সম্প্রতি দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের দুই প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্র আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে তুরস্ক দৃঢ়ভাবে আজারবাইজানের পক্ষ অবলম্বন করেছে এবং আজারবাইজানকে ব্যাপক রাজনৈতিক, সামরিক–প্রযুক্তিগত ও নৈতিক সমর্থন প্রদান করেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজান তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, এবং আজারবাইজানের এই সাফল্যের ক্ষেত্রে তুর্কি সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
তুরস্ক ও আজারবাইজানের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র দুটির মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বুঝাতে যে শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে থাকেন, সেটি হলো ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র’। রাষ্ট্র দুটি জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান যখন প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন ওসমানীয় সাম্রাজ্য রাষ্ট্রটিকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছিল। ১৯৯১ সালে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর তুরস্ক সর্বপ্রথম আজারবাইজানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তখন থেকেই রাষ্ট্র দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
১৯৯২–১৯৯৪ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধেও তুরস্ক আজারবাইজানকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। সদ্য স্বাধীন আজারবাইজানকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তুরস্ক অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা আজারবাইজানকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করে, এবং প্রায় ৩৫০ জন উচ্চপদস্থ তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা আজারবাইজানি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচালনায় অংশ নেয়। এছাড়া শত শত তুর্কি স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজানিদের পক্ষে যুদ্ধ করে। কিন্তু তুর্কিদের ব্যাপক সহায়তা সত্ত্বেও দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রায় প্রশিক্ষণবিহীন এবং মনোবলহীন আজারবাইজানি সৈন্যরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং আর্মেনিয়া বিরোধপূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখের পাশাপাশি নাগর্নো–কারাবাখ ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী ৭টি আজারবাইজানি জেলাও দখল করে নেয়।
কিন্তু সেই যুদ্ধের পর দুই দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং এর মধ্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বিপুল পরিমাণ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদবিশিষ্ট আজারবাইজান এখন বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের অধিকারী, এবং তুরস্কের সামরিক সামর্থ্য ও রাজনৈতিক বলিষ্ঠতাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে বর্তমানে তুরস্ক আজারবাইজানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে, এবং এই সমর্থনের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তুরস্কের উৎসাহ বা প্ররোচনাতেই আজারবাইজান এবারের যুদ্ধ আরম্ভ করেছে।
কার্যত ২০২০ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সংঘাতের পর থেকেই তুরস্ক আজারবাইজানকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে। এই সংঘর্ষের পরপরই তুরস্ক ও আজারবাইজান আজারবাইজানের বাকু, গাঞ্জা, কুর্দামির, ইয়েভলাখ ও নাখচিভান অঞ্চলে একটি বড় মাত্রার যৌথ সামরিক মহড়া আরম্ভ করে। ২৯ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই মহড়ায় কমপক্ষে ১১,০০০ তুর্কি সৈন্য অংশগ্রহণ করে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই মহড়ায় ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্রশস্ত্র তুর্কিরা আজারবাইজানে রেখে গিয়েছিল, যেগুলো এখন আজারবাইজান যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করছে।
২৭ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই তুরস্ক আজারবাইজানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে এবং তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান আর্মেনিয়াকে ‘এতদঞ্চলে শান্তির প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আজারবাইজানি সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক হারে তুর্কি–নির্মিত অ্যাটাক ও গোয়েন্দা ড্রোন ব্যবহার করছে, এবং বিশ্লেষকদের ধারণা, তুর্কি ও তুর্কিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত আজারবাইজানি অপারেটররা এই ড্রোনগুলোকে চালনা করছে। আর্মেনীয়দের দাবি অনুযায়ী, প্রায় ১৫০ জন তুর্কি সামরিক বিশেষজ্ঞ আজারবাইজানি সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচালনা করছে, এবং তুর্কি বিমানবাহিনী সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া, মার্কিন–নির্মিত তুর্কি এফ–১৬ জঙ্গিবিমান আর্মেনীয় আকাশসীমায় একটি রুশ–নির্মিত আর্মেনীয় ‘সু–২৫’ বিমানকে ভূপাতিত করেছে বলেও আর্মেনীয় সরকার অভিযোগ করেছে, যদিও তুরস্ক এই অভিযোগটি অস্বীকার করেছে।
তদুপরি, তুরস্ক কয়েক হাজার সিরীয় মার্সেনারিকে আজারবাইজানের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করেছে। তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো আজারবাইজানের সীমানা ও তেলক্ষেত্রগুলো প্রহরা দেয়ার জন্য এই মার্সেনারিদের রিক্রুট করেছিল, কিন্তু তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হয়েছে। তুর্কি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, এবং পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে, তুর্কি ও সিরীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবং সিরীয় ও লেবানিজ আর্মেনীয় মার্সেনারিরা যুদ্ধক্ষেত্রে আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে। আর্মেনিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তুর্কি বিশেষজ্ঞ ইলহান উজগেলের মতে, তুর্কি সৈন্যরা এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিচ্ছে না, কারণ আজারবাইজানিদের সৈন্য সহায়তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সশস্ত্র ড্রোনসহ যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ, প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে আঙ্কারা বাকুকে সহায়তা করছে।
তুরস্কের সহায়তার প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, তুরস্ক যে এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে, সেই বিষয়টি স্পষ্ট। তুরস্কের এই পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, তুরস্ক নিজেকে বৃহত্তর তুর্কি বিশ্বের নেতা হিসেবে বিবেচনা করে, এবং তুর্কি রাষ্ট্রীয় আদর্শে ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদে’র ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এরদোয়ানের তুলনামূলক ইসলামপন্থী সরকার এবং পূর্ববর্তী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলো উভয়েই এই নীতির অনুসরণ করেছে। বিশেষত এরদোয়ান সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘নব্য ওসমানীয়বাদে’র সংমিশ্রণ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ১৯৯১ সালে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেশাসে সোভিয়েত শাসনের অবসান ঘটার পর থেকেই তুরস্ক এতদঞ্চলের তুর্কি রাষ্ট্রগুলোকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আজারবাইজানিরা বৃহত্তর তুর্কি জাতির একটি অংশ, সুতরাং তুরস্ক স্বাভাবিকভাবেই আজারবাইজানকেও নিজস্ব প্রভাব বলয়ে অঙ্গীভূত করে ফেলতে আগ্রহী। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তুরস্ক বরাবরই নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বে আজারবাইজানকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বর্তমান যুদ্ধেও তুরস্ক একই উদ্দেশ্যে আজারবাইজানকে সমর্থন প্রদান করছে।
দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা বাইরেও তুরস্কের নিকট আজারবাইজানের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। তুরস্ক এখন পর্যন্ত জ্বালানি সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং তুর্কিদের বিপুল পরিমাণ জ্বালানি অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়। এর একটি বিরাট অংশ আসে রাশিয়া থেকে, যার সঙ্গে তুর্কিদের সম্পর্কে মূলত বিনিময়-নির্ভর ও প্রায়শই শত্রুভাবাপন্ন। এমতাবস্থায় তুরস্ক রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভরতা হ্রাস করতে ইচ্ছুক। ইতোমধ্যেই তুর্কিরা আজারবাইজান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে, এবং এর ফলে তুরস্কের নিকট রুশ গ্যাস রপ্তানির হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তুর্কি দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার চেয়ে আজারবাইজান অধিক নির্ভরযোগ্য অংশীদার। এর পাশাপাশি তুরস্ক আজারবাইজানের নাখচিভান অঞ্চলে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণেও আগ্রহী।
কিন্তু আজারবাইজানের বিপুল পরিমাণ জ্বালানির মজুদের কারণে আজারবাইজান অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, এবং এজন্য আজারবাইজানি পররাষ্ট্রনীতি তুরস্ক বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনস্থ নয়। তুরস্ক এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে ইচ্ছুক। যদি চলমান যুদ্ধে আজারবাইজান কিছু পরিমাণ ভূমিও পুনর্দখল করতে পারে, সেটি আজারবাইজানের অভ্যন্তরে বিরাট বিজয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং স্বভাবতই তুর্কি সহায়তার কারণে আজারবাইজানে তুর্কিপন্থী মনোভাব বিস্তার লাভ করবে। অন্যদিকে, যদি আজারবাইজান এই সংঘর্ষে পরাজিতও হয়, সেক্ষেত্রেও আজারবাইজান নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করতে তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়বে।অর্থাৎ, যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই যুদ্ধের ফলে আজারবাইজানে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এই যুদ্ধে তুর্কিদের সক্রিয় ভূমিকার একটি অন্যতম কারণ। সিরিয়া ও লিবিয়ায় চলমান যুদ্ধে তুরস্ক ও রাশিয়া ভিন্ন ভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে, এবং লিবিয়ায় রুশ–সমর্থিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে তুর্কি–সমর্থিত জিএনএ সরকারের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও সিরিয়ায় তুর্কি–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি রুশ–সমর্থিত সিরীয় সরকারের নিকট কোণঠাসা হয়ে আছে। দক্ষিণ ককেশাসকে রাশিয়া যেহেতু নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, সেহেতু সেখানে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তুরস্ক রাশিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তুর্কিরা নাগর্নো–কারাবাখে হস্তক্ষেপ করে সিরিয়া ও লিবিয়ায় রাশিয়ার কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে আগ্রহী বলে কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করেন।
এছাড়া, রাশিয়া যেরকমভাবে তুরস্কের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে, তুরস্কও সেভাবে রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজারবাইজানে হস্তক্ষেপ করে মস্কোকে একটি সূক্ষ্ম সতর্কবার্তা প্রেরণ করতে চায় বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন। একদিকে আর্মেনিয়া রাশিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে আজারবাইজানের সঙ্গেও রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এমতাবস্থায় মস্কোর দুই মিত্ররাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে আঙ্কারা মস্কোকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
চতুর্থত, অনেক বিশ্লেষকের মতে, ককেশাস অঞ্চলকে তুর্কি প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করাও তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। আজারবাইজানের পাশাপাশি কট্টর রুশবিরোধী জর্জিয়ার সঙ্গেও তুরস্ক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, এবং উত্তর ককেশাসে অবস্থিত রুশ–নিয়ন্ত্রিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতেও তুরস্ক আগ্রহী। উল্লেখ্য, ১৯৯০ ও ২০০০–এর দশকে চেচনিয়া ও দাগেস্তানের রুশবিরোধী জাতীয়তাবাদী ও মিলিট্যান্টদের তুরস্ক সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছিল এবং এখনো বহু চেচেন ও অন্যান্য উত্তর ককেশীয় মিলিট্যান্ট তুরস্কে বসবাস করছে। আজারবাইজানের যুদ্ধক্ষেত্রে তুর্কিদের সংশ্লিষ্টতা ককেশাস অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে আঙ্কারার প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আজারবাইজানে রুশ প্রভাব এখনও ব্যাপক। আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ প্রাক্তন কেজিবি কর্মকর্তা হায়দার আলিয়েভের ছেলে, এবং রুশ রাষ্ট্রপতি (আরেক প্রাক্তন কেজিবি কর্মকর্তা) ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। আজারবাইজানের সামরিক সরঞ্জামের একটি বড় অংশ আসে রাশিয়া থেকে, এবং প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ আজারবাইজানি রাশিয়ায় বসবাস করে। আজারবাইজানের বুদ্ধিজীবীরাও প্রধানত রুশভাষী। এমতাবস্থায় আজারবাইজানে রুশ প্রভাব হ্রাস করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে রাশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা, এবং এই যুদ্ধের ফলে সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
পঞ্চমত, তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান তুরস্ককে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। তুরস্ককে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের সমমর্যাদায় আসীন করা তাঁর অন্যতম একটি উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়। নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধানের জন্য রাশিয়া, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে যে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ গঠিত হয়েছে, তুরস্ক সেটিকে অকার্যকর প্রমাণিত করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে তুরস্ক দক্ষিণ ককেশাসের সামরিক ভারসাম্য আজারবাইজানের পক্ষে নিয়ে আসতে চায়, যাতে রাশিয়া এই সমস্যার সমাধানের জন্য তুরস্কের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। কিন্তু দক্ষিণ ককেশাসকে রাশিয়া নিজস্ব একচ্ছত্র প্রভাব বলয় হিসেবে বিবেচনা করে, তাই রাশিয়া যদি এই অঞ্চলে তুরস্ককে সমমর্যাদার একটি অংশীদার হিসেবে স্বীকার করে নেয়, সেক্ষেত্রে এটি হবে রুশদের জন্য একটি কূটনৈতিক পরাজয় এবং তুর্কিদের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয়। এর পাশাপাশি মিনস্ক গ্রুপকে অকার্যকর প্রমাণিত করতে পারলে সেটি হবে যুগপৎ রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের ওপর তুর্কি কূটনৈতিক বিজয়।
ষষ্ঠত, তুর্কি–আর্মেনীয় জাতিগত দ্বন্দ্বও আজারবাইজানের প্রতি তুর্কি সমর্থনের একটি অন্যতম কারণ। তুরস্কে আর্মেনীয়বিরোধী মনোভাব এবং আর্মেনিয়ায় তুর্কিবিরোধী মনোভাব অত্যন্ত তীব্র। আর্মেনীয়রা তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর দায়ে তুর্কিদেরকে অভিযুক্ত করে, এবং তুর্কিরা আর্মেনীয়দেরকে ঐতিহাসিকভাবে ‘রুশদের পুতুল’ ও ‘তুর্কিদের শত্রু’ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। আর্মেনীয় গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধকে সরাসরি ‘তুর্কি–আর্মেনীয় যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সর্বোপরি, তুরস্ক বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সিরিয়ায় প্রলম্বিত তুর্কি হস্তক্ষেপ সাফল্য অর্জন করেনি এবং সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তুরস্ক ব্যর্থ হয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস, সাইপ্রাস ও ফ্রান্সের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্বের এখনও কোনো ফলপ্রসূ সমাধান হয়নি। এসব কারণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একেপির জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, এবং ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের বড় বড় শহরগুলোর অনেকগুলোতেই একেপির প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ক্ষমতাসীন।
এমতাবস্থায় আজারবাইজানে একটি সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনা করতে পারলে একেপি ও এরদোয়ানের জনসমর্থন বৃদ্ধি পাবে। যুদ্ধ শুরুর পরের দিনই ইস্তাম্বুলের আর্মেনীয় প্যাট্রিয়ার্কেটের সামনে তুর্কিরা আজারবাইজানের পক্ষে বিক্ষোভ করেছে। কুর্দিপন্থী ‘এইচডিপি’ ছাড়া তুরস্কের সবগুলো প্রধান বিরোধী দল আজারবাইজানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুরস্কের প্রধান বিরোধী দলগুলো লিবিয়ায় তুর্কি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু আজারবাইজানের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান প্রায় সম্পূর্ণভাবে সরকারের পক্ষে। এক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজানের সাফল্য প্রায় নিশ্চিতভাবে একেপি ও এরদোয়ানের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব অনুসারে, যেকোনো রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রটিতে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে। তুরস্কও তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এবং তুর্কি সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজানকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছে।