সময়টা ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। ভারত উপমহাদেশেও ব্রিটিশরা সদাসতর্ক জাপানি আগ্রাসনের হুমকিতে।
হিমালয়ের পার্বত্য এলাকাতে প্রায় ষোল হাজার ফুট উচ্চতায় রোজকার মতো টহলে বেরিয়েছেন মাধওয়াল নামে এক বনরক্ষী। শীত শেষ হয়ে এসেছে, তুষার গলে পথঘাট আবার হয়ে উঠছে চলাচলের জন্যে উপযুক্ত। সুতরাং বেশ ফুরফুরে মন নিয়েই চলছেন তিনি।
মাধওয়ালের পথে পড়ে রূপকুণ্ড হ্রদ। বছরের বেশিরভাগ সময়েই হিমালয়ের ঠাণ্ডায় জমে থাকে এর পানি। বাকি সময় বরফ গলে স্বচ্ছ টলটলে এই হ্রদ তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। চলার পথে এই সৌন্দর্য খুব একটা দেখা হয় না মাধওয়ালের। কিন্তু আজ কী এক অজানা কারণে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রূপকুণ্ডের দিকে। সাথে সাথেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পানির নিচে কী দেখা যাচ্ছে? হাড়গোড় না?
মাধওয়াল সাথে সাথেই বড়কর্তাদের খবর দিলেন। সমস্ত তুষার গলে গেলে প্রায় শ’খানেক কঙ্কাল আবিষ্কার হলো হ্রদের তলদেশে। সবই মানুষের। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে রূপকুণ্ডের নাম হয়ে গেল স্কেলিটন লেক বা কঙ্কাল হ্রদ।
রূপকুণ্ড
রূপকুণ্ড (Roopkund) হিমালয়ের একটি ছোট্ট হ্রদ। সাগরসমতল থেকে ১৬,৫০০ ফুট উঁচুতে এর অবস্থান।ভৌগোলিকভাবে রূপকুণ্ড পড়েছে ভারতের উত্তরখণ্ড প্রদেশে, তিব্বতের সীমান্ত এর মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল উত্তরে। মাত্র ১৩০ ফুট চওড়া আর ১০ ফুট গভীর রূপকুণ্ড জনমানবহীন এক অঞ্চলে অবস্থিত। সবথেকে কাছের জনবসতির নাম ওয়ান (Wan)। তা-ও প্রায় পাঁচ দিনের রাস্তা। রূপকুণ্ডের পার্শ্ববর্তী এলাকা কুখ্যাত যখন তখন ওঠা ঝড়ের জন্যে। বছরের বেশিরভাগ সময় তুষারে জমে থাকা পথঘাটও পর্যটকদের বিপদের কারণ। ফলে বহু বছর জনমানুষের আনাগোনা এখানে ছিল না বললেই চলে।
রহস্যের সূচনা
কোথা থেকে এলো এসব কঙ্কাল? কারাই বা এই হতভাগ্য মানুষ? তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সবকিছুতেই জাপানিদের ছায়া দেখতে পেতেন। কাজেই প্রাথমিকভাবে তারা মনে করলেন হিমালয় পার হয়ে ব্রিটিশ এলাকায় অতর্কিতে হামলা চালাতে আসা কোনো জাপানি সেনাদল হতে পারে এরা। তবে খুব শীঘ্রই বোঝা গেল- এসব কঙ্কাল এখানে পড়ে আছে কম করে হলেও শ’খানেক বছর। কাজেই জাপানি কোনো সেনাদল এরা হতেই পারে না।
দেশ বিভাগের পর ১৯৫৬ সালে ভারতের কলকাতার নৃতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (Anthropological Survey of India) রূপকুণ্ডে জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম জরিপ বানচাল হয়ে যায় তুষারঝড়ে। দুই মাস পর দ্বিতীয় অভিযানে হ্রদ থেকে বেশ কিছু নমুনা নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। কার্বন ডেটিং করে কঙ্কালগুলোর বয়স বের করা হয়। এই পদ্ধতিতে দেখা যায়, এসমস্ত কঙ্কাল ৫০০-৮০০ বছরের পুরনো। উল্লেখ্য, কার্বন ডেটিং তখনও খুব উন্নত ছিল না। এবং কিছু ক্ষেত্রে এর ফলাফল পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রূপকুণ্ড নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল মহলেও বেশ আগ্রহ ছিল। অনেকে ধারণা প্রকাশ করলেন, এরা হয়তো কোনো ধর্মীয় আচার পালনের মানসে নিজেদের একসাথে উৎসর্গ করেছে। কারো কারো মত ছিল, এগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানের পাঠানো তিব্বতে অভিযান চালাতে যাওয়া সেনাদের দেহাবশেষ। এই তত্ত্বের বিরোধিতা করে আরেকদল দাবি করলেন, এরা সেনাসদস্য না, বরং এরা সাধারণ বণিক যারা তিব্বতে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য মতের মধ্যে ছিল রূপকুণ্ড একসময় স্থানীয় বাসিন্দাদের কবর দেয়ার স্থান ছিল অথবা কোনো মহামারীতে মৃত্যুবরণকারীদের দেহ এখানে ফেলে দেয়া হয়েছিল।
রূপকুণ্ডের মিথলজি
পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের মুখে বংশপরম্পরায় রূপকুণ্ড নিয়ে একটি গল্প চালু আছে। হিমালয় এলাকার একটি পবিত্র পর্বতচূড়া নন্দদেবী। নন্দদেবীর দেবীরূপ পার্বতী, হিন্দু ধর্মে যাকে শিবের স্ত্রী বলে মনে করা হয়।
নন্দদেবী/পার্বতীর উদ্দেশ্যে প্রতি বার বছর অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় তীর্থযাত্রা (Nanda Rat Jat Yatra)। হাজার বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যায় সম্ভবত যেকোনো তীর্থের সবথেকে বিপদজনক পথে। আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি পথ, বরফঢাকা রাস্তা, ঝড়ঝঞ্ঝা সব অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছান নন্দদেবীর একদম কাছে, হোমকুণ্ডে। এই লম্বা যাত্রার একপর্যায়ে পাহাড়ি পথ ধরে তাদের পার হতে হয় রূপকুণ্ড। এই সরু পথ উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে, হ্রদের ঠিক উপর বরাবর। একটু এদিক ওদিক হলেই পা ফসকে পড়তে হবে হ্রদের বরফশীতল পানিতে।
আঞ্চলিক উপকথা বলে, একবার পার্বতী বহু দূরের এক রাজ্যে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখানকার রাজা-রানি তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে দেবী রাগান্বিত হন। তার অভিশাপে রাজ্যে নেমে আসে খরা, দুর্ভিক্ষসহ নানা দুর্যোগ। অনন্যোপায় রাজা শাপমোচনের জন্য দেবীর উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেন। কিন্তু বিলাস-ব্যসনে অভ্যস্ত রাজকীয় শরীর কি কঠিন এই ভ্রমণ সইবে? রাজা তাই সাথে নেন জাঁকজমকের সকল আয়োজন। তার মনোরঞ্জনের জন্য নর্তকীদেরও স্থান হয় কাফেলাতে।
দেবী রাজার কাণ্ডকারখানা দেখে আরো রেগে গেলেন। রূপকুণ্ডের সরু রাস্তা বেয়ে যাবার সময় নর্তকীদের ধাক্কা দিয়ে তিনি ফেলে দিলেন পাতালপুরীতে (মতান্তরে তাদের পরিণত করলেন পাথরে)। এরপর তার পাঠানো ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে রাজাসহ তার সফরসঙ্গীদের সলিল সমাধি হলো রূপকুণ্ডে। তাদের কঙ্কাল দেবী রেখে দিলেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সতর্ক সংকেত হিসেবে, কেউ যেন দেবীকে ক্রোধান্বিত না করে।
উইলিয়াম স্যাক্স
অনেক বছর ধরে রূপকুণ্ড পাশ্চাত্যের কাছে অচেনা ছিল। ১৯৭০ সালে উইলিয়াম স্যাক্স নামে নৃতত্ত্বের এক ছাত্র ভাগ্যগুণে কিছু ভারতীয় বই পড়তে গিয়ে রূপকুণ্ডের ব্যাপারে জানতে পারেন। মহা উৎসুক হয়ে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে তিনি ওয়ানে এসে হাজির হন। স্থানীয় এক গাইড তাদের হ্রদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ঝড় ঠেলে স্যাক্স রূপকুণ্ড দেখে এলেন।
রূপকুণ্ড আর পার্বতীর কাহিনী স্যাক্সকে করেছিল শিহরিত। নিজের থিসিসের বিষয় তাই তিনি নির্ধারণ করেন নন্দ দেবীর পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকগাথার বিশ্লেষণ। আশির দশকে পাশ্চাত্যের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে স্যাক্স নন্দ দেবীর তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৯১ সালে লেখেন মাউন্টেন গডেস নামে এক পুস্তক। ইউরোপ আমেরিকা জানল স্কেলিটন লেকের অমীমাংসিত রহস্যের কথা।
স্যাক্স প্রথম রূপকুণ্ড ঘুরে যাবার পর থেকে এখানে পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছিল হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। কোনো পাহারা না থাকায় অনেক দুঃসাহসী পর্যটক পানিতে পড়ে থাকা কঙ্কাল নাড়াচাড়া করে দেখেন, ফলে অনেক হাড় স্থানচ্যুত হয়। কেউ কেউ এককাঠি আগ বেড়ে নিজের মনে করে কিছু হাড়গোড় নিয়ে চলে যান।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
রূপকুণ্ডের কঙ্কাল জনসমক্ষে আসার পর চালানো হয়েছে বেশ কিছু গবেষণা। এতে প্রমাণিত হয়েছে কঙ্কালগুলো পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের। ফলে সেনাদলের সদস্য তারা হতে পারে না। এদের বয়স ৩৫-৮০ বছরের মধ্যে, এবং তেমন কোনো রোগের সন্ধানও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে পাওয়া যায়নি। ফলে রূপকুণ্ড কবরখানা হিসেবে ব্যবহৃত হত এমন চিন্তাও নাকচ হয়ে গেল। এরা তিব্বতগামী বাণিজ্যদল ছিল এমন ধারণাতেও পানি ঢেলে দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানালেন, এই অঞ্চল দিয়ে তিব্বত আর ভারতের মধ্যে কোনোকালে কোনো বাণিজ্যপথের খবর পাওয়া যায়নি। তাছাড়া বাণিজ্য কাফেলা হলে এদের সাথে মালপত্র থাকার কথা? সেই চিহ্ন কই? হ্রদ থেকে কেবল পাওয়া গিয়েছিল চামড়ার জুতা আর নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিস।
২০০৪ সালে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকেরা রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলো নিয়ে বড় আকারে পরীক্ষা নিরিক্ষা চালালেন। বেশ কিছু মাথার খুলি পরীক্ষা করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এমন কিছু ক্ষত দেখেন যা শিলার আঘাতে সৃষ্টি হতে পারে। ফলে তাদের তত্ত্ব ছিল সম্ভবত ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছে।
ততদিনে কার্বন ডেটিং আরো আধুনিক হয়েছে। ফলে নতুন করে বয়স নির্ধারণ করতে নমুনা পাঠানো হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। টম হিঘাম নামে একজন বিশেষজ্ঞ এই পরীক্ষা করেন। তার রায় ছিল- এই কঙ্কালগুলোর সবই নবম শতকের, যারা একসাথে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে। ফলে কোনো একটি ঘটনাই সবার মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে বলে মত দেন তিনি।
সব ফলাফল একত্রিত করে বিজ্ঞানীদের এই দল অবতারণা করলেন তাদের তত্ত্বের। তারা জানালেন, সম্ভবত ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নন্দ দেবীর তীর্থে যাচ্ছিলেন একদল মানুষ। রূপকুণ্ডের উপরের পাহাড়ি পথ পার হতে তাদের সহায়তা করছিলেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এমন সময় শুরু হয় তুষারঝড় আর শিলাবৃষ্টি। কাফেলার সবাই মারা পড়ল।। তাদের দেহ চাপা পড়ে যায় বরফে। এরপর কয়েক বছর ধরে তুষারধ্বস তাদের মরদেহ টেনে নিয়ে যায় রূপকুণ্ডের তলে।
নতুন ধোঁয়াশা
২০০৪ সালের গবেষণা পর রূপকুণ্ডের রহস্য মীমাংসিতই মনে হচ্ছিল। কিন্তু নতুন এক গবেষণা একে আরো ঘনিভূত করে তুলল। বছরখানেক আগে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির বিজ্ঞানীরা রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলোর জিনগত বিশ্লেষণ করেন। তাদের অন্যতম ছিলেন ভারতের বীরবল-সাহনি ইন্সটিউটের ডক্টর নিরাজ রাই এবং হার্ভার্ডের ডেভিড রেইখ। তারা ৩৮টি কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করে ২৩ জনকে পুরুষ এবং ১৫ জনকে মহিলা হিসেবে সনাক্ত করেন।
ডক্টর রাই এবং ডেভিড আরো দেখতে পান যে, ২৩টি কঙ্কাল দক্ষিণ এশিয়ান বংশগতির চিহ্ন বহন করছে। এরা সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মারা গিয়েছিল। ফলে আগে যেমন বলা হয়েছিল সবাই একসাথে কয়েক ঘণ্টার মাঝে মৃত্যুবরণ করেছে, ডিএনএ-র ফলাফল তার সাথে দ্বিমত করল। এদের প্রায় এক হাজার বছর পর আরো কিছু মৃতদেহ যুক্ত হয়। এদের একদল পূর্ব এশিয়ার। আশ্চর্যজনকভাবে অপরদল ছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার।
রহস্য জট পাকিয়ে গেল এখানেই। এশিয়ান যারা তারা হয়তো তীর্থযাত্রী হতে পারে। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের লোক এখানে কী করছিল? যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন হিমালয় এলাকার সাথে ভূমধ্যসাগরীয় জনবসতির যোগাযোগের কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তাহলে এরা কী করছিল এখানে? কীভাবেই বা মৃত্যু হলো এতগুলো লোকের? তাদের কঙ্কাল কেনই বা ঠাঁই করে নিল বরফগলা হ্রদের পানির নিচে?
এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি এসব প্রশ্নের। কাজেই রূপকুণ্ড নিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক আর অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব চলছে। এর ফাঁকে ব্যবসা করে নিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানিও, যারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে আগ্রহী পর্যটকদের নিরপাদে ঘুরিয়ে আনবে কঙ্কাল হ্রদ।