সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে, ইসরায়েল সিরিয়াকে কমপক্ষে ১২ লক্ষ মার্কিন ডলার সমমূল্যের কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিনের ডোজ কিনে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, সিরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না, এবং ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে সিরিয়া এখনো একটি ‘ফ্রন্টলাইন স্টেট’, যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে।
এ পর্যন্ত ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে ৪টি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, এবং আইনগতভাবে রাষ্ট্র দুইটি এখনো একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘জাবহাত ফাতেহ আল–শাম’ মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সামরিক ও অসামরিক সহায়তা প্রদান করেছে, এবং সিরিয়ার ওপরে অন্ততপক্ষে কয়েক শত বার বিমান হামলা চালিয়েছে। দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক যখন এতটাই তিক্ত, তখন ইসরায়েল কেন সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দিচ্ছে?
এই ঘটনার উৎপত্তি ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে। ঐদিন ইসরায়েলের মোদিন ইল্লিত শহরে বসবাসকারী ২৫ বছর বয়সী এক নারী (যার নাম এখনো প্রকাশিত হয়নি) সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ার কুনেত্রা অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেন। সেখানে তিনি ‘খাদের’ নামক একটি দ্রুজ গ্রামে প্রবেশ করেন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তিনি ইসরায়েলি, এটি বুঝতে পেরে কেউ একজন সিরীয় কর্তৃপক্ষকে খবর প্রদান করে। এরপর সিরীয় গোয়েন্দা সংস্থা ঐ নারীকে গ্রেপ্তার করে।
সিরীয় কর্মকর্তারা সন্দেহ করেন যে, ঐ নারী একজন ইসরায়েলি গুপ্তচর। তারা সিরিয়ায় অবস্থানরত রুশ বাহিনীকে এই তথ্য সরবরাহ করেন, এবং রুশরা এই ব্যাপারে ইসরায়েলিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও প্রথমে ঐ নারীর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না, কিন্তু পরবর্তীতে তারা মস্কোকে (এবং পরোক্ষভাবে দামেস্ককে) জানান যে, ঐ নারী কোনো গুপ্তচর নন, বরং একজন বেসামরিক নাগরিক, যার ব্যক্তিগত সমস্যা রয়েছে।
পরবর্তীতে জানা গেছে যে, ঐ নারী ইসরায়েলে একটি গোঁড়া ইহুদি (Ultra-Orthodox Jewish) পরিবারে বড় হয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি এই মতবাদ পরিত্যাগ করেন। তিনি আরবি ভাষা শিখেছেন এবং শুদ্ধভাবে আরবিতে কথা বলতে পারেন। তার সম্পর্কে প্রাপ্য যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক, সেটি হচ্ছে, ইতিপূর্বে তিনি কমপক্ষে তিন বার অনুরূপভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন।
এর মধ্যে দুইবার তিনি ইসরায়েলি–গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজা ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছেন, একবার স্থলপথে, আরেকবার একটি ভেলায় চড়ে জলপথে। অন্য এক ঘটনায় তিনি ইসরায়েলি–জর্দানীয় সীমান্ত অতিক্রম করে জর্দানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতি বারই তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তিনি প্রত্যেক বারই সীমান্ত অতিক্রম করার আগেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি নিজেকে শান্তিকামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এবং একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, “কোনো বেষ্টনীই আমাকে থামাতে পারবে না!”
