জেলিমখান খানগোশভিলির পরিচিতি ছিল নানাবিধ, কিন্তু ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ইউরোপের কেন্দ্রস্থল জার্মানির রাজধানী বার্লিনে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে খুব কম মানুষই চিনত। খানগোশভিলি ছিলেন একজন চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী, জর্জীয় সেনা কর্মকর্তা, জর্জীয় গুপ্তচর, অথবা রুশদের দৃষ্টিতে, ‘সন্ত্রাসবাদী’। ১৯৭৯ সালে জর্জিয়ায় জন্মগ্রহণকারী খানগোশভিলি ছিলেন একজন জাতিগত চেচেন। ১৯৯৯–২০০০ সালের দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের সময় তিনি রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রে’র পক্ষে রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই যুদ্ধে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজয়ের পর খানগোশভিলি জর্জিয়ায় চলে যান এবং জর্জীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত হন৷ জর্জীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হয়।
চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদ গতি হারিয়ে ফেলেছে এক দশক আগেই, কিন্তু মস্কো ও গ্রোজনি খানগোশভিলি বা তার সহযোদ্ধাদের ক্ষমা করেনি। ২০০৬ সালে প্রণীত একটি রুশ আইন অনুযায়ী রুশ গুপ্তচররা রাশিয়ার বাইরে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’দের খুন করার অধিকার রাখে। খানগোশভিলিও রাশিয়ার দৃষ্টিতে একজন ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু’, ফলে ২০১৬ সালে জর্জিয়ায় তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়। খানগোশভিলি প্রাণের ভয়ে সপরিবারে জার্মানিতে পালিয়ে যান, কিন্তু সেখানেও মৃত্যু তার পিছু ছাড়েনি। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট বার্লিনের একটি পার্কে খানগোশভিলিকে খুন করা হয়। জার্মান কর্তৃপক্ষ এই খুনের জন্য সরাসরি রুশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘জিইউ’কে (Гла́вное управле́ние Генера́льного шта́ба Вооружённых Сил Росси́йской Федера́ции, ‘গ্লাভনোয়ে উপ্রাভ্লেনিয়ে ফেদেরালনোগা শতাবা ভোরুঝিওন্নিখ সিল রোসিস্কোয় ফেদেরাৎসি’) দায়ী করে।
বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, জিইউ–এর যে ইউনিটটি এই খুনের সঙ্গে জড়িত, সেটি হলো ‘ইউনিট ২৯১৫৫’ (Отряд 29155)। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর পূর্বাঞ্চলে ইজমাইলোভো জেলায় অবস্থিত ১৬১তম স্পেশাল পার্পাজ স্পেশালিস্ট ট্রেইনিং সেন্টারে এই ইউনিটটির সদর দপ্তর অবস্থিত। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে রাশিয়ার বাইরে ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু’দের খুন করা এবং বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে দুর্বল করে ফেলা!
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। রুশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। বিগত শতাব্দীতে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কয়েক বছরের জন্য এই দ্বন্দ্ব প্রশমিত হলেও শীঘ্রই সেটি নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি একটি দিক থেকে ভিন্ন – সেটি হলো রাশিয়ার সামরিক দুর্বলতা। স্নায়ুযুদ্ধে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সামরিক দিক থেকে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই ভারসাম্য পুরোপুরিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে চলে গেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতার কারণে মস্কো পশ্চিমা বিশ্বকে মোকাবেলা করতে নতুন ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে।
মস্কোর কর্মকর্