২০২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তির (Treaty of Lausanne) ১০০ বছর পূর্ণ হবে। এর পরপরই তুর্কি সৈন্যরা মসুল, ইদলিব ও আফরিন দখল করে নেবে, সাইপ্রাসের দক্ষিণাংশ তুরস্কের হস্তগত হবে, আর বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় এবং ভূমধ্যসাগরের গ্রিক দ্বীপগুলোয় একচ্ছত্র তুর্কি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে! অবশ্য বেশি উত্তেজিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ বাস্তবে এসবের কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। কিন্তু কার্যত তুরস্কের বিভিন্ন নিউজ শো থেকে শুরু করে নানা ধরনের তুর্কি ওয়েবসাইটে লুজান চুক্তির ১০০ বছর পূর্তি নিয়ে নানান গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
অবশ্য, এই গুজবগুলো যে কেবল তুরস্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। সম্প্রতি তুরস্ক থেকে সাড়ে ৫ হাজার কি.মি.–এরও বেশি দূরে অবস্থিত বাংলাদেশেও লুজান চুক্তি সংক্রান্ত গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি দেশটির অন্যতম প্রধান পত্রিকা প্রথম আলোতেও এ সংক্রান্ত গুজব উঠে এসেছে।
ওসমানীয় সাম্রাজ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং সেভ্রে চুক্তি
এ বিষয়ে আলোচনার পূর্বে লুজান চুক্তির পটভূমি সংক্ষেপে জেনে নেয়া জরুরি। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্য বা ‘মহিমান্বিত ওসমানীয় রাষ্ট্র’ (ওসমানীয় তুর্কি: Devlet-i ʿAlīye-i ʿOsmānīye, ‘দেভলেৎ–ই আলিয়ে–ই ওসমানিয়ে’) ছিল মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রস্থলস্বরূপ। প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাসে ওসমানীয় রাষ্ট্রের আয়তন বহু বার পরিবর্তিত হয়েছে। ১৬৮৩ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ৫২ লক্ষ বর্গ কি.মি., এবং এটিই ছিল ওসমানীয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সীমা।
কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ভূখণ্ড ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, এবং ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মোট আয়তন ছিল ১৫,৮৯,৫৪০ বর্গ কি.মি.। এ সময় বর্তমান তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্দান এবং ইয়েমেন ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ওসমানীয় রাজবংশের সুলতানরা কার্যত ওসমানীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ সালে সংঘটিত ‘তরুণ তুর্কি বিপ্লব’ ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে একটি ‘সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে’ পরিণত করে, এবং ১৯১৩ সালে সংঘটিত একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ‘তিন পাশা’ ওসমানীয় রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসনক্ষমতা হস্তগত করেন।
এই ‘তিন পাশা’ ছিলেন– প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা, যুদ্ধমন্ত্রী এনভের পাশা এবং নৌমন্ত্রী জেমাল পাশা। ১৯১৩ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যত এই তিনজনই ছিলেন ওসমানীয় রাষ্ট্রের মূল শাসক। ওসমানীয় সুলতান পরিণত হয়েছিলেন কার্যত একজন আলঙ্কারিক শাসকে। এদিকে ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ১৯১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ওসমানীয় নৌবাহিনী কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী রুশ সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
চার বছরব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ১৯১৮ সালের অক্টোবর নাগাদ ওসমানীয় সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মিত্রশক্তি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বড় একটি অংশ দখল করে নেয়, এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য শেষ হয়ে আসে। এমতাবস্থায় ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও মিত্রশক্তির মধ্যে যুদ্ধবিরতি সম্পাদিত হয়, এবং এর শর্তানুযায়ী ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালীয় ও গ্রিক সৈন্যরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যখন অবসান ঘটে, তখন কার্যত কনস্টান্টিনোপলসহ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সিংহভাগ মিত্রশক্তির করতলগত ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তি পরাজিত কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে পৃথকভাবে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে। একে একে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরির সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর সবশেষে ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট মিত্রশক্তি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে ‘সেভ্রে চুক্তি‘ স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি ছিল কেন্দ্রীয় শক্তির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর চেয়েও কঠোরতর।
এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ওসমানীয় সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির সদস্যদের কাছে যেসব ভূখণ্ড হারিয়েছিল (যেমন: মিসর, সাইপ্রাস, লিবিয়া প্রভৃতি), সেগুলোর ওপর থেকে নিজস্ব দাবি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্য তাদের সকল আরব ভূখণ্ড (ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্দান এবং ইয়েমেন ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ) হারায়। শুধু তাই নয়, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এবং কুর্দি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সামগ্রিক ভাগবাটোয়ারার পর ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশের আয়তন ছিল ৪,৫৩,০০০ বর্গ কি.মি.। শুধু তাই নয়, সেভ্রে চুক্তি অনুযায়ী, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশও কার্যত স্বাধীন থাকত না। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রিস মিলে ওসমানীয় রাষ্ট্রের অবশিষ্টাংশকেও নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে ভাগ করে নেয়।
এর পাশাপাশি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অর্থনীতির সমস্ত দিক ও ওসমানীয় ব্যাংকের কর্তৃত্বও মিত্রশক্তির হাতে সমর্পিত হয়। ওসমানীয় রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তির সকল সদস্যের পণ্য বিনা শুল্কে যাতায়াত করতে পারবে– এই নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের কর্তৃত্ব ওসমানীয়দের হাত থেকে পুরোপুরি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে নিয়ম প্রবর্তন করা হয় যে, ওসমানীয় সেনাবাহিনীতে ৫০,৭০০ জনে বেশি সৈন্য থাকবে না, ওসমানীয় নৌবাহিনীতে ৭টি স্লুপ ও ৬টি টর্পেডো বোট ছাড়া অন্য কোনো নৌযান থাকবে না, এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের কোনো বিমানবাহিনী থাকবে না। তদুপরি, মিত্রশক্তি আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য দায়ী ওসমানীয় কর্মকর্তাদের বিচার করারও ঘোষণা দেয়।
তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং লুজান চুক্তি
বলাই বাহুল্য, সেভ্রে চুক্তির শর্তাবলি ছিল ওসমানীয় রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু এ সময় সমগ্র ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সিংহভাগই কার্যত মিত্রশক্তির দখলে ছিল, তাই তাদের চাপিয়ে দেওয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ব্যতীত ওসমানীয় নেতাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। এদিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যেই মিত্রশক্তির দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল এবং ১৯১৯ সালেই তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা এশীয় তুরস্কের আঙ্কারায় একটি বিকল্প সরকারের সৃষ্টি করেছিল এবং ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ নামে নতুন একটি আইনসভা নির্বাচিত করেছিল। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সরকারের নেতা ছিলেন ওসমানীয় সেনাবাহিনীর বিখ্যাত সমরনায়ক মুস্তফা কামাল পাশা।
অর্থাৎ, সেভ্রে চুক্তি যখন স্বাক্ষরিত হয়, তখন ওসমানীয় সাম্রাজ্যে কার্যত দুইটি সরকার ছিল– মিত্রশক্তির অধিকৃত কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক ওসমানীয় সরকার এবং আঙ্কারাভিত্তিক গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সরকার। আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের বক্তব্য ছিল, তারাই তুর্কি জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি। তারা সেভ্রে চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং সেভ্রে চুক্তির পর মিত্রশক্তির সঙ্গে আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের সশস্ত্রবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তুরস্কের ইতিহাসে এটি ‘তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত।
তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার প্রধানত গ্রিস, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এবং ১৯২০ ও ১৯২১ সালে যথাক্রমে আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯২০ সালে কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক ওসমানীয় সরকারের সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া এবং আইনত স্বাধীন কিন্তু কার্যত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সোভিয়েত আজারবাইজান, সোভিয়েত বুখারা ও সোভিয়েত ইউক্রেন আঙ্কারাভিত্তিক সরকারকে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি ইতালি আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকে।
১৯২২ সালের অক্টোবর নাগাদ আঙ্কারাভিত্তিক সরকার গ্রিস, ফ্রান্স, আর্মেনিয়া ও কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক ওসমানীয় সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়, এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের জাতিগত তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সিংহভাগ তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের হস্তগত হয়। ১৯২২ সালের ১১ অক্টোবর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
যুদ্ধ শেষে প্রায় সাত মাসব্যাপী আলোচনার পর ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রুমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে সম্পাদিত হয় ‘লুজান চুক্তি‘, যেটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘লুজানে তুরস্কের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তি ও যুদ্ধবন্দি বিনিময় চুক্তি’। ফরাসি ভাষায় লিখিত এবং ১৪৩টি ধারাবিশিষ্ট এই চুক্তিটি আঙ্কারার গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ১৯২৩ সালের ২৩ আগস্ট অনুমোদন করে, এবং ১৯২৪ সালের ১৬ জুলাই নাগাদ অন্য রাষ্ট্রগুলোর আইনসভায়ও চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়।
এখন পর্যন্ত লুজান চুক্তি বলবৎ রয়েছে। লুজান চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সেভ্রে চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, এবং তখন থেকে চুক্তিটিকে আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে আসা হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে তুরস্কে এই চুক্তিটি সম্পর্কে নানান গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (conspiracy theory) ছড়িয়ে পড়েছে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘একেপি’র সমর্থকদের থেকে আরম্ভ করে তুর্কি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সমর্থকরা কেউই এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তারে পিছিয়ে নেই। এ ক্ষেত্রে একেপির সমর্থকদের ধারণা, লুজান চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে তুরস্ক ওসমানীয় আমলের শক্তি–সামর্থ্য বহুলাংশ ফিরে পাবে। আর একেপির বিরোধীদের ধারণা, লুজান চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে তুর্কি সরকার তুরস্কের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করে বিদেশিদের নানান সুযোগ–সুবিধা প্রদান করবে!
বলাই বাহুল্য, খুব কম সাধারণ মানুষই ১৪৩টি ধারাবিশিষ্ট লুজান চুক্তির পুরোটা পড়ে দেখেছে। এজন্য এটির সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানো খুবই সহজ ব্যাপার। এবং এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো যেহেতু তুরস্কের সীমানা অতিক্রম করে সুদূর বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে, সুতরাং এই ধারণাগুলোর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। চলুন, দেখে নেয়া যাক, লুজান চুক্তি সম্পর্কে কী কী ভ্রান্ত ধারণা সাধারণভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে।
(১) ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে
এই ভ্রান্ত ধারণাটির উৎপত্তি ঘটেছে দুইটি ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে। তুর্কি নাগরিকদের একটি অংশের মতে, লুজান চুক্তির একটি গোপন শর্ত রয়েছে, এবং এই শর্ত মোতাবেক লুজান চুক্তির মেয়াদ ১০০ বছর পূর্ণ হলে চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। অন্যদিকে, কিছু কিছু ব্যক্তির ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যে কোনো চুক্তিই ১০০ বছর পর বাতিল হয়ে যায়।
কিন্তু লুজান চুক্তির কোনো গোপন শর্ত আছে, সেটির কোনো প্রমাণ বিগত প্রায় এক শতাব্দীতে পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, কোনো গোপন চুক্তিই গোপন রাখা খুব বেশি দিন সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত গোপন ‘সাইকস–পিকো চুক্তি’ কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘মলোতভ–রিব্বেনট্রপ চুক্তি’র গোপন শর্তাবলি– কোনোটিই গোপন থাকেনি। এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন বৈঠকের মধ্য দিয়ে। এগুলোই যেহেতু গোপন থাকেনি, সেহেতু প্রকাশ্যে সম্মেলন আয়োজন করে সেখানে সম্পাদিত লুজান চুক্তির তথাকথিত ‘গোপন’ শর্তাবলি এক শতাব্দী ধরে গোপন থাকবে, এই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনে এ রকম কোনো নিয়ম নেই যে, কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ১০০ বছর পর চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। যদি চুক্তিটিতে সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ উল্লেখ করা না থাকে (যেমনটি ছিল ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদী ‘চীনা–সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি’তে) এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো যদি বিলুপ্ত না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে চুক্তিটি ১০০ বছর কেন, কয়েক শত বছর পরেও সচল থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ১৯২১ সালের ১৬ মার্চ সোভিয়েত রাশিয়া ও আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘মস্কো চুক্তি’র কথা বলা যায়। গত ১৬ মার্চ চুক্তিটির ১০০ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু চুক্তিটিতে যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদের উল্লেখ নেই, তাই ১০০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও চুক্তিটি কার্যকর রয়েছে।
অর্থাৎ, লুজান চুক্তির কোনো গোপন শর্ত রয়েছে এরকম কোনো প্রমাণ নেই, চুক্তিটি কবে শেষ হবে সে সংক্রান্ত কোনো মেয়াদ চুক্তিটিতে উল্লেখ করা হয়নি, এবং যুগোস্লাভিয়া ছাড়া চুক্তিটিতে স্বাক্ষরকারী অন্য কোনো রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়নি। সুতরাং, ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
(২) লুজান চুক্তির কারণে তুরস্ক খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারছে না
কিছু কিছু ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে, লুজান চুক্তিতে তুরস্ক কর্তৃক খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ওপর ১০০ বছর মেয়াদী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছে, এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো তুরস্ককে দরিদ্র ও অনুন্নত রাখা। তাদের বিশ্বাস, ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদের অবসান ঘটলে এই নিষেধাজ্ঞা সরে যাবে। এরপর তুরস্ক বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারবে এবং সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
কিন্তু লুজান চুক্তির ১৪৩টি ধারার কোনোটিতেই এমন কোনো শর্ত দেয়া নেই যে, তুরস্ক তার নিজের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মতো তুরস্ক তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ নয়, কিন্তু তুরস্কের প্রধান খনিজ দ্রব্য হচ্ছে ক্রোমাইট, বক্সাইট ও তামা, যেগুলো তুরস্ক নিয়মিতভাবে উত্তোলন করে থাকে। শুধু তাই না, ২০২০ সালে তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে তাদের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে, এবং সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থাও শুরু করেছে, যদিও তুরস্কের মূল ভূখণ্ডে গ্যাস সরবরাহ করতে তাদের এখনো কয়েক বছর সময় লাগবে।
লুজান চুক্তিতে যদি তুরস্ক কর্তৃক খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকতোই, তাহলে তুরস্ক এতদিন ক্রোমাইট, বক্সাইট, তামা বা অন্যান্য খনিজ উত্তোলন করতে পারত না, এবং কৃষ্ণসাগর থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রক্রিয়াও সরবরাহ করতে পারত না। সুতরাং, লুজান চুক্তির কারণে তুরস্ক খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারছে না– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
(৩) লুজান চুক্তির কারণে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে ৪০টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে
কিছু কিছু ব্যক্তির দাবি অনুযায়ী, লুজান চুক্তির কারণে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে প্রায় ৪০টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এই দাবির মধ্য দিয়ে তারা এটি দেখাতে চেষ্টা করেন যে, লুজান চুক্তির কারণে তুরস্ক বিরাট এক ভূখণ্ড হারিয়েছে। স্বভাবতই এই দাবির ফলে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের ওপর দোষারোপ করা হয়, কারণ তিনিই লুজান চুক্তির স্বাক্ষরকালে তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। এটি সত্যি, একসময় ওসমানীয় সাম্রাজ্য অতি বৃহৎ একটি রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের সিংহভাগ অংশই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ওসমানীয় সুলতানরা হারিয়েছিলেন, এবং এর সঙ্গে লুজান চুক্তি বা কামাল আতাতুর্কের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ১৫,৮৯,৫৪০ বর্গ কি.মি., এবং বর্তমান তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্দান এবং ইয়েমেন ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ সেসময় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বর্তমান বিশ্বের ৭টি রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ও ২টি রাষ্ট্রের অংশবিশেষ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ৪০টি রাষ্ট্র নয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বর্তমান তুরস্কের মূল ভূখণ্ডের সিংহভাগ বাদে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বাকি অংশ (ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, জর্দান, ইয়েমেন ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ) মিত্রশক্তির দখলে চলে যায়। ১৯২০ সালে যখন সেভ্রে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন এই অঞ্চলগুলো তো বটেই, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল এবং আনাতোলিয়ার অংশবিশেষও মিত্রশক্তির দখলে ছিল। তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার আনাতোলিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে সমর্থ হয়, এবং এজন্য লুজান চুক্তিতে আনাতোলিয়া, পূর্ব থ্রেসের অংশবিশেষ ও কনস্টান্টিনোপলকে তুরস্কের নিকট অর্পণ করা হয়।
কিন্তু লুজান চুক্তির সময় প্রাক্তন ওসমানীয় ভূখণ্ড ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্দান এবং ইয়েমেন ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দখলে ছিল। তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা এই ভূখণ্ডগুলো পুনর্দখলের কোনো চেষ্টা করেনি, কারণ সেই সামর্থ্য তখন তাদের ছিল না। এজন্য লুজান চুক্তিতে তারা এই ভূখণ্ডগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর পাশাপাশি ঈজিয়ান সাগরের তিনটি দ্বীপ/দ্বীপপুঞ্জ ছাড়া বাকি সমস্ত দ্বীপ গ্রিসের হস্তগত হয়। এখনকার আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধের মাধ্যমে অপর রাষ্ট্রের ভূমি দখল অবৈধ হতে পারে, কিন্তু সেসময় এটিই ছিল প্রচলিত নিয়ম, এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধের মাধ্যমে ভূমি দখলের মধ্য দিয়েই। সুতরাং এক্ষেত্রে তুর্কিদের অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সেভ্রে ও লুজান চুক্তির শর্তানুযায়ী, আঙ্কারাভিত্তিক সরকার সাইপ্রাস, মিসর, সুদান, লিবিয়া ও দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের ওপর থেকে সমস্ত দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। এর থেকে মনে হতে পারে, আঙ্কারাভিত্তিক সরকার লুজান চুক্তির মাধ্যমে বিরাট এক ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই বিভিন্ন সময়ে এই ভূখণ্ডগুলো ওসমানীয় সুলতানদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ১৮৭৮ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ব্রিটেনের নিকট সাইপ্রাসকে ইজারা দেয়, এবং ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা মিসর ও সুদান দখল করে। তখন থেকে এই ভূখণ্ডগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানীয় ভূখণ্ড ছিল, কিন্তু কার্যত ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যোগ দিলে ব্রিটেন এই উপনিবেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করে নেয়।
অনুরূপভাবে, ১৯১১–১৯১২ সালের ইতালীয়–ওসমানীয় যুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ইতালির নিকট পরাজিত হয় এবং লিবিয়া ও দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ ইতালির নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ, সাইপ্রাস, মিসর, সুদান, লিবিয়া ও দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ – এই ভূখণ্ডগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ওসমানীয় রাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ১৯২৩ সালে এগুলো পুনর্দখল করে নেওয়ার মতো সামর্থ্য আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের ছিল না, সুতরাং লুজান চুক্তিতে তারা বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে এই ভূখণ্ডগুলোর ওপর থেকে দাবি ত্যাগ করে।
সামগ্রিকভাবে, লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ৮টি ভূখণ্ড (বর্তমানে ৬টি রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ও ২টি রাষ্ট্রের অংশবিশেষ) মিত্রশক্তির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আগেই ওসমানীয়দের হাতছাড়া হওয়া ৫টি ভূখণ্ডের ওপর থেকে নিজেদের দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। এটি নিঃসন্দেহে বিরাট ভূখণ্ডগত ক্ষতি, কিন্তু লুজান চুক্তিতে ছেড়ে দেয়া ভূখণ্ড থেকে ‘৪০টি রাষ্ট্রে’র সৃষ্টি হয়নি, সর্বসাকুল্যে ১৩টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং, লুজান চুক্তির কারণে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে ৪০টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
(৪) লুজান চুক্তির অবসান ঘটলে তুরস্ক ইরাক ও সিরিয়ার অংশবিশেষ দখল করে নেবে
কারো কারো ধারণা, ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির অবসানের পর তুরস্ক ইরাকের তেলসমৃদ্ধ মসুল এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের অংশবিশেষ দখল করে নেবে। কিন্তু অন্যান্য ভ্রান্ত ধারণাগুলোর তুলনায় এটি আরো অযৌক্তিক। প্রথমত, লুজান চুক্তির মেয়াদ যে ২০২৩ সালে শেষ হবে না, সেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, লুজান চুক্তি বজায় থাকাকালে তুরস্ক অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না– এ রকম কোনো শর্ত লুজান চুক্তিতে নেই।
সর্বোপরি, লুজান চুক্তির সঙ্গে তুরস্ক কর্তৃক ইরাকি বা সিরীয় ভূখণ্ড দখলের সম্পর্ক সামান্যই। ১৯৭৪ সালে তুর্কি সৈন্যরা সাইপ্রাসের উত্তরাংশ দখল করে নেয়, এবং তখন থেকে উত্তর সাইপ্রাস কার্যত তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত একটি আশ্রিত রাষ্ট্র। ১৯৯০–এর দশক থেকে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের জন্য তুরস্ক উত্তর ইরাকে প্রায়ই সামরিক অভিযান পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশের অংশবিশেষসহ কিছু অংশ কার্যত তুর্কি সামরিক দখলদারিত্বের অধীন। এগুলোর কোনোটি করার জন্যই তুরস্ককে লুজান চুক্তি ভঙ্গ করতে হয়নি।
কাজেই তুরস্ক যদি ইরাক বা সিরিয়ার অংশবিশেষ দখল করতে চায়, তাদের সেজন্য ২০২৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, বা লুজান চুক্তি বাতিল করারও কোনো দরকার নেই। তারা এমনিতেই সেটা করতে পারে। অবশ্য এ রকম কিছু করলে তার যে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটির জন্যও তাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু এর সঙ্গে লুজান চুক্তির বা চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
সুতরাং, লুজান চুক্তির অবসান ঘটলে তুরস্ক ইরাক ও সিরিয়ার অংশবিশেষ দখল করে নেবে– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
(৫) লুজান চুক্তির কারণে তুরস্ক তুর্কি প্রণালীদ্বয়ে চলাচলকারী নৌযানগুলো থেকে শুল্ক আদায় করতে পারছে না
এটি সত্যি যে, লুজান চুক্তি অনুযায়ী, বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় (তুর্কি প্রণালীদ্বয়)-এর ওপর তুরস্কের কার্যত সামরিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৩৬ সালের ২০ জুলাই তুরস্ক, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, গ্রিস, রুমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় নিয়ে নতুন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘Montreux Convention Regarding the Regime of the Straits’ বা সংক্ষেপে ‘Montreux Convention‘।
এই চুক্তি অনুযায়ী, বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের সামরিক কর্তৃত্ব তুরস্কের নিকট প্রত্যর্পণ করা হয়। এর ফলে যুদ্ধ চলাকালে তুরস্ক বিদেশি যুদ্ধজাহাজের জন্য এই প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে, এবং কোনো রাষ্ট্র তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সেই রাষ্ট্রের বেসামরিক জাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু এই চুক্তির শর্তানুযায়ী, শান্তিকালীন সময়ে প্রণালীদ্বয় দিয়ে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোর কাছ থেকে তুরস্ক কোনো প্রকার শুল্ক আদায় করতে পারবে না।
এই শর্তটি আরোপের মধ্য দিয়ে তুরস্কের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে কিনা, সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। এটি সত্যি যে, তুরস্ক যদি এই শুল্ক আদায় করতে পারত, তাহলে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করত। কিন্তু তুরস্ক যে এখন তুর্কি প্রণালীদ্বয় দিয়ে চলাচলকারী নৌযানগুলোর কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে পারছে না, সেটির জন্য লুজান চুক্তি নয়, Montreux Convention দায়ী। সুতরাং ঘটনাচক্রে ২০২৩ সালে যদি লুজান চুক্তি বাতিলও হয়ে যায়, তবুও তুর্কি প্রণালীদ্বয়ের চলাচলরত নৌযানগুলো থেকে তুরস্ক শুল্ক আদায় করতে পারবে না। অর্থাৎ, লুজান চুক্তির কারণে তুরস্ক তুর্কি প্রণালীদ্বয় দিয়ে চলাচলকারী নৌযানগুলো থেকে শুল্ক আদায় করতে পারছে না– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
(৬) লুজান চুক্তির অবসান ঘটলে তুরস্কে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে
লুজান চুক্তির পর ১৯২৪ সালে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক খিলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু লুজান চুক্তির সঙ্গে এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, লুজান চুক্তিতে খিলাফত বিলুপ্ত করার জন্য কোনো শর্ত তুরস্কের ওপর আরোপ করা হয়নি। তদুপরি, লুজান চুক্তির আগেই ১৯২২ সালে আতাতুর্ক ওসমানীয় সালতানাতও বিলুপ্ত করেছিলেন। সালতানাত ও খিলাফত বিলুপ্তি ছিল আতাতুর্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা সরাসরি লুজান চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এবং ২০২৩ সালে যে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে না– সেটি ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এজন্য তুরস্কে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে লুজান চুক্তির অবসান ঘটার কোনো সম্পর্ক নেই। তুর্কি শাসকশ্রেণি ও জনসাধারণ চাইলে যেকোনো সময়েই (অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখে) খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। এজন্য লুজান চুক্তির অবসান ঘটার কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্য তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে আন্দাজ করা যায় যে, তুর্কি শাসকশ্রেণির বা তুর্কি জনসাধারণের সিংহভাগের ‘খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করার মতো কোনো ইচ্ছা নেই।
এজন্য লুজান চুক্তির অবসান ঘটলে তুরস্কে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে– এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
লুজান চুক্তি বাতিল করা সম্ভব কি?
লুজান চুক্তির কোনো সুনির্দিষ্ট মেয়াদ নেই, তাই ২০২৩ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লুজান চুক্তি বাতিল হবে না। কিন্তু যেকোনো চুক্তিই বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে বাতিল হয়ে যেতে পারে।
প্রথমত, কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো যদি সর্বসম্মতিক্রমে ঐ চুক্তিটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। যেমন: ১৯২১ সালের মস্কো চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া ও আঙ্কারাভিত্তিক সরকার অতীতে রুশ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তিকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। এর ফলে ১৯২১ সালের আগে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো যদি ঐ চুক্তির বিষয়াবলি নিয়ে নতুন করে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তাহলে আগের চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। যেমন: ১৯২৩ সালে তুরস্ক ও মিত্রশক্তির মধ্যে স্বাক্ষরিত লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯২০ সালে স্বাক্ষরিত সেভ্রে চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
সর্বোপরি, কোনো রাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো সময়ে কোনো চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য রাষ্ট্রগুলো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। যেমন: ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ কেন্দ্রীয় শক্তি ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেটি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য চরম অবমাননাকর। কিন্তু একই বছর জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হলে ১৯১৮ সালের ১৩ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এক্ষেত্রে তাদের জার্মানি বা কেন্দ্রীয় শক্তির অন্য সদস্যদের অনুমতির প্রয়োজন হয়নি।
সুতরাং তুরস্ক চাইলে তিনভাবে লুজান চুক্তি বাতিল করতে পারে। হয় তারা লুজান চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে চুক্তিটি বাতিল করে দিতে পারে, নতুন সেই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিলে নতুন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে, কিংবা কারো তোয়াক্কা না করেই চুক্তিটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু শেষোক্ত পন্থাটি হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, এবং এর ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অপর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা অনিশ্চিত।
লুজান চুক্তি কি তুরস্ককে কোনো সুবিধাই দেয়নি?
এটি সত্যি যে, লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক তার আরব ভূখণ্ডগুলো মিত্রশক্তির কাছে হস্তান্তর করে এবং ঈজিয়ান সাগরের তিনটি বাদে বাকি সকল দ্বীপ/দ্বীপপুঞ্জ গ্রিসের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে তুর্কি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি। কিন্তু লুজান চুক্তির সমালোচনা সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, চুক্তিটির ইতিবাচক দিকগুলো প্রায় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।
প্রথমত, ওসমানীয় সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরকৃত সেভ্রে চুক্তির মধ্য দিয়ে ওসমানীয় সাম্রাজ্য কার্যত ৪,৫৩,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট মিত্রশক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক একটি অপেক্ষাকৃত বড়, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয়ত, সেভ্রে চুক্তি অনুযায়ী ওসমানীয় রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পুরোপুরি মিত্রশক্তির হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল। লুজান চুক্তি তুরস্কের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ তুর্কি সরকারের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত, ওসমানীয় সুলতানরা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো একটি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছিলেন। এই অনুযায়ী, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মাটিতে অবস্থানরত কোনো ইউরোপীয় নাগরিকের বিচার ওসমানীয় আইনে করা যেত না। লুজান চুক্তি এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা রহিত করে।
চতুর্থত, সেভ্রে চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তি ওসমানীয় রাষ্ট্রের ওপর বিরাট এক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। লুজান চুক্তিতে তুরস্ককে এই ক্ষতিপূরণ তো দিতেই হয়নি, উল্টো তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রিক সৈন্যরা আনাতোলিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তার জন্য তুরস্ক গ্রিসের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। শেষ পর্যন্ত গ্রিস ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে এদিরনে প্রদেশ সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল তুরস্কের নিকট হস্তান্তর করে।
পঞ্চমত, সেভ্রে চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তি আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য ওসমানীয় কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে চেয়েছিল। কিন্তু লুজান চুক্তিতে এই প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ করা হয়নি, এবং এর মধ্য দিয়ে কার্যত মিত্রশক্তি তুরস্ককে আর্মেনীয় গণহত্যার দায় থেকে দায়মুক্তি প্রদান করে।
ষষ্ঠত, সেভ্রে চুক্তিতে তুর্কি সামরিক শক্তির ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে এসব বিধিনিষেধের অবসান ঘটে।
সপ্তমত, সেভ্রে চুক্তি অনুযায়ী আনাতোলিয়ার বিরাট এক অংশ জুড়ে স্বাধীন আর্মেনিয়া ও কুর্দিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। কিন্তু লুজান চুক্তিতে এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়নি। ফলে আনাতোলিয়ার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ নতুন তুর্কি রাষ্ট্রের হস্তগত হয়।
সর্বোপরি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিটি সদস্যের ওপরেই মিত্রশক্তি কঠোর শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সেভ্রে চুক্তি ছিল সবচেয়ে কঠোর। উল্লেখ্য, এককালের পরাক্রমশালী জার্মানিও ১৯৩০–এর দশকে হিটলারের উত্থানের আগে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভার্সাই চুক্তি বাতিল করতে পারেনি। কিন্তু তুর্কিরা সেভ্রে চুক্তি স্বাক্ষরে দুই বছরের মধ্যেই চুক্তিটি বাতিল করে নিজেদের জন্য অধিকতর সুবিধাজনক লুজান চুক্তি আদায় করে নিতে পেরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তিগুলোর মধ্যে এজন্য তুরস্ককেই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেভ্রে চুক্তির পর ওসমানীয় রাষ্ট্র ছিল ৪,৫৩,০০০ বর্গ কি.মি.–এর একটি সম্পূর্ণভাবে মিত্রশক্তি–নিয়ন্ত্রিত আশ্রিত রাষ্ট্র। লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্ক আরো প্রায় ২,৭৭,০০০ বর্গ কি.মি. ভূমি লাভ করে। এর পাশাপাশি ১৯২১ সালের ১৩ অক্টোবর আঙ্কারাভিত্তিক সরকার এবং সোভিয়েত রুশ–নিয়ন্ত্রিত কিন্তু আইনত স্বাধীন সোভিয়েত জর্জিয়া, সোভিয়েত আর্মেনিয়া ও সোভিয়েত আজারবাইজানের মধ্যে ‘কার্স চুক্তি‘ সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্ক প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বাতুম প্রদেশের দক্ষিণাংশ (প্রায় ৩০,০০০ বর্গ কি.মি.), কার্স প্রদেশের সিংহভাগ (প্রায় ১৫,০০০ বর্গ কি.মি.), সুরমালি জেলা (৩,৬৮৮ বর্গ কি.মি.) ও আরাস করিডোর লাভ করে।
এরপর ১৯৩৮ সালে তুরস্ক ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া থেকে হাতাই প্রদেশ (৫,৫২৪ বর্গ কি.মি.) লাভ করে। সামগ্রিকভাবে, ১৯৩৮ সাল নাগাদ তুরস্ক ছিল ৭,৮৩,৩৫৬ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বর্তমানে তুরস্ক একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদি সেভ্রে চুক্তি বহাল থাকত, এবং লুজান চুক্তি কখনো স্বাক্ষরিত না হতো, সেক্ষেত্রে তুরস্কের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।