বেলারুশ প্রজাতন্ত্র (বেলারুশীয়: Рэспубліка Беларусь, ‘রেসপুবলিকা বেলারুস’; রুশ: Республика Беларусь, ‘রেসপুবলিকা বেলারুস’) পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত একটি পূর্ব স্লাভিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির উত্তর–পূর্ব ও পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণে ইউক্রেন, পশ্চিমে পোল্যান্ড এবং উত্তর–পশ্চিমে লিথুয়ানিয়া ও লাতভিয়া অবস্থিত। বেলারুশের সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, তাই বেলারুশ একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। যেহেতু বেলারুশ স্থলবেষ্টিত, সেহেতু রাষ্ট্রটির নৌবাহিনী বা উপকূলীয় রক্ষীবাহিনী/কোস্টগার্ড নেই। কিন্তু কৌতূহলের ব্যাপার হচ্ছে, বেলারুশে রুশ নৌবাহিনীর (রুশ: Военно-морской флот Российской Федерации, ‘ভোয়েন্নো–মোরস্কোয় ফ্লোৎ রোসিস্কোয় ফেদেরাৎসি’; বাংলা: রুশ ফেডারেশন সামরিক–সামুদ্রিক নৌবহর) একটি ঘাঁটি রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে রাষ্ট্রের সীমান্তে কোনো সমুদ্রই নেই, সেখানে রুশ নৌবাহিনী কেন ঘাঁটি স্থাপন করেছে?
উল্লেখ্য, বেলারুশ ঐতিহাসিকভাবে রুশ রাষ্ট্র বা রুশ প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল। বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ড অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রুশ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, এবং পরবর্তীতে ‘বাইলোরুশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে বেলারুশ স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বেলারুশ রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ১৯৯৯ সালে রাশিয়া ও বেলারুশ মিলে ‘ইউনিয়ন রাষ্ট্র’ (রুশ: Союзное государство, ‘সয়ুজনোয়ে গোসুদার্স্তভো’; বেলারুশীয়: Саюзная дзяржава, ‘সায়ুজনায়া গজিয়ার্ঝাভা’) গঠন করে, যেটির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দুটি একটি শিথিল কনফেডারেশনে যুক্ত। তদুপরি, বেলারুশ রুশ–নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক জোট ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন’ এবং সামরিক জোট ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’র সদস্য।
রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান। রাষ্ট্র দুইটি আনুষ্ঠানিকভাবে একে অপরের সামরিক মিত্র। রাষ্ট্র দুটির আকাশ প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গীভূত। বেলারুশীয় সেনাবাহিনী ও রুশ সশস্ত্রবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক জেলার ‘১ম গার্ডস আর্মি’র সমন্বয়ে একটি ‘রেজিওনাল গ্রুপ অফ ফোর্সেস’ গঠিত হয়েছে এবং যুদ্ধের সময় এটি একটি একক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করবে। রুশ ও বেলারুশীয় সৈন্যরা নিয়মিতভাবে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তদুপরি, বেলারুশের ভূখণ্ডে রাশিয়ার দুটি সামরিক ঘাঁটি বিদ্যমান। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হান্তসাভিচি রাডার স্টেশন’। বেলারুশের ব্রেস্ত প্রদেশের হান্তসাভিচি শহরের নিকটে অবস্থিত এই রাডার স্টেশনটির পরিচালনার দায়িত্ব রুশ মহাকাশ বাহিনীর (রুশ: Космические войска, ‘কসমিচেস্কিয়ে ভয়স্কা’) ওপরে ন্যস্ত। অপর ঘাঁটিটি হচ্ছে বেলারুশের মিনস্ক প্রদেশের ভিলেয়কা শহরের নিকটে অবস্থিত ‘রুশ নৌবাহিনীর ৪৩তম যোগাযোগ কেন্দ্র’ (রুশ: 43-й узел связи ВМФ России, ‘৪৩-য় উজেল সভিয়াজি ভেএমএফ রোসিই’)।
ঘাঁটির নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, এটি প্রচলিত অর্থে কোনো নৌঘাঁটি নয়, অর্থাৎ, এই ঘাঁটিতে রুশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুজার, প্যাট্রোল বোট, সাবমেরিন বা অন্য কোনো ধরনের সামরিক নৌযান রাখা হয় না। কোনো ধরনের নৌ অভিযান পরিচালনার জন্যও ঘাঁটিটিকে ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু ঘাঁটিটি রুশ নৌবাহিনী পরিচালনা করে এবং রুশদের সামরিক সামুদ্রিক কার্যক্রমের জন্য উক্ত ঘাঁটিটির বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, ভিলেয়কায় অবস্থিত ‘যোগাযোগ কেন্দ্র’টি কোনো সাধারণ বেতার যোগাযোগ বা টেলিযোগাযোগ কেন্দ্র নয়। এটি এমন একটি যোগাযোগ কেন্দ্র, যেটির মাধ্যমে রুশ নৌবাহিনীর জেনারেল স্টাফ আটলান্টিক ও ভারতীয় মহাসাগরের সম্পূর্ণ অংশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অংশবিশেষে মোতায়েনকৃত রুশ পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। একই সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ এবং ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রেও এই ‘যোগাযোগ কেন্দ্র’টি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, রুশরা তো সেইন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত তাদের নৌবাহিনীর সদর দপ্তর থেকেও গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত তাদের সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারত। সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে কেন এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি স্থাপন করেছে? এর কারণ হচ্ছে, সেইন্ট পিটার্সবার্গ বা মস্কো থেকে সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন মহাসাগরে মোতায়েনকৃত রুশ সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা খুবই কঠিন এবং ক্ষেত্রবিশেষ অসম্ভব। সেইন্ট পিটার্সবার্গ বা মস্কোর পরিবর্তে বেলারুশীয় ভূখণ্ড থেকে উক্ত সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। দূরবর্তী গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত রুশ সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে স্থিতিশীল যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি রিপিটিং সিগন্যাল অ্যামপ্লিফায়ার প্রয়োজন, এবং ভিলেয়কায় অবস্থিত ‘আন্তেই’ রেডিও স্টেশন সেই কাজটি করে থাকে।
যেসব রাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে বড়সড় সাবমেরিন বহর রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই অনুরূপ ঘাঁটি রয়েছে। যেমন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আটলান্টিক মহাসাগরে মোতায়েনকৃত জার্মান সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য জার্মান নৌবাহিনী একসময় জার্মান–অধিকৃত প্যারিসে অবস্থিত আইফেল টাওয়ারকে রিপিটার হিসেবে ব্যবহার করত। অনুরূপভাবে, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’র (ইংরেজি: North Atlantic Treaty Organization, ‘NATO’; ফরাসি: Organisation du traité de l’Atlantique nord, ‘OTAN’) অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাপানের ভূখণ্ডে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার নৌ যোগাযোগ স্টেশন স্থাপন করেছে এবং নিয়মিতভাবে সেগুলোর আধুনিকায়ন করে চলেছে।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নও অনুরূপভাবে গভীর সমুদ্রে মোতায়েনকৃত নিজস্ব সাবমেরিন বহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ‘যোগাযোগ কেন্দ্র’ স্থাপন করতে শুরু করে। ভিলেয়কায় অবস্থিত যোগাযোগ কেন্দ্রটি ছিল সোভিয়েতদের নির্মিত অনুরূপ ঘাঁটিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। ১৯৫০–এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েতরা তদানীন্তন বাইলোরুশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মিনস্ক প্রদেশে অবস্থিত ভিলেয়কা শহর থেকে ১০ কি.মি. পশ্চিমে উক্ত ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করে এবং ১৯৬৪ সালের ২২ জানুয়ারি ঘাঁটিটির কার্যক্রম আরম্ভ হয়। প্রায় ৬৫০ হেক্টর জমি জুড়ে এই যোগাযোগ কেন্দ্রটি অবস্থিত। ভিলেয়কার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সোভিয়েতরা এখানে এই কেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভিলেয়কা তুলনামূলকভাবে মহাসাগরগুলোর সন্নিকটে অবস্থিত এবং এর আশেপাশে বেশকিছু জলাভূমি অবস্থিত। এজন্য এই অঞ্চল থেকে মহাসাগরগুলোতে অবস্থানরত সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে বেতার যোগাযোগ রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাথমিকভাবে ভিলেয়কা ও হান্তসাভিচি ঘাঁটিদ্বয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু ১৯৯৫ সালের ৬ জানুয়ারি রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে বেলারুশ ২৫ বছরের জন্য ঘাঁটি দুইটিকে রাশিয়ার কাছে ইজারা প্রদান করে। এই চুক্তিটি রাশিয়ার জন্য ১৯৯৬ সালের ৩১ মে থেকে এবং বেলারুশের জন্য ১৯৯৬ সালের ৭ জুন থেকে কার্যকর হয়। চুক্তিটির শর্ত অনুযায়ী, এই ২৫ বছরে রুশদেরকে উক্ত ইজারাকৃত ভূমির জন্য কোনো ধরনের শুল্ক প্রদান করতে হবে না। ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস আগে যদি উভয় পক্ষের কোনো এক পক্ষ চুক্তিটি নবায়ন করার ক্ষেত্রে তাদের অনিচ্ছা ব্যক্ত করে, সেক্ষেত্রে চুক্তিটির মেয়াদ ৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে চুক্তিটির ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু রাশিয়া বা বেলারুশ চুক্তিটি নবায়ন করার অনিচ্ছা প্রকাশ করেনি এবং বর্তমানে তারা চুক্তিটির নবায়নের জন্য আলোচনায় লিপ্ত।