তার সীমান্ত অতিক্রমের চতুর্থ প্রচেষ্টাটি সফল হয়েছে, কারণ তিনি মাউন্ট হেরমনের পাদদেশের যে অঞ্চল দিয়ে সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, সেখানে কোনো সুরক্ষা বেষ্টনী নেই এবং সেখানকার সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরাও ত্রুটিযুক্ত। এজন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে সীমান্ত অতিক্রমের সময় শনাক্ত করতে পারেনি। অবশ্য ঐ নারী কীভাবে সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তের এই ফোঁকরের কথা জানতে পারলেন, সেটি এখনো জানা যায়নি।
যাই হোক, স্বাভাবিকভাবেই তার সিরীয়দের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পেয়ে ইসরায়েলি সরকার তাকে মুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। তারা মস্কোর মাধ্যমে দামেস্ককে জানায় যে, এটি কোনো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নয়, বরং একটি মানবিক ইস্যু। সুতরাং ঐ নারীকে মুক্তি প্রদান করা উচিত। কিন্তু এ ধরনের ঘটনাগুলোয় কখনো বিনা শর্তে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয় না। ফলে ইসরায়েল, সিরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়।
৮ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করেন, এবং গ্রেপ্তারকৃত ইসরায়েলি নারীর মুক্তি লাভে সহায়তা করার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। এর পরপরই ইসরায়েলি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেয়ের বেন–শাব্বাত ও রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের রাজনৈতিক উপদেষ্টার মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পক্ষের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও এই বিষয়ে আলোচনা করেন।
ইসরায়েলি পত্রিকা ‘টাইমস অফ ইসরায়েলে’র মতে, রুশরা গ্রেপ্তারকৃত ইসরায়েলি নারীর মুক্তির বিনিময়ে সিরিয়ায় ইরানি ও ইরান–সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর আক্রমণের মাত্রা কমিয়ে দেয়ার জন্য ইসরায়েলকে অনুরোধ করে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল, নিয়মিত ইসরায়েলি বিমান হামলার ফলে সিরিয়ার অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা সরবরাহে বিঘ্নের সৃষ্টি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলা সিরিয়া ও রাশিয়া উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। কারণ, ইসরায়েলি বিমান সিরীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে সিরীয়রা তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো চালু করতে বাধ্য হয় এবং এগুলো ইসরায়েলিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে, রাশিয়া সিরিয়াকে যতদূর সম্ভব স্থিতিশীল রাখতে চায়, কিন্তু সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুর ওপর নিয়মিত ইসরায়েলি হামলা এক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। অবশ্য, ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলিরা এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ ইতোমধ্যেই তারা সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছে।
এরপর রুশ ও সিরীয়রা বন্দি ইসরায়েলি নারীর মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলে অন্তরীণ দুইজন নিরাপত্তা বন্দির মুক্তি দাবি করে। এরা হলেন নিহাল আল–মাক্ত এবং ধিয়াব কাহমুজ। তারা দুইজনই গোলান মালভূমিতে বসবাসকারী দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষ। উল্লেখ্য, ইসরায়েল গোলান দখল করে নিলেও এখন পর্যন্ত সেখানকার দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই সিরিয়ার প্রতি অনুগত। আল–মাক্ত ২০১৭ সাল থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেয়ার অভিযোগে কারারুদ্ধ। কাহমুজ লেবানিজ দল ‘হিজবুল্লাহ’–এর সঙ্গে মিলে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করছিলেন, এবং এজন্য তাকে ২০১৮ সালে ১৬ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
ইসরায়েলিরা তাদেরকে মুক্তি দিয়ে সিরিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়, কিন্তু তারা দুইজন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা কেবল নিজেদের গ্রামেই ফিরে যাবেন, অন্য কোথাও নয়। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে এর বিকল্প খুঁজতে হয়। অবশ্য সিরীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘আল–ইখবারিয়া টিভি’র মতে, আল–মাক্তকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
