ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত লাহালু ও স্পিটি জেলা; এই দুই জেলার মধ্যভাগে অবস্থিত স্পিটি উপত্যকা। এই উপত্যকায় বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে, যা ভারতের সবচেয়ে উঁচু বসতিপূর্ণ গ্রাম। শুধু ভারত নয়, এ গ্রামগুলো বিশ্বেরও সবচেয়ে উঁচু বসতভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই গ্রামগুলোর উচ্চতা ৪,৩৩০ মিটার থেকে শুরু করে প্রায় ৫,৮৭৮ মিটার পর্যন্ত।
এই পাহাড়ি গ্রামগুলোর অন্যতম গ্রাম হিক্কিম। এছাড়াও রয়েছে কর্জক ও কমিক নামের আরও দুটি গ্রাম। গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তসো মরিরি খাল। সম্ভবত এই খালের কারণেই এত উঁচু পাহাড়েও মানুষের বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এই গ্রামগুলোর জনসংখ্যা খুবই সীমিত। ২০১২ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই তিন গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা মাত্র ৩২৬ জন।
নানা কারণেই এই দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলো বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পোস্ট অফিস অবস্থিত। পোস্ট অফিসটির অবস্থান হিক্কিম গ্রামে। শুধু তা-ই নয়, এই হিক্কিম গ্রামকে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভোটকেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। হিক্কিম গ্রামের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,৮৭২ মিটার।
হিক্কিমের আবহাওয়া অত্যন্ত ঠাণ্ডা। বছরের প্রায় ছয় মাস বরফাচ্ছাদিত থাকে। আধুনিক কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এলাকাবাসীর চলাচল প্রধানত পায়ে হেঁটে। যদিও সীমিত পরিসরে মোটরসাইকেল চালানোর মতো পথ রয়েছে; আবহাওয়া ভালো থাকলে মোটরসাইকেল যোগে এই দুর্গম হিক্কিমে পৌঁছানো যায়।
হিক্কিমে কোনো টেলিফোন বা মোবাইল সংযোগ নেই। পাহাড়ে চাষবাস করেই চলে তাদের জীবন। তবে একটি স্কুল রয়েছে সেখানে। কিন্তু স্কুলের ছাত্রসংখ্যা মাত্র ৫ জন। দুর্গম পাহাড়ের পথ হলেও অনেক ভ্রমণপিপাসু পর্যটক সেখানে ঘুরতে যান। কেননা হিক্কিমে গেলে একইসাথে নয়নাভিরাম পাহাড়, বরফ, ঝর্ণা, দুর্গম পথ অতিক্রম করা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বসতিপূর্ণ গ্রাম ও সবচেয়ে উঁচু পোস্ট অফিস দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। এছাড়াও হিক্কিমে রয়েছে প্রায় এক হাজার বছরের পুরাতন বৌদ্ধমঠ; যা দর্শনার্থীদের যোগায় বাড়তি আকর্ষণ। হিক্কিমের অধিকাংশ মানুষ এই বৌদ্ধ ধর্মেরই অনুসারী।
পুরো হিক্কিমের গঠন বড় বড় মৃত পাহাড়, ভয়ঙ্কর গিরিপথ, আঁকাবাঁকা নদী ও ঠাণ্ডা মরুভূমির সমন্বয়ে। গ্রামের শীর্ষ থেকে সারা পৃথিবীকে যেন মনে হয় নিম্নাঞ্চলীয় ভিন্ন কোনো জগত। নদীর তীরে দেখা যায় হালকা কিছু সবুজ উদ্ভিদ, পাহাড়গুলোতে উদ্ভিদের জন্ম হয় না বললেই চলে। জীবিকা নির্বাহের জন্য সেখানকার অধিবাসীরা খুব কম জায়গাতেই চাষাবাদ করতে পারেন। ফলে সেখানে সাধারণত ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ বসবাস করতে চান না; অনেকটা পূর্বপুরুষদের পরম্পরা অনুসারেই তারা বসবাস করেন। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যাদের সম্ভব হয়, তারা অন্যত্র চলে যান।
স্পিটি উপত্যকার কেন্দ্রীয় শহরের নাম ‘কাজা’। কাজা থেকে হিক্কিমের দূরত্ব কমপক্ষে ৪৬ কিলোমিটার। যাতায়াতের জন্য যে রাস্তা ব্যবহার করা হয়, তাকে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ (ছবিতে দ্রষ্টব্য) রাস্তা বলা যেতে পারে। উঁচু পাহাড়ের মধ্যভাগে সড়ক তৈরি করা হয়েছে; যা দেখতেও সবার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হবে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার সময় আপনি দেখতে পাবেন একটি বিস্তৃত বৌদ্ধ মঠ। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের কঠোর সাধকেরা বসবাস করেন। তারা দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে এখানে বসে সাধনা করেন। নির্বাণপ্রাপ্ত সাধকদের পাশাপাশি সেখানে নবাগত সাধকদের আগমন করতে দেখা যায়, তারা নির্বাণপ্রাপ্ত সাধকদের কাছে নির্বাণ লাভের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
এই মঠটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন মঠ। এবং স্পিটি উপত্যকার সর্ববৃহৎ মঠ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মঠটির উচ্চতা প্রায় ৪,১৬৬ মিটার। অনেকের মতে পোস্ট অফিসের মতো এই মঠটিও পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মঠ। পুরো মঠ জুড়ে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর। এসব ঘরে সাধকরা অবস্থান করে থাকেন। সবচেয়ে উঁচুতে এবং একেবারে মাঝখানে রয়েছে মঠের মূল উপাসনালয়। মঠের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে স্পিটি নদী।
মঠ অতিক্রম করে আপনি যখন মূল হিক্কিম গ্রামের কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন, তখনই দেখতে পাবেন একটি সাদামাটা পোস্ট অফিস। পাথর দিয়ে নির্মিত একটি একতলা ভবনে চলে এর কার্যক্রম। ভবনের বাইরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একটি পোস্ট বক্স, বক্সের পাশেই রয়েছে পোস্ট অফিসের একটি সাইনবোর্ড।
হিক্কিম পোস্ট অফিসটি স্থাপিত হয় ১৯৮৩ সালের ৫ নভেম্বর। এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে এলাকাবাসী অন্য অঞ্চলের মানুষের সাথে পত্র বিনিময় করেন। এটাই তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। চিঠি ছাড়াও এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে তারা মানি অর্ডার, সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা জমা এবং দূর-দূরান্তে মালামাল প্রেরণ ও গ্রহণের কাজ করে থাকেন।
পোস্ট অফিসের জনবল মোট তিনজন; একজন পোস্টমাস্টার এবং দুজন পোস্টম্যান। পোস্টমাস্টারের নাম রেনচেন চ্যারিং। ১৯৮৩ সালে যখন এই পোস্ট অফিসটি স্থাপিত হয়, তখন থেকেই তিনি এখানকার পোস্টমাস্টার। এই দুর্গম পাহাড়ের পোস্ট অফিস পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলেও এর নেপথ্য কারিগরদের জন্য তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক; কেননা প্রতিদিন পায়ে হেঁটে দুই পোস্টম্যানকে ডাক আনা-নেয়া করতে হয়। পোস্ট অফিসের প্রাথমিক গন্তব্য জেলা শহর নাজি। আগেই বলা হয়েছে নাজির দূরত্ব প্রায় ৪৬ কিলোমিটার। তারা প্রতিদিন ৪৬ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ডাক দিয়ে আসেন এবং নিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে এই কাজে পোস্টমাস্টার রেনচেন চ্যারিং নিজেও নিয়োজিত হন।
এই ৪৬ কিলোমিটার পথ কোনো সাধারণ বা চলাচলে সুবিধাজনক পথ নয়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। কখনো পাহাড়ের উঁচুতে উঠতে হয়, আবার কখনো নিচে নামতে হয়। কিন্তু এটিই যে হিক্কিম পোস্ট অফিসে কর্মরত পোস্টম্যানদের নিয়মিত কাজ। তবে অভ্যাস মানুষের দাস, সে কারণেই হয়ত এমন দুঃসাধ্য কাজ তারা নিয়মিত করে যাচ্ছেন।
হিক্কিম পোস্ট অফিসের পোস্ট কোড ১৭২১১৪। পোস্টমাস্টার রেনচেন চ্যারিংয়ের বয়স যখন মাত্র ২২ বছর, তখনই তিনি এখানকার পোস্টমাস্টারের দায়িত্ব পান। এখন তার প্রধান কাজ হল প্রতিদিন ডাকযোগে আসা-যাওয়া পত্র ও অন্যান্য পণ্যে হিক্কিম পোস্ট অফিসের সিল মেরে দেয়া। তারপর প্রতিদিন সকালে সেগুলো পোস্টম্যান মারফত চলে যায় জেলা শহর কাজিতে, সেখান থেকে বাস যোগে চলে যায় হিমাচলের রাজধানী সিমলার রিচং পেওতে। সেখান থেকে ট্রেনযোগে ডাকের গন্তব্য কালকা। কালকা থেকে ফের বাস যোগে ডাক চলে যায় দিল্লি। দিল্লি থেকে প্রয়োজন সাপেক্ষে দেশ বা বিদেশের যেখানে ডাকের চিঠি বা অন্যান্য জিনিসপত্র পৌঁছানো দরকার, সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঠিক এর উল্টো চাকায় দিল্লি থেকে হিক্কিমে ডাকগুলো এসে থাকে।
১৯৮৩ সালে যখন পোস্ট অফিসটির কার্যক্রম শুরু হয়, তখন রেনচেন চ্যারিংই এই অফিসের একমাত্র জনবল ছিলেন। মাত্র ২২ বছরে তাকে পুরো একটি পোস্ট অফিসের দায়িত্ব দিয়ে দেয়ার পেছনে তার দুটি বিশেষ যোগ্যতা ছিল; প্রথমত তার নিজের একটি বাইসাইকেল ছিল, দ্বিতীয়ত পাহাড়ে মালামাল বহন করার জন্য ‘ইবেক্স’ নামক একটি বিশেষ প্রজাতির ছাগলের ব্যবহার রয়েছে, রেনচেন চ্যারিংয়ের একটি নিজস্ব ইবেক্সও ছিল।
তবে সারা বছর এই পোস্ট অফিসের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালানো সম্ভব হয় না। শীতকালে পুরো হিক্কিম ও তার পার্শবর্তী গ্রামগুলো বরফে ঢেকে যায়। এ সময়ে প্রায় ৬ মাস রেনচেন চ্যারিং তার পোস্ট অফিস বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।
হিক্কিম ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো একটি বিচ্ছিন্ন আবাসভূমি হলেও সেখানে কারা পত্র বা মালামাল পাঠায় এবং তাদের কাছেই বা কারা চিঠি-পত্র পাঠায়, এমন প্রশ্ন সবার মনে জাগতেই পারে। এর অনুসন্ধানে দুটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত, এই দুর্গম পাহাড়ে বসবাস করা কষ্টকর হওয়া এবং উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনা করার সুযোগ না থাকায় এখানকার অনেক যুবক অন্যত্র চলে যান। এদের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ পড়ালেখা করতেই অন্যত্র যান। তারা এই ডাকের মাধ্যমে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখেন। দ্বিতীয়ত, হিক্কিমের কাছেই রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ, মঠে বেশ কিছু সাধক সবসময় অবস্থান করেন। তারা প্রধানত ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে সাধনা করতে আসেন, ফলে তাদের মূল পরিবার থাকে হিক্কিম থেকে বহু দূরে কোথাও। সেসব আত্মীয় স্বজনদের সাথে এসব সাধকদের যোগাযোগের মাধ্যম এই পোস্ট অফিস। এভাবেই বেঁচে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ডাকঘরটি।
ফিচার ইমেজ- talesofahillgirl.blogspot.com