বর্তমানে ভিলেয়কায় অবস্থিত ‘৪৩তম যোগাযোগ কেন্দ্রে’ রুশ নৌবাহিনীর ৩৫০ জন কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ওয়ারেন্ট অফিসার কর্মরত এবং বেলারুশীয় বেসামরিক নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র আধা–সামরিক সৈন্যদল ঘাঁটিটির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই ঘাঁটি ও অনুরূপ বেশ কয়েকটি ঘাঁটির সমন্বয়ে রুশ নৌবাহিনীর একটি একক বৈশ্বিক স্থায়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা গঠিত এবং এই ব্যবস্থাটি রুশ সশস্ত্রবাহিনীর অন্যান্য শাখার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করে থাকে।
ভিলেয়কা রেডিও স্টেশনে ১,০০০ কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তিবিশিষ্ট একটি ট্রান্সমিটার রয়েছে, যেটির পাল্লা ১০,০০০ কি.মি.–এর চেয়েও বেশি। রেডিও স্টেশনের অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সটি (প্রায় ৪০০ হেক্টর জুড়ে অবস্থিত) ১৫টি জালি মাস্তুল (২৭০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট) ও ৩টি গোলাকার অ্যান্টেনা মাস্তুলের (৩০৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট) সমন্বয়ে গঠিত। গোলাকার মাস্তুলগুলোর ব্যাস ২.২ মিটার এবং ধাতব পুরুত্ব ২ সে.মি.। প্রতিটি মাস্তুলের নিচে একটি করে অ্যান্টেনা প্যাভিলিয়ন রয়েছে, যেগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রয়েছে এবং এগুলোর মাধ্যমে রেডিও স্টেশনটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রেডিও স্টেশনটির অঙ্গন সুরক্ষিত এবং ভূগর্ভে অবস্থিত। এগুলো স্বয়ংক্রিয় এবং এগুলোতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম রয়েছে। গঠনগত দিক থেকে আন্তেই রেডিও স্টেশনের একটি স্বল্প তরঙ্গের বেতারবার্তা প্রেরণ ও গ্রহণ কেন্দ্রও রয়েছে, যেটি ভিলেয়কার কয়েকটি ভবন জুড়ে অবস্থিত।
রুশ রণকৌশলবিদদের জন্য ভিলেয়কায় অবস্থিত রুশ নৌবাহিনীর ‘যোগাযোগ কেন্দ্র’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুশ নৌবাহিনীর পারমাণবিক সাবমেরিনগুলো রাশিয়ার ‘পারমাণবিক ট্রায়াডে’র (nuclear triad) অংশ এবং রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। উল্লেখ্য, কোনো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে অপর কোনো রাষ্ট্রের ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালানোর সামর্থ্যকে ‘পারমাণবিক ট্রায়াড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। পারমাণবিক ট্রায়াডের অংশ হচ্ছে – ভূমিভিত্তিক ‘আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ (Inter-Continental Ballistic Missile, ‘ICBM’), পারমাণবিক বোমা বহনকারী কৌশলগত বোমারু বিমান (strategic bomber) এবং ‘সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’বাহী (Submarine-Launched Ballistic Missile, ‘SLBM’) পারমাণবিক সাবমেরিন।
রাশিয়ার পারমাণবিক ট্রায়াড রয়েছে এবং এক্ষেত্রে রুশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় তাদের পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কোনো রাষ্ট্র যদি অতর্কিতে রাশিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালায় এবং রাশিয়ার ভূমিভিত্তিক আইসিবিএম ও বিমানঘাঁটিতে অবস্থানরত কৌশলগত বোমারু বিমানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়, সেক্ষেত্রে বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে মোতায়েনকৃত রুশ সাবমেরিনগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে উক্ত রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ (retaliatory strikes) পরিচালনা করা। উল্লেখ্য, কোনো রাষ্ট্র যদি ঘটনাচক্রে রাশিয়ার সবগুলো আইসিবিএম ও কৌশলগত বোমারু বিমান ধ্বংস করে দিতে সক্ষমও হয়, তাদের পক্ষে রুশ পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর সব কয়টিকে চিহ্নিত করা ও ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। এর ফলে যে রাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালাবে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে পাল্টা পারমাণবিক আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। রুশদের এই নিবারক ক্ষমতা (deterrent capability) রাশিয়াকে এখন পর্যন্ত শত্রুপক্ষের অতর্কিত পারমাণবিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এসেছে। রুশ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য তাদের পারমাণবিক সাবমেরিনগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি এর থেকে অনুধাবন করা যায়।