এদিকে এই মাসেই দুইজন সিরীয় রাখাল ‘ভুলক্রমে’ সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হয়। অবশ্য ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনীর মতে, হিজবুল্লাহ এবং ইরানি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মিলিশিয়াগুলো সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে এ ধরনের রাখালদের ইসরায়েলিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ইসরায়েলিদের হাতে ধরা পড়লেই ‘ভুলক্রমে’ সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলেছে বলে দাবি করে। অবশ্য সংবাদ সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ‘অ্যাক্সিওস’ জানাচ্ছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, বন্দি মিনিময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহাত করার জন্য ইসরায়েলি সৈন্যরা সীমান্ত অঞ্চল থেকে এই দুই রাখালকে গ্রেপ্তার করেছিল।
সিরীয় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘সিরিয়ান আরব নিউজ এজেন্সি’র মতে, এই রাখাল দুইজনের নাম মোহামেদ হুসেইন এবং তারেক আল–ওবেইদান। ১৮ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি সৈন্যরা কুনেত্রা ক্রসিংয়ে রেড ক্রসের কাছে এই দুইজনকে হস্তান্তর করে। অন্যদিকে, সিরীয় কর্তৃপক্ষ ১৭ ফেব্রুয়ারি বন্দি ইসরায়েলি মহিলাকে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে, এবং তাকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সহকারী আশের হায়ুম, যুদ্ধবন্দি ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত সরকারি সমন্বয়কারী ইয়ারন ব্লুম, ইসরায়েলি নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ ও একজন ডাক্তারের সমন্বয়ে গঠিত একটি ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল মস্কোয় গমন করে। রুশরা বন্দি ইসরায়েলি নারীকে তাদের কাছে হস্তান্তর করে, ইসরায়েলি ডাক্তার ঐ নারীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি ফ্লাইটে ঐ নারীকে সঙ্গে করে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল ইসরায়েলে পৌঁঁছে। বর্তমানে ইসরায়েলি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইসরায়েল সিকিউরিটি এজেন্সি’ (যেটি ‘শিন বেত’ নামেই বেশি পরিচিত) ঐ নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই জিজ্ঞাসাবাদ চলবে।
বন্দি বিনিময়টি সম্পাদিত হওয়ার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সহযোগিতার জন্য রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অনুরূপভাবে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন্নি গাৎজ বন্দি বিনিময়ে সহায়তার জন্য রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
এই পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক ঘটনা। একজন ‘অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়’ ইসরায়েলি নারীর মুক্তির বিনিময়ে দুই সিরীয় ‘রাখালে’র মুক্তি। কিন্তু এই সরল সমীকরণে বাঁধ সেধেছে কিছু প্রচারমাধ্যম। তারা দাবি করেছে, এই বন্দি বিনিময়ের সময় ইসরায়েল রাশিয়া ও সিরিয়ার সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতায় পৌঁছেছে। লন্ডনভিত্তিক আরবি সংবাদপত্র ‘আশারক আল–আওসাত’–এর বক্তব্য অনুযায়ী, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ইসরায়েলি সরকারের একটি সূত্র তাদেরকে জানিয়েছে, বন্দি ইসরায়েলি নারীকে মুক্তি প্রদানের বিনিময়ে ইসরায়েল সিরিয়াকে কয়েক লক্ষ ডোজ রুশ কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিন ‘স্পুৎনিক ভি’ কিনে দিতে সম্মত হয়েছে।
ইসরায়েলি বার্তা সংস্থা ‘ওয়াইনেট নিউজে’র মতে, ইসরায়েল সিরিয়াকে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিনের ডোজ কিনে দেবে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’–এর মতে, এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২ লক্ষ মার্কিন ডলার। কিন্তু ইসরায়েলি সামরিক সেন্সর এই তথ্য প্রকাশ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, এবং ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। অন্যদিকে, সিরীয় রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে এই খবরকে অস্বীকার করা হয়, এবং বলা হয় যে, এই তথ্য ছড়িয়ে ইসরায়েলকে একটি ‘মানবিক রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, ইসরায়েল সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দিচ্ছে, এই তথ্য গোপন রাখার জন্য রুশরা ইসরায়েলি সরকারকে অনুরোধ করেছিল। তাদের মতে, এই গোপনীয়তা তুলে নেওয়া উচিত, কারণ এর ফলে এই ইস্যুটি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু এটিও হতে পারে যে, ইসরায়েলি সরকার নিজেরাই এই তথ্য গোপন রাখতে চেয়েছে, কারণ ইসরায়েলি জনসাধারণের অর্থে সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দেওয়া হচ্ছে, এই তথ্য ইসরায়েলি জনসাধারণের একাংশ মোটেই পছন্দ করবে না।