ফাঁদের মহামারী: যেভাবে নিঃশেষ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীববৈচিত্র্য

গত দুই দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীববৈচিত্র্যের পক্ষে সময়টা তেমন ভাল যায়নি। পাম অয়েলের ব্যাপক চাষ, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বন উজাড় আর বন্য প্রাণী বিলুপ্তি, বন্য প্রাণীর বিরাট চোরাবাজার এবং সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চোরাশিকার ইত্যাদির ঘনঘটায় অনেক প্রাণীই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যদিও যথেষ্ঠ সাড়া পড়েছে, বন সংরক্ষণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। আর নতুন উৎপাত হিসেবে যোগ হয়েছে ফাঁদ পেতে অতিরিক্ত সংখ্যক বন্য প্রাণী ধরা। অন্তত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীববৈচিত্র্যের ওপর এই ফাঁদ পাতা যে কীরুপ ব্যাধির মতো ভর করেছে, তা একটা পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট হবে।

কম্বোডিয়ার দক্ষিণ কারদামম জাতীয় উদ্যান থেকেই গত ৬ বছরে লক্ষাধিক তার অথবা দড়ির ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে।  গোটা একটা অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য উজাড় করবার পক্ষে সংখ্যাটা যথেষ্ঠ। এমনিতেই দশকের পর দশক যুদ্ধ, নাপাম বোমা আর বেশুমার প্রাণী হত্যার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্যপ্রাণীরা মারাত্মক সংকটে। এখন জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিকার। বন্দুকধারী চোরাশিকারীদের বদলে ফাঁদের কবলে পড়ে নিঃশেষ হতে চলেছে পৃথিবীর বহু বিরল প্রাণী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনগুলোতে কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা এসব ফাঁদ পশুদের জন্য রীতিমতো লুকানো বোমা। 

কেমন এই ফাঁদ

ফাঁদ পেতে পশুপাখি শিকার করবার পদ্ধতি মানুষ বহু আগে থেকেই জানে। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই খাদ্য সংগ্রহ চলতো। পরে বন্দুক আর রাইফেলের জমানা এলে প্রকৃতিতে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। হারিয়ে গেল অসংখ্য প্রাণী। কিন্তু বে-আইনী অস্ত্রশস্ত্র রাখা আজকাল নিষিদ্ধ, আর বন্য প্রাণী টিকিয়ে রাখতে সব দেশই কম-বেশি তৎপর। সেই সাথে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল যথেষ্ঠ সচেতন হওয়ায় সশব্দ আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে নিঃশব্দ ফাঁদই শিকারীদের পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

ফাঁদে আটক টেপির; Image Courtesy: FFI/KSNP

পৃথিবীর সব দেশেই নানা কিসিমের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে ধাতব তার, টায়ার, মোটরসাইকেলের ক্যাবল থেকে শুরু করে দড়ি দিয়ে বানানো একরকমের ফাঁস। পশুর চলাচলের পথে, জলার ধারে বা ফলদ গাছে ফাঁস টাঙ্গানো থাকে, বেখেয়ালী হয়ে পা বা মাথা গলালেই সর্বনাশ। ফাঁস নিজের থেকেই আঁটো হয়ে আসে, হতভাগ্য প্রাণীরও বাঁচবার কোনো উপায় থাকে না। পরে পিটিয়ে মারা হয়, কোনো গুলি-বারুদ খরচ ছাড়াই সুন্দর শিকারের ব্যবস্থা। 