কিন্তু সমুদ্রের গভীরে অবস্থানরত পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর পক্ষে বহির্বিশ্বের সংবাদ জানতে পারা খুবই কঠিন (কার্যত প্রায় অসম্ভব)। সুতরাং কোনো রাষ্ট্র যদি রাশিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালায়, আটলান্টিক বা ভারতীয় মহাসাগরের নিচে অবস্থানরত কোনো রুশ পারমাণবিক সাবমেরিনের ক্রুরা সেটি ততক্ষণ জানতে পারবে না, যতক্ষণ না বাইরে থেকে তাদেরকে এই বিষয়ে জানানো হচ্ছে। এজন্য এই সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা রুশ নৌবাহিনীর জন্য অপরিহার্য, কারণ অন্যথায় তাদের নিবারক ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে। বেলারুশের ভিলেয়কায় অবস্থিত যোগাযোগ কেন্দ্রটি এজন্যই রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটির মাধ্যমেই রুশরা আটলান্টিক ও ভারতীয় মহাসাগরের সম্পূর্ণ অংশ ও প্রশান্ত মহাসাগরের অংশবিশেষে অবস্থানরত রুশ পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।
২০২০ সালের আগস্টে বেলারুশে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে ব্যাপক রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং এটি তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের নেতারা দাবি করে যে, ১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো কারচুপির মাধ্যমে উক্ত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন এবং এজন্য তারা তার পদত্যাগ দাবি করে। লুকাশেঙ্কো এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এবং বেলারুশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অন্যদিকে, রাশিয়া বেলারুশীয় সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এবং তাদেরকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করে। ২০২১ সালের এপ্রিলে রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’ জানায় যে, তারা বেলারুশীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’র সহায়তায় বেলারুশের অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং এই অভ্যুত্থানের পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল।
বর্তমানে বেলারুশের সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রায় সম্পূর্ণভাবে স্তিমিত হয়ে এসেছে এবং ২০২১ সালের মার্চের পর রাষ্ট্রটিতে আর কোনো সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বেলারুশীয় সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন বেলারুশীয় সরকারবিরোধীদের অনেকের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এবং এদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি বেলারুশে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বেলারুশীয় সরকারের ভাষ্যমতে, এই প্রচেষ্টার পশ্চাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জড়িত।
২০২১ সালের ২ জুলাই বেলারুশীয় রাষ্ট্রপতি লুকাশেঙ্কো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন যে, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু বেলারুশীয় নাগরিক ভিলেয়কায় অবস্থিত রুশ নৌবাহিনীর ‘যোগাযোগ কেন্দ্রে’ অন্তর্ঘাত চালানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু বেলারুশীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আগেই সেটির সন্ধান পেয়ে যায় এবং জড়িত ব্যক্তিদেরকে গ্রেপ্তার করে। এটি বেলারুশের ভূখণ্ডে রুশ সামরিক ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম আক্রমণ প্রচেষ্টা। কার্যত এটি খুবই বিরল একটি ঘটনা, কারণ ইতিপূর্বে প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে বেলারুশের জনসাধারণকে সবচেয়ে বেশি রুশপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
বর্তমানে ভিলেয়কা (ও হান্তসাভিচি) ঘাঁটির ইজারার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে রুশ ও বেলারুশীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং শীঘ্রই এই বিষয়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হবে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্থলবেষ্টিত বেলারুশে রুশ নৌবাহিনীর ঘাঁটিটি বজায় থাকবে এবং একটি কৌতূহলোদ্দীপক সামরিক–ভৌগোলিক বাস্তবতা হিসেবে বিরাজ করতে থাকবে।