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা মতামত দিচ্ছেন যে, বর্তমান বিশ্বে কোভিড–১৯ মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিন ক্রমশ একটি ‘কূটনৈতিক মুদ্রা’য় (diplomatic currency) পরিণত হচ্ছে, এবং ইসরায়েলও এক্ষেত্রে বন্দি নাগরিকের মুক্তির মূল্য হিসেবে ভ্যাক্সিন প্রদান করছে। ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের ‘আর্মি রেডিও’ মতামত প্রকাশ করেছে যে, ইসরায়েলের উচিত আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিনকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
অবশ্য ‘আশারক আল–আওসাত’–এর বক্তব্য অনুযায়ী, সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দেওয়াই রুশ মধ্যস্থতায় সম্পাদিত সিরীয়–ইসরায়েলি বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতার একমাত্র গোপন শর্ত নয়। তাদের মতে, সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দেওয়ার পাশাপাশি সিরিয়ার হাসাকাহ প্রদেশে অবস্থিত শস্যভাণ্ডার থেকে আলেপ্পো প্রদেশে গম সরবরাহ করার ব্যাপারেও ইসরায়েল সিরিয়াকে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে। বর্তমানে তুর্কি–সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুপগুলো হাসাকাহ প্রদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল হয়তো তুরস্কের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এই শর্ত পূরণ করতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, এই বন্দি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল, রাশিয়া ও সিরিয়া প্রত্যেকেই অন্তত আংশিকভাবে লাভবান হয়েছে। ইসরায়েলিরা তাদের বন্দি নাগরিককে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে, এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এটিকে তার সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন। রুশরা সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সাফল্যজনকভাবে মধ্যস্থতা করে উভয় পক্ষের নিকট (এবং বহির্বিশ্বের কাছেও) নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন সরবরাহের বিনিময়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে অর্থও লাভ করছে। অন্যদিকে, এই বন্দি বিনিময়ের ফলে লক্ষ লক্ষ সিরীয় নাগরিক ভ্যাক্সিন লাভের সুযোগ পাবে, এবং এটিকে সিরীয় রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদ তার সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দাবি করতে পারবেন।
কিন্তু এই বন্দি বিনিময় ও ‘ভ্যাক্সিন কূটনীতি’র ফলে সিরিয়া ও ইসরায়েলের জন্য কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইসরায়েলি ডানপন্থী পত্রিকা ‘ইসরায়েল হায়োম’–এর ধারাভাষ্যকার ইয়োয়াভ লিমোর সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য ইসরায়েলি সরকারের নিন্দা করেছেন। তদুপরি, ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা আবার ঘটতে পারে, এই সম্ভাবনাও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এদিকে ভাগ্যের পরিহাসে, ইসরায়েলিরা লক্ষ লক্ষ সিরীয় নাগরিকের জন্য ভ্যাক্সিন ক্রয় করে দিচ্ছে (বা দিতে বাধ্য হচ্ছে), কিন্তু ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনিদের ভ্যাক্সিন দিতে রাজি হচ্ছে না। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক নীতিকে বিশ্ববাসীর সামনে আরো প্রকট করে তুলবে।
অন্যদিকে, সিরীয় সরকারের রাজনৈতিক শত্রুরা বহু আগে থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে সহায়তা করার দায়ে বাশার আল–আসাদ ও তার সরকারকে অভিযুক্ত করে আসছে। ইসরায়েল গোপনে সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দিচ্ছে, এই খবরটি জানার পর তাদের এই জাতীয় প্রচারণা আরো বৃদ্ধি পাবে। এটি রাজনৈতিকভাবে সিরীয় সরকারের জন্য ক্ষতিকর। বলাই বাহুল্য, এজন্যই সিরীয় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইসরায়েল কর্তৃক সিরিয়াকে ভ্যাক্সিন কিনে দেয়ার সংবাদটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।