বিগত কয়েক দশকে মিয়ানমার থেকে ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে, যার মধ্যে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের প্রবাহ অতুলনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার নানা শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে। অভাবনীয় অত্যাচার ও সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা এই শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অত্যন্ত কষ্ট করে নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। দেশি-বিদেশি নানা সহায়তা ঠিকই আসছে, তবে তা এই বিশাল শরণার্থী শিবিরের জন্য যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশে আবার ফেরত যেতে চায়, যেখানে তাদের উপর আর কোনো অত্যাচার করা হবে না এবং যেখানে তাদের নিজস্ব জাতীয় ও সামাজিক পরিচয় থাকবে।
মিয়ানমারের সাথে নানা আলোচনা সাপেক্ষে কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি দিনও ধার্য করা হয়েছিল। গত বছরের নভেম্বরের ১৫ তারিখ বাংলাদেশের সরকার এরকম একটি উদ্যোগ নেয় ঠিকই, কিন্তু রোহিঙ্গাদের আক্রোশ এবং অনাস্থায় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা নিজেদের বাসস্থানেই ফেরত যেতে চায়, কোনো ক্যাম্পে না। তারা এখনো আশংকা করছে যে, রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এবং তারা ফেরত গেলে আবারো তাদের উপর অত্যাচার করা হবে। তাছাড়াও এখন পর্যন্ত যত অন্যায় তারা সহ্য করেছে সেজন্য তারা সবাই পূর্ণ বিচার দাবি করছে। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পর তাদের সাথে আবার সহিংস কর্মকান্ড কিংবা অত্যাচার সংগঠিত হবে না এমন নিশ্চয়তা ছাড়া তারা ফেরত যেতে অস্বীকৃত জানিয়েছে। একই দাবি ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
এরপর কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও স্থানান্তরের উদ্যোগ ২০১৯ এ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের চাহিদা মোতাবেক বিষয়গুলো মাথায় রেখে নতুন করে এই বিষয়ে কাজ হাতে নিতে হবে। কাউকে জোরজবরদস্তি করে পাঠানো হবে না। অন্যদিকে এ দেশের ভাসান চরে যে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে সেটি নিয়েও কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ভাসান চরে স্থানান্তরের ব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষের মতবিরোধ রয়েছে জায়গাটি অত্যন্ত বন্যাপ্রবণ বলে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স মিয়ানমারের রাখাইন এলাকার বেশ কিছু পরিবর্তন নিয়ে তদন্ত করে অকল্পনীয় তথ্য পেয়েছে। তদন্ত অনুসারে তারা ধারণা করছে, নোবেলজয়ী অং সান সুচীর মিয়ানমার সরকার এসব এলাকায় যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বা করছে, তার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানের বদলে চিরস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা তীব্র। রয়টার্স বেশ কিছু স্যাটেলাইট চিত্র পর্যালোচনা করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় জানতে পেরেছে।
পশ্চিম রাখাইন অঞ্চলের ইন দিন নামক একটি গ্রামে স্থানীয় রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবেশীর মতো একসাথে বসবাস করতো। সহিংসতার কারণে সেই গ্রাম থেকে ৬ হাজার রোহিঙ্গা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রত্যেকটি বাড়ি পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে, যা স্যাটেলাইট চিত্রে পরিষ্কারভাবে দেখা গিয়েছিল। আগে যেসব জায়গায় রোহিঙ্গারা বসবাস করতো এখন সেখানে নতুন করে বাসস্থান তৈরি করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা রোহিঙ্গাদের জন্য নয়। সেই নতুন করে বানানো বাড়িগুলোতে রাখাইনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নিরাপত্তা কর্মীরা বসবাস করছে। একই চিত্র অন্যান্য এলাকাতেও দেখা যায়, যেখানে শত শত নতুন ঘর বানানো হচ্ছে রোহিঙ্গা বাদে অন্যদের থাকার জন্য, অথচ একই জায়গায় পূর্বে রোহিঙ্গারা থাকতো এবং কৃষিকাজ বা অন্যান্য কাজ করতো। এই দিকে মিয়ানমার আলোচনা সাপেক্ষে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে যে পরিকল্পনার কথা বলেছে সেই অনুসারে কাউকে তাদের পূর্বের জায়গায় পাঠানো হবে না। বরং একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ক্যাম্পের মতো জায়গায় রোহিঙ্গাদের একত্রিত করে রাখা হবে, যাতে তাদেরকে দেশের অন্যান্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে দূরে রাখা যায়।
মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেন, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের চিরস্থায়ীভাবে বিতাড়িত করার কর্মকান্ডের বিষয়টি রয়টার্সের বের করা তথ্যে দেখা যায়। তিনি বলেন, এর পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অবশিষ্টাংশ পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়ে সেখানে নতুন ভূখন্ড স্থাপন করা। সিঙ্গাপুরে গিয়ে অং সান সুচি বলেছেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরকে ‘স্বেচ্ছায়, নিরাপদ উপায়ে ও সম্মানসূচকভাবে ফেরত’ আনার ব্যাপারে মিয়ানমার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার সরকার ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য সম্ভাব্য জায়গা ঠিক করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা উল্লেখ আছে অর্থাৎ পূর্বের বাসস্থানে তাদের পাঠানো। সেজন্য কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
হুসেইন আহমেদ নামে একজন ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ, যিনি ইন দিন গ্রামের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন, তিনি সেখানকার স্যাটেলাইট চিত্রটি হাতে নিয়ে দেখাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন যে, “এটি আমার গ্রাম ছিল। এখানে আমার জন্ম। আমাদের সব বাড়ি-ঘর পুড়ে গেছে। সামরিক বাহিনী সেগুলো দখল করে ফেলেছে। তাই আমার মনে হয় না তা আমি ফেরত পাবো।” এই কথাগুলো কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বসে বলছিলেন তিনি। সেখানকার সব মুসলমান ঘর আর সেখানে নেই, শুধু বৌদ্ধদের ঘর রয়েছে। তার বাড়ি যেখানে ছিল সেখানে এখন একটি লাল রঙের ছাদ বিশিষ্ট দালান দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইট চিত্রে। তিনি আরো জানিয়েছেন, যদি তিনি তার জমি ফেরত না পান, তাহলে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে নেই। তার মতো এমন হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিন পার করছেন, যারা তাদের সবকিছু হারিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। অনেকে তাদের আপনজন হারিয়েছেন।
উইন মায়াত আয়, যিনি মিয়ানমারের পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে একটি আইন প্রস্তাব করেছেন যে, পুড়ে যাওয়া জমি সরকারের ব্যবস্থাপনায় চলে যাবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি কোনো রোহিঙ্গা তার নিজের এলাকায় ফেরত যেতে চায় তাহলে সে পারবে কি না। তিনি উত্তরে বলেছেন, যদি তাদের বাড়ি-ঘর সেখানে অক্ষত থাকে, তাহলে তারা সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। উপরে উল্লেখিত ইন দিন গ্রামের মতো আরো বহু এলাকা আছে যেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই তাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকবে না। মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি আরো বলেছেন, মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে যে পরিকল্পনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে তা কৌশলগত উপায়ে রাখাইনে সামাজিকভাবে পুনরায় বিন্যাস ঘটাবে এবং সেই অঞ্চলে ‘জাতিবিদ্বেষমূলক পরিস্থিতি’ তৈরি করবে। বলতে গেলে একধরনের কারাগারের মতো অবস্থা তৈরি হবে।
এদিকে বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এলাকাগুলোতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন যাবত দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর কারণে পরিবেশগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের যে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা অকল্পনীয়। স্থানীয় মানুষ দিন দিন অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদেরকে অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত মনে করছে। তার উপরে গত কয়েকদিনে কিছু মারাত্মক ঘটনা সকলের নজরে এসেছে। শনিবার রাত ৩টার দিকে, কুতুপালং ক্যাম্পের ৬নং ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং ক্যাম্প ইনচার্জ ও পুলিশের উপর তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। সেজন্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরো কিছুদিন আগে রোহিঙ্গারা ভুল অভিযোগ তুলে ৩ জন জার্মান সাংবাদিকের উপর হামলা করে। এতে মোট ৪ জন আহত হয়। সাংবাদিকদের মালামালও লুট করা হয়। এছাড়াও কম-বেশি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে ক্যাম্পগুলোতে।
সবদিক পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কিংবা পুনর্বাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এবং এটি নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বেশ উদ্বিগ্ন। ব্যাপারটি নিয়ে আরো গভীরভাবে আলোচনা করা উচিত। সেজন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এরকম সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করার। মানবিক দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না। পরিস্থিতি কোন দিকে এগোবে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।