খুব সহজ শোনালেও বিরাট অঞ্চল জুড়ে হাজারে হাজারে এমন ফাঁদ পাতা হলে পরিস্থিতি সঙ্গীন হতে বাধ্য। শিকারী স্বয়ং যদি ঐ ফাঁদের কথা ভুলে যায়, তাতেও আটকে পড়া প্রাণীটির বাঁচার সুযোগ থাকে না। না খেয়ে, স্রেফ ধুঁকে ধুঁকে মরে। আবার কেউ যদি কোনভাবে পা বা মাথা ফাঁদ থেকে ছাড়িয়ে নিতেও পারে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়, জঙ্গলে যার অবশ্যাম্ভবী পরিণতি মৃত্যু। আর এই ফাঁদ কোনো বাছবিচার করে না, শূকরের জন্য পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে হয়তো হাতির বাচ্চা মারা পড়লো। নির্বিচারে প্রাণী মারা পড়ার কারণে গোটা অঞ্চলে বাস্তুসংস্থানই ভেঙে পড়ে।

আটককৃত ফাঁদ; Image Source: CNN

ফাঁদ কাজ করে নিঃশব্দে। ফলে সুরক্ষিত বনাঞ্চলেও বনরক্ষীরা অনেক সময় জানতে পারেন না কী পরিমাণ অবাধ চোরাশিকার চলছে। বেশিরভাগ সময়েই শূকর, সম্বর, শজারু বা মায়া হরিণের মতো প্রাণীকে ধরবার জন্য এসব ফাঁদ পাতা হয়। কিন্তু এতে বনবেড়াল, চিতাবাঘ, বাঘ, এমনকি হাতির বাচ্চা পর্যন্ত আটকে মারা পড়বার নজির আছে। এশিয়ার মূল ভূখন্ডে সুমাত্রার গন্ডার টিকে আছে কি না তা নিয়েই সবাই সন্দিহান। এই মহা বিরল প্রাণীটিরও ফাঁদে আটকা পড়ে মরবার উদাহরণ আছে। 

নীচের ভিডিওতে এমন তারের ফাঁদে আটকা পড়া একটি বাঘ দেখানো হয়েছে। আহত বাঘটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

 

এভাবে চলতে থাকলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিংবদন্তীতুল্য বনগুলো শূন্য হয়ে যাবে। দৈত্যাকার গয়াল আর বাঘ-চিতাবাঘ-হাতি-ভাল্লুকের অস্তিত্বহীন এসব বন ইতোমধ্যেই মাথা তোলা শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা এসব বনকে ‘শূন্য বনাঞ্চল’ হিসেবে অভিহিত করছেন। এসব বনাঞ্চলে অত্যাধিক শিকারের ফলে এখন উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাণী নেই, অথচ বাইরে থেকে দেখে এটা বোঝার উপায় থাকে না। 

কেমন এই ফাঁদের মহামারী

গত পাঁচ বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে দুই লাখের বেশি তারের ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হয়, সবচেয়ে ভালভাবে প্রশিক্ষিত বনরক্ষীরাও এক-তৃতীয়াংশের বেশি ফাঁদ উদ্ধার করতে সক্ষম হন না। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কম্বোডিয়ার দক্ষিণ কারদাম জাতীয় উদ্যান থেকে বছরপ্রতি ফাঁদ উদ্ধারের সংখ্যা ১৪,৩৬৪ থেকে বেড়ে ২৭,৭১৪ ছুঁয়েছে। আর কেবল ২০১৮ সালেই এখান থেকে ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় বিশ হাজার

সুমাত্রায় ফাঁদে আটক বাঘ; Image Source: Wildlife Conservation Research Unit

পাশের দেশ ভিয়েতনাম। হুয়েই আর কুয়াং নাম সাওলা রিজার্ভ থেকে পাঁচ বছরে উদ্ধার করা হয়েছে পঁচাত্তর হাজারের বেশি তারের ফাঁদ। এই দুটি বনাঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯২ সালে এখান থেকেই আবিষ্কার হয় সাওলা নামের এক মাঝারি আকৃতির বনগরু। বিশ্বের সকল প্রাণীবিদের কাছে এযাবৎকালে এটি অপরিচিত ছিল এবং ভিয়েতনাম-লাওস সীমান্তবর্তী এই বনাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও সাওলা দেখা যায় না। অত্যন্ত আশাবাদী গবেষকেরাও ধারণা করেন অন্তত দেড় শতাধিক সাওলা এখনও টিকে আছে। ফেনোম প্রিচ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সেইমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং লাওসের নাম এল-ফু লয়ুই জাতীয় উদ্যান থেকে বছরে হাজার দশেকের মতো তারের ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে। 

