিল, তবে তারাই জিতবে, যারা রাজনীতির কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এড়িয়ে আপাতত করোনাভাইরাস নির্মূলে এগিয়ে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরকে দোষারোপ করে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে মূলত দুটো বিষয়কে সামনে রেখে–
১. সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে জনরোষে যেন না পড়তে হয়! চীন সরকার করোনাভাইরাস মহামারি রূপ ধারণ করা সত্ত্বেও একমাস পর্যন্ত গোপন করে। পরবর্তী সময়ে এ ভাইরাস যখন পুরো চীন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তড়িঘড়ি করে চীন সরকার কিছু ব্যবস্থা নেয়। অন্যদিকে ট্রাম্পের সরকার চীন সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে আমেরিকান জনগণের সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে পুরো আমেরিকায় করোনাভাইরাস বিস্তার লাভ করে, এমনকি পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব দেখা যাচ্ছে। মূলত নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করে নাগরিকদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দিতে আমেরিকা ও চীন সরকার পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
২. নিজ দেশের উপর থেকে করোনাভাইরাসের সৃষ্টির অপবাদ সরাতে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল শতভাগ নিশ্চিত হয়ে জানা যায়নি। কিন্তু এখনও আমেরিকা ও চীন একে অপরকে দায়ী করে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের উৎপত্তির পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে, যদিও এখনো বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে সক্ষম হননি ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল আসলে কোথায়! যদি কোনোভাবে প্রমাণ করা যায় আমেরিকা বা চীন করোনাভাইরাসের বিস্তার করিয়েছে নিজেদের বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তিশালী করার জন্য, তাহলে একে অপরকে ব্যাকফুটে ফেলে দিতে পারবে।
আসুন দেখে নেওয়া যাক, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার একে অপরের বিরুদ্ধে কী কী প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।
আমেরিকান প্রোপাগান্ডা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, উহানের ইসরায়েলি জীবাণু অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই ভাইরাসের জন্মস্থান উহান ইনস্টিটিউট অভ ভাইরোলোজির বায়ো-সেফটি লেভেল ৪ ল্যাবরেটরি। চীনা গবেষকদের হেঁয়ালিপনায় এই ল্যাবরেটরি থেকেই ছড়িয়েছে ভাইরাসের সংক্রমণ, দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। চীন সরকারের দাবি অনুযায়ী, উহানের সামুদ্রিক খাবারের বাজার করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল।
আবার বাজারের খুব কাছেই উহান ইনস্টিটিউট অভ ভাইরোলজি। চীনের গবেষণাগারে ব্যবহৃত প্রাণীদের গবেষণা শেষে বাজারে বিক্রি করে দেয়ার রেকর্ড আছে। আমেরিকান গবেষকদের ধারণানুযায়ী, কোনো বিজ্ঞানী গবেষণা শেষে গবেষণায় ব্যবহৃত বাদুড় কিংবা অন্যান্য প্রাণী উহানের সামুদ্রিক খাবার ও মাংসের বাজারে বিক্রি করে দেন; আর ওখান থেকেই ভাইরাস সমগ্র উহানে ছড়িয়েছে। চীন সরকার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বাজারটি বন্ধ করে দেয়, কারণ প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি ঐ বাজারটিতে গিয়েছিলেন। কিছুদিন আগেই ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ আখ্যা দিয়েছেন।
আমেরিকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অনবরত চীনকে দোষারোপ করছেন জৈব মারণাস্ত্র হিসেবে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গত ফেব্রুয়ারিতে এক ডাক্তারকে শাস্তি দেয় করোনাভাইরাস নিয়ে তার সহকর্মীদের সতর্ক করার কারণে। এ কারণে মার্কিন প্রশাসনের দাবির গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যায় সংবাদমাধ্যমে। করোনাভাইরাস নিয়ে চীন প্রচুর তথ্য গোপন করেছে, দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং তা প্রমাণের জন্য তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের সকল মিডিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর একটি প্রতিবেদনে চীন সরকারের তথ্য গোপনের প্রমাণ প্রকাশ করা হয়।
চীনের ম্যাগাজিন ‘ক্যাক্সিন’র বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উহানের হানকাউ শ্মশানে প্রতিদিন ১৯ ঘণ্টা ধরে মৃতদেহ সৎকার হয়েছে। মাত্র দুদিনে সেখানে পাঁচ হাজার মানুষের মরদেহ পোড়ানো হয়। শবাধার ও ছাই সংগ্রহ করতে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনলাইনে পোস্ট করা ছবি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো একটা হিসেব বের করেছে। এ হিসাবে গত ২৩ মার্চ থেকে মৃতদেহ সৎকার শেষে উহানে শব বা মৃতদেহের ছাই ভরা ৩,৫০০ কলস ফিরে এসেছে প্রতিদিন। এ হিসাবে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ দিনে উহানে ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রকাশিত হিসেবে দেখানো হয়, উহানে ৮৪টি চুল্লিতে দিন-রাত ধরে মোট ৪৬,৮০০ মৃতদেহ পোড়ানো হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে আরো দাবি করা হয়, উহানের জনগণের মৃতদেহ সৎকার করা হচ্ছে না, প্রায় হাজারের অধিক লাশ এখনও সৎকারের বাকি। চীনের জনগণকে সরকারের মৃতের সঠিক সংখ্যা গোপন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে প্রতিবেদনটিতে। চীন সরকারের করোনাভাইরাস নিয়ে তথ্য গোপনের নীতির কঠোর সমালোচনা করছে মার্কিন প্রশাসন, সাথে খানিকটা রাজনীতিও বাদ যাচ্ছে না।
চীনের পাল্টা প্রোপাগান্ডা
চীন সরকার করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা হজম করছে না, বরং গুজব বা মিথ্যা সংবাদ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পাল্টা তীর ছুঁড়ছে এই বলে যে,“করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি।”
২০১৯ সালের অক্টোবরে উহানে আমেরিকান সেনারা এসেছিল মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমসে অংশ নিতে। এতে আমেরিকান সেনাদের ১৭টি দল এবং ২৮০ জন সেনা অংশ নেয়। চীন সরকারের দাবি অনুসারে, আমেরিকান সেনারা এ ভাইরাস চীনে নিয়ে এসেছে। চীনের বিজ্ঞানীদের দাবি, করোনাভাইরাসের মহামারি চীনে শুরু হলেও, এর উৎপত্তি চীনে হয়নি।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও ঝাও লিজিয়ান টুইটারে মার্চের ১১ তারিখে একটি ভিডিও ফুটেজ আপলোড করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, মার্কিন কংগ্রেস কমিটির সামনে সেই দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) প্রধান রবার্ট রেডফিল্ডের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত একটি শুনানি। সেই ফুটেজে রেডফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে বলছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর কারণেই সেসব মৃত্যু ঘটেছে। তবে ফুটেজটি কবেকার, সেটা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। যদিও রেডফিল্ড বলেননি, কখন সেসব মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু, চীনা ঐ কূটনীতিক টুইটারে ভিডিও ক্লিপটি পোস্ট করে সাথে লিখেছেন,
সিডিসি ধরা পড়ে গেছে। কখন প্রথম রোগী যুক্তরাষ্ট্রে মারা গিয়েছিল? কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল? কোন কোন হাসপাতালে? হতে পারে যেসব মার্কিন সেনা উহানে ঐ ভাইরাস এনেছিল তারাই… স্বচ্ছ হোন। মানুষকে সত্য জানান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাই।
ঝাওয়ের এই টুইট চীনা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি সিসিটিভিতে ফলাও করে প্রচার হয়। চীনের বহুল প্রচারিত পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসেও তা ছাপা হয়। চীনের এ দোষারোপ ট্রাম্প প্রশাসনকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়। তবে ট্রাম্প প্রশাসনও এড়িয়ে চলছে ব্যাপারটি।
সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতিতে স্থবির বিশ্বরাজনীতি বারবার এখন আমেরিকা–চীন পাল্টাপাল্টি কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে সামান্য উত্তপ্ত। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। তবে ভাইরাস নিয়ে রাজনীতিতে চীন সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে গিয়েছে অনেকাংশে।
যুক্তরাষ্ট্র করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে চীনের কাছে হাত পেতেছে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির জন্য। চীন সরকারও কিছুদিনের জন্য রাজনীতি ভুলে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা ১ লাখ ৩০ হাজার এন-৯৫ মাস্ক, ১৮ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক এবং গাউন, ১০.৩ মিলিয়ন গ্লাভস এবং ৭০ হাজার থার্মোমিটার নিয়ে একটি বিমান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
করোনাভাইরাস নিয়ে পরস্পর দোষারোপের মাধ্যমে নিয়ে রাজনীতি শুরু হলেও বর্তমানে চীন–আমেরিকা পরস্পর একে অপরের পাশে থেকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধ কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। করোনাভাইরাস-মুক্ত পৃথিবী গড়তে চীন আমেরিকার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থান এ সংকটময় মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার।