তিব্বতের তাংগুলা পর্বতমালার বরফগলা পানি থেকে জন্ম নিয়েছে চীনের তথা এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী। পশ্চিমারা একে ইয়াংৎসি নামে ডাকে, যার অর্থ ‘সমুদ্রের সন্তান’। তবে চীনাদের কাছে এই নদীর নাম ছাং চিয়াং, যার অর্থ ‘বড় নদী’। সাংহাই শহরের কাছে পূর্ব চীন সাগরে মিলিত হওয়ার আগে এ নদী পাড়ি দিয়েছে প্রায় ৬,৩০০ কিলোমিটার। নীলনদ ও আমাজন নদীর পর এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী। যেকোনো দেশের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেওয়া সবচেয়ে বড় নদীও এটি।
ইয়াংৎসি নদীটি চীনের ১০টি প্রদেশ পাড়ি দিয়েছে। এ নদীর রয়েছে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। উঁচু মালভূমি থেকে শুরু করে নিম্নভূমি দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে এটি। তবে তিন-চতুর্থাংশই পাহাড়ি অঞ্চল। কিছু কিছু অঞ্চলে রয়েছে গভীর উপত্যকা, গিরিখাত ও গিরিসঙ্কট। নদীর মাঝামাঝি অংশে আছে তিন গিরিসঙ্কট; কিউট্যাং, উ এবং শিলিং শিয়া। এই শিলিং গিরিসঙ্কটেই নির্মাণ করা হয়েছে থ্রি গর্জেস ড্যাম বা তিন গিরিসঙ্কটের বাঁধ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
প্রায় দুই দশক ধরে কার্যক্রম চলার পর ২০০৮ সালে এ বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। বাঁধটির উচ্চতা ১৮৫ মিটার, যা প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান। প্রস্থের দিক দিয়ে এটি প্রায় ২,৩০৯ মিটার। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২,৫০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে এটিই বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ, যা ব্রাজিলের ইতাইপু বাঁধকে (১২,৫০০ মেগাওয়াট) ছাড়িয়ে গিয়েছে। নাসার তথ্যমতে, এটি মানবসৃষ্ট স্থাপনাগুলোর একটি, যা মহাকাশ থেকে খালি চোখে দেখা যায়। চীনের মহাপ্রাচীরের পর এটিই তাদের সবচেয়ে বড় স্থাপনা এবং জাতীয় গর্ব। তবে এ নিয়ে চীনাদের ভোগান্তির পরিমাণও কম নয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে এ বাঁধ অনেক বিতর্কও সৃষ্টি করেছে।
বাঁধের ইতিহাস
চীনে বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৮ অব্দ থেকেই তারা বাঁধ নির্মাণ করে আসছে। মৌসুমী বন্যা প্রতিরোধে ইয়াংৎসি নদীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৫ থেকে বাঁধ নির্মিত হয়ে আসছে। তবে আধুনিক বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সেগুলো খুব বিচ্ছিন্নভাবেই হয়ে আসছিল। ১৯৪৯ সালে যখন চীনে মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির শাসন শুরু হয়, তখন তাদের বড় বাঁধের সংখ্যা ছিল মাত্র ২২টি। ১৯৪৯ সালের পর দেশটিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে, চীনে আজ মোট বাঁধের সংখ্যা প্রায় ৮৭ হাজার। এর মাঝে বড় বাঁধের সংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি, যা বিশ্বের মোট বাঁধের ৪১ শতাংশ।
ইয়াংৎসি নদীতে বিশাল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা অবশ্য মাওয়ের আমলে হয়নি। বরং তিনি ক্ষমতায় আসার আরো ৩০ বছর আগে থেকেই এখানে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেন। ১৯১৯ সালে তিনি ‘অ্যা প্ল্যান টু ডেভেলপ ইন্ডাস্ট্রি’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেন, যাতে ইয়াংৎসি নদীতে একটি বড় বাঁধের প্রস্তাবনা করেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।
ত্রিশের দশকে ইয়াংৎসি নদীর উঁচু অংশে বড় বাঁধ নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য বেশ কয়েকবার জরিপ করা হয়। ১৯৪৪ সালে আমেরিকান বাঁধ নির্মাণ বিশেষজ্ঞ জে এল সেভেজকে চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইয়াংৎসি নদীতে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে দেখার জন্য। দু’ বছর পর বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে আমেরিকার সাথে চীনের চুক্তি হয় এবং ৫০ জন চীনা প্রযুক্তিবিদকে আমেরিকায় পাঠানো হয় প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ১৯৪৭ সালে চিয়াং কাই-শেক সরকার এ প্রকল্প বাতিল করে দেয়।
পরবর্তী সময়ে মাও সে তুং ক্ষমতায় এসে ১৯৫৩ সালে এ নদীতে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। তবে এ প্রকল্প নিয়ে আলোচনায় জোর দেয় ১৯৫৪ সালের ইয়াংৎসি নদীর ভয়াবহ বন্যা। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। পরের বছর সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের সাথে এ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে ইয়াংৎসি ভ্যালি প্ল্যানিং অফিস স্থাপনা করা হয় থ্রি গর্জেস প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। অফিসের প্রধান লিন ইশান এখানে ২৫০ মিটার উচ্চতার বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবনা দেন, যাতে মূল উদ্দেশ্য থাকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু, বিদ্যুৎ শক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা লি রুই বাঁধটির বন্যা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং তুলনামূলক কম উচ্চতার বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দেন।
প্রেসিডেন্ট মাও তখন ‘হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স মুভমেন্ট’ নামে একটি প্রচারণা শুরু করেন। এতে তিনি চীনের বুদ্ধিজীবীদের আহবান করেন দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য এবং সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য। এতে তিনি অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হন। এমনকি তার ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার দাবিও ওঠে। থ্রি গর্জেস বাঁধ নিয়ে প্রকৌশলীরাও প্রতিবাদ করেন। ১৯৫৭ সালে মাও এ প্রচারণা বন্ধ করে দেন। তখন সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ডানপন্থী বিরোধী প্রচার শুরু করেন। থ্রি গর্জেস নিয়ে যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদের ডানপন্থী বলে সম্বোধন করা শুরু করেন ও কারাগারে প্রেরণ করেন। অনেক বিতর্কের পর এ প্রকল্প কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা অনুমোদিত হয়।
মাও চাইতেন, তার দেশে যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকে। তিনি ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে ব্যক্তিগতভাবে থ্রি গর্জেস প্রকল্প তদারকি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মাওয়ের একটি বিখ্যাত কবিতাতেও এ প্রকল্পের কথা আসে। যদিও তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় প্রকল্পের শুরু দেখে যেতে পারেননি। ১৯৫৯ সালে বাঁধ নির্মাণের জন্য স্যানদুওপিং অঞ্চলকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কিন্তু মাওয়ের গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড পরবর্তী দুর্ভিক্ষ ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
প্রায় দুই দশক পর ১৯৭৯ সালে চীনের ক্ষমতায় আসেন দেং শিয়াওপিং। তিনিও এ প্রকল্পে জোর সমর্থন দেন। ১৯৮২-৮৩ সালে নতুন জরিপে ১৭৫ মিটার উচ্চতার বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯৮৬ সালে। কিন্তু থ্রি গর্জেস প্রকল্প নিয়ে চীনের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন আন্দোলন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিলেন। ফলে, কয়েক দফায় জরিপ কাজ চলতে থাকে। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন চত্বরে সরকার বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে এ আন্দোলন দমন করা হয়। আন্দোলনের পর থ্রি গর্জেস প্রকল্প নিয়ে বিরোধিতা নিষিদ্ধ করা হয়। বিরোধিতাকারী শীর্ষ নেতাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অবশেষে ১৯৯৩ সালে থ্রি গর্জেস প্রকল্প নির্মাণ কমিটি এর প্রাথমিক নকশা অনুমোদন করে। এ নকশায় বাঁধের উচ্চতা রাখা হয় ১৮৫ মিটার, যাতে আবদ্ধ জলাধারের পানির উচ্চতা থাকবে ১৭৫ মিটার। ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, এ প্রকল্প নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। যদিও ১৯৯৩ সাল থেকেই সেখানে মাটি ফেলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
প্রকল্পের লক্ষ্য
থ্রি গর্জেস প্রকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নৌপরিবহণ- ইত্যাদি বহুমুখী লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাস্তবায়ন করা হয়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ
থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল ইয়াংৎসি নদীর মাঝামাঝি ও নিম্নবর্তী অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ। ঐতিহাসিকভাবে এ নদীর বন্যার কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছিল চীনের নিয়মিত ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দে হ্যান রাজবংশের শুরু থেকে ১৯১১ সালে চিং রাজবংশের পতন পর্যন্ত এই নদীর কারণে ২১৪ বার বন্যার রেকর্ড পাওয়া যায়।
১৮৭০ সালের বন্যায় প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা ছিল ১৯৩১ সালের বন্যা। এতে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৩৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার কৃষি জমি প্লাবিত হয়। ১৯৩৫ সালের বন্যায় ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার কৃষি জমি ডুবে যায়।
১৯৫৪ সালের বন্যায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ২ কোটি মানুষ এ বন্যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার কৃষিজমি ধ্বংস হয় এবং বেইজিং-গুয়াংজু রেলপথ ১০০ দিনের জন্য বন্ধ থাকে। এ বন্যায় চীনের ১০ বিলিয়ন চীনা ইউয়ানেরও বেশি (বর্তমান সময়ের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইয়াংৎসি নদীতে এর আগে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদী তীরবর্তী বাঁধ বা লেভি এবং পাথর দ্বারা তৈরি আল বা ডাইক নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। চীন সরকার তাই ড্যাম বা নদী মধ্যবর্তী অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণে আগ্রহী হয়। বাঁধ বিরোধীদের দাবি ছিল, তীরবর্তী বাঁধগুলোর উচ্চতা আরো বাড়ানো হোক। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে চীন সরকার তা নাকচ করে দেয়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সময়ে বাঁধঘেরা জলাধারের পানির উচ্চতা ১৪৫ মিটারে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঁধের নিচে স্লুইস গেট দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি বের করা হবে। এতে প্রায় ২২.১ বিলিয়ন ঘনমিটার বন্যার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এটি পলিমাটিও প্রবাহিত করে সরিয়ে দেবে। কারণ, বছরের এ সময়টাতে নদীর তলদেশে সবচেয়ে বেশি পলিমাটি জমে। অক্টোবর থেকে এপ্রিলের শুকনো মৌসুমে আবার পানির উচ্চতা ১৭৫ মিটারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। থ্রি গর্জেস বাঁধকে তীব্র বন্যা ও রিখটার স্কেলে ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবেলা করার উপযোগী করে নকশা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় কারণ দেখানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। সত্তরের দশকের শুরুতে চীনে বিদ্যুতের চাহিদা কম ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। আশির দশকে কারখানাগুলো বৈদ্যুতিক ক্ষমতার ৭০-৮০ ভাগ ব্যবহারে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। শহর অঞ্চলে লোডশেডিং ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
বিদ্যুৎ সমস্যার স্বল্পস্থায়ী সমাধান হিসাবে আশির দশকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু কয়লার স্বল্প মজুদ ও পরিবেশ দূষণের কারণে বিকল্প উপায় খোঁজা জরুরি হয়ে পড়ে চীনের জন্য। কয়লার তুলনায় জলবিদ্যুৎ ছিল তুলনামূলক পরিবেশসম্মত। একে বৈদ্যুতিক সঙ্কটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসাবে বিবেচনা করা শুরু হয়। এ উদ্দেশ্যে নব্বই দশকে বড় বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল থ্রি গর্জেস ড্যাম।
অনুমান করা হয়, থ্রি গর্জেসে উৎপন্ন বিদ্যুতের ৫২ শতাংশ সরবরাহ করা হবে মধ্য চীনে, ৩২ শতাংশ পূর্ব চীনে এবং ১৬ শতাংশ দক্ষিণ চীনে। সমগ্র চীনের ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে থ্রি গর্জেস বাঁধ থেকে, এমনটাই দাবি করা হয়।
নৌ পরিচালনা
থ্রি গর্জেস বাঁধ প্রকল্পের তৃতীয় কারণ দেখানো হয় ইয়াংৎসি নদীতে নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম চীনের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ইয়াংৎসি নদী। নদীর শাখা-প্রশাখা থেকে ৩,৬০০ নৌপরিবহনের উপযোগী নদী তৈরি হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ৭৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। এর মাঝে ২,৫০০ কিলোমিটার অঞ্চল এক হাজার টনের চেয়ে বেশি ভারি নৌযান চলাচলের উপযোগী। ষাট ও সত্তরের দশকে রেলপথ স্থাপনের পূর্বে সিচুয়ান প্রদেশে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল ইয়াংৎসি নদী।
কিন্তু ইয়াংৎসি নদীর সকল অঞ্চল নৌপরিবহনের উপযোগী ছিল না। বিভিন্ন স্থানে বালুর চর ও নদীর অগভীরতার কারণে নৌযান চলাচল দুরূহ ব্যাপার ছিল। থ্রি গর্জেস বাঁধ দিয়ে এ সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ, এটি নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বাড়াবে। এতে নৌপথে বার্ষিক পরিবহনের খরচ ৩৫-৩৭ শতাংশ কমে আসবে বলে মনে করা হয়। নৌপরিচালনার উন্নয়নের ফলে ইয়াংৎসি নদী পর্যটন খাতেও এগিয়ে যাবে মনে করা হয়।
থ্রি গর্জেস বাঁধ প্রকল্প
বাঁধটি হুবেই প্রদেশের ইচ্যাং শহর থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইয়াংৎসি নদীর এ অঞ্চলে খাড়া গিরিখাতের সমষ্টি সমাপ্ত হয়েছে, যা প্রায় ৬৩০ কিলোমিটার জলাধারের সৃষ্টি করেছে। এর গড় প্রশস্ততা ১.৩ কিলোমিটার ও পানিধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩৯.৩ বিলিয়ন ঘনমিটার।
এ বাঁধের রয়েছে ৩৪টি জেনারেটর, যার ৩২টিই মূল জেনারেটর। বাকি দু’টি জেনারেটরের প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। বাঁধ নির্মাণে সময় লাগে ১৭ বছর। তিন ধাপে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। প্রথম ধাপে নদীর বাঁদিকের তীরে ৭০০ মেগাওয়াটের ৩২টি ফ্রান্সিস ইউনিটের ১৪টি স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে বিপরীত তীরে আরো ১২,৭০০ মেগাওয়াট ইউনিট যোগ করা হয়। ফলে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ১৮,২০০ মেগাওয়াটে। এ ধাপে বাঁধের উচ্চতা নিয়ে আসা হয় ৮৭ মিটারে। নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চলে ১৩৫ মিটার উঁচু স্থায়ী ‘শিপ লক’ নির্মাণ করা হয়, যাতে ১৪টি টারবাইন থাকে। শিপ লকের মাধ্যমে পাহাড়ি নদীর পানি নৌযান চলাচলের উপযোগী করা হয়।
তৃতীয় ও শেষ ধাপে বাঁধের উচ্চতা ১৮৫ মিটারে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলের দিকে আরো ১২টি টারবাইন যোগ করা হয়। ২০১২ সালে এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ২২,৫০০ মেগাওয়াট। একমুখী জাহাজ উত্তোলন প্রক্রিয়াও যোগ করা হয়। এতে সর্বোচ্চ ১১৩ মিটার উচ্চতার ও ১১,৮০০ টন ওজনের জাহাজ উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
থ্রি গর্জেস বাঁধ নিয়ে বিতর্ক
বাঁধের বৃহৎ জলাধার নির্মাণের জন্য ইয়াংৎসি নদীর তীরবর্তী প্রায় ১৪ লাখ লোককে সরে যেতে হয়েছে। এদের বেশিরভাগই ছিল গরিব কৃষক ও জেলে। তাদের বাসস্থান ও কৃষিজমি ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ১১৪টি শহর ও ১,৬৮০টি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণের এর আগে চীনের তিন বৃহৎ বাঁধ মিলিয়েও এত মানুষকে তাদের বাসস্থান ছাড়তে হয়নি। কর্তৃপক্ষ তাদের সরে যেতে বললেও পর্যাপ্ত বাসস্থান বা ক্ষতিপূরণ দেয়নি। বরং স্থানীয় সরকার তাদের জন্য আসা ফান্ড থেকে দুর্নীতি করেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কঠোরভাবে দমন করেছে। ২০১৩ সালে চীন সরকার দুর্নীতির এ অভিযোগ স্বীকার করে।
বাঁধ নির্মাণের ফলে নতুন যে পাহাড়ি তীর সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো কৃষিকাজের জন্য উপযোগী নয়। কৃষকদের এসব অনুর্বর জমিতে কৃষিকাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে, তাদের আয় প্রায় ২০ শতাংশ কমে গিয়েছে এবং এ অঞ্চলের মানুষজন কার্যত গৃহহীন ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বাঁধের ফলে যে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয়েছে, এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১.১২ কিলোমিটার; পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল প্রায় ১,০৪৫ কিলোমিটার। এ জলাধারের পানি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩৯.৩ ঘন কিলোমিটার, যার ভর ৩৯ ট্রিলিয়ন কিলোগ্রামেরও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ পানি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫ মিটার উচ্চতায় থাকার ফলে এর প্রভাব গিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিতেও পড়বে। কোনো অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণনরত বস্তুর ঘূর্ণন গতিকে বাধা দেওয়ার প্রয়াসকে জড়তার ভ্রামক বলা হয়। অক্ষ থেকে ঘূর্ণনরত বস্তুর দূরত্ব যত বেশি হয়, তার ঘূর্ণন গতিও তত কমে যায়। বাঁধের জলাধারের কারণে পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানে কিছুটা গোলাকার ও মেরু অঞ্চলে কিছুটা সমতল হয়ে পড়বে। ফলে পৃথিবীর জড়তার ভ্রামক বেড়ে যাবে এবং কমে যাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি। যদিও এ পরিমাণ খুবই অল্প। নাসার গবেষকদের মতে, এতে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ০.০৬ মাইক্রোসেকেন্ড বেড়ে যাবে।
তাছাড়া এতে ইয়াংৎসি নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। নদী দূষিত হচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়ায় নিচু এলাকার মাছ উঁচু স্থানে আসছে না। মাছের সংখ্যাও কমে গিয়েছে নদীতে। তাই এই নদীতে ১০ বছরের জন্য জেলেদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর পেছনে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করা হয় জেলেদের অতিরিক্ত মাছ ধরাকে। কিন্তু জেলেরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন, তারা বাঁধকেই দায়ী করেন। বাঁধ নির্মাণের আগে এক দিনে তারা ৪০-৪৫ কেজি মাছ ধরতে পারতেন। বাঁধ নির্মাণের পর তা নেমে আসে মাত্র ৫-১০ কেজিতে। এ অঞ্চলে সামুদ্রিক যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও শব্দ দূষণে স্থানীয় জলজ প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
২০০৩ সালের জুনে জলাধার নির্মাণের পর সেখানে ভূমিকম্পও বেড়ে গিয়েছে। জলাধার নির্মাণের পর থেকে পরবর্তী ছয় বছরে সেখানে ভূমিকম্প হয় ৩,৪২৯ বার। ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৩ সালের মে পর্যন্ত যে সংখ্যা ছিল মাত্র ৯৪ বার। বাঁধের কংক্রিটের দেওয়ালে ৮০টি ক্ষুদ্র ফাটল দেখা গিয়েছে। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যে উদ্দেশ্যে এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, সে বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। গত জুন মাসে ইয়াংৎসি নদীর অববাহিকায় ৬০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে, ইয়াংৎসি ও এর শাখা নদীগুলো বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অন্তত ২১৯ জন মানুষ মারা যায় বা নিখোঁজ হয়। ৬ কোটি ৩৪ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৫৪,০০০ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ২৫.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। থ্রি গর্জেস বাঁধও এর কবলে পড়ে। তখন এই বাঁধ ভেঙে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা যায়। যদিও চীন সরকারের দাবি, থ্রি গর্জেস বাঁধ সম্ভাব্য ১৮.২ বিলিয়ন ঘনমিটার বন্যার পানি আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এ প্রকল্প প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ১৯৯৩ সালে ধারণা করা হয়েছিল এটি চীনের ১০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করবে। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ার কারণে তা মাত্র ১.৩ শতাংশ পূরণ হচ্ছে।
এ বাঁধের কারণে চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ২০০০ সালে ধারণা করা হয়, এখানে প্রায় ১,৩০০ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন স্থান বাঁধের পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। ফলে, এ অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষদের জীবনধারা সম্পর্কে গবেষকদের গবেষণা করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।
তবে চীনের পক্ষ থেকে বাঁধকে নিরাপদ বলা হয়েছে। থ্রি গর্জেস বাঁধ গত আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ঘনমিটার বন্যার পানি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এতে বন্যার তীব্রতা প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টার বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করায় প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন টন কয়লার ব্যবহার কম হচ্ছে। এতে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা ১.১৬৯ বিলিয়ন টন কমে গিয়েছে। ইয়াংৎসি নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে এ বাঁধকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানা গড়ে উঠেছে।
থ্রি গর্জেস বাঁধ নিঃসন্দেহে চীনের তথা মানব সভ্যতার স্থাপনার অন্যতম নিদর্শন। এর বিতর্ক যেমন আছে, একে ঘিরে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ এটি মানব সম্প্রদায়ের গর্বের প্রতীক হিসাবে টিকে থাকবে, নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে, তা সময়ই বলে দেবে।