মহাবিরল সাওলা; Image Source: The Saola Working Group

খুব সামান্য সংখ্যক প্রাণীই উদ্ধার হয়। গত দুই শতকে কম্বোডিয়াতেই অন্তত ৭০ হাজার প্রাণীকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত বেশিরভাগেরই আর বনাঞ্চলে গিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবার সক্ষমতা থাকে না। 

চীনা ঔষধ আর মাংস

বন্যপ্রাণীর এই হত্যাযজ্ঞে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে প্রাচীন চীনা চিকিৎসা প্রণালী। শজারু, প্যাঙ্গোলিন, বাঘ, ভাল্লুক, গন্ডার- সব প্রাণীরই কোনো না কোনো ব্যবহার আছে এই ঔষধশাস্ত্রে। চীনা সরকার ইতোমধ্যে বাঘ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করলেও তা মূলত আন্তর্জাতিক চাপের কারণে। চীন ও তার প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভেষজ চীনা ঔষধের পাশাপাশি বন্য পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিশ্রিত ঔষধের  দেদার ব্যবসা চলছে। কেবল চীনেই এই ঔষধের বাজারমূল্য প্রায় ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ইতোমধ্যে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়িয়েটিভকে চীনা প্রভাব বিস্তারের কৌশল হিসেবে নিয়েছেন, চীনা দেশজ চিকিৎসাও এই চীনা প্রভাবের সাথে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। 

বন্য পশুর দেহাংশের আছে চড়া দাম; Image Source: Taylor Weidman

ফাঁদে পড়া এসব জন্তুর মাংস, চামড়া ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আছে চড়া দাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেদার কেনাবেচা চলে। কেবল থাইল্যান্ডেই অন্তত দু’শ প্রজাতির বন্যপশু বা পাখি অনলাইনে কেনা যায়। এদের বিপুল সংখ্যকের কোনো আইনি নিরাপত্তাও নেই। একই অবস্থা কম-বেশি বিরাজ করছে মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস কিংবা ভিয়েতনামে।

বনের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ দু’পয়সা কামাচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত চোরাশিকারীদের জাল তো আছেই। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও বন আছে, বন্যপ্রাণী আছে, আছে চোরাশিকারের উৎপাত। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিকারের চাপ অত্যাধিক। দেশগুলোর দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্তদের মধ্যেও বন্য পশুর মাংসের প্রতি ব্যাপক পক্ষপাত। সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাই চলছে অবাধ ব্যবসা। তাছাড়া আফ্রিকা বা অন্যান্য অঞ্চলের বনাঞ্চলগুলোও এই ফাঁদের আক্রমণে জর্জরিত হচ্ছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে হারে বন্যপ্রাণী উজাড় হচ্ছে তা রীতিমতো নজিরবিহীন। 

নির্বিচারে চলছে শিকার; Image Source: SMITHSONIANMAG.COM

আর অনেকটা নীরবেই এর মধ্য থেকে বিদায় নিতে চলেছে ইন্দোচীনা বাঘেরা। ভিয়েতনামের বাঘের অস্তিত্ব এখন নেই বলেই সবাই বিশ্বাস করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বাঘের কবলে মার্কিন সৈন্য মারা পড়বার গল্প তাই অলীক শোনায়। ২০১১ সালে দেশটির শেষ গন্ডারটিও মারা পড়েছে। খুব সম্প্রতি বাঘহীন দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে লাওস। বাঘদের শেষ বাসস্থান নাম এল-ফু লয়ুই বনাঞ্চল থেকেই ফি বছর হাজার হাজার তারের ফাঁদ আবিষ্কার হচ্ছে। লাওসের শেষ বাঘটাও সম্ভবত এমন কোনো ফাঁদে পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। 

Related Articles

Exit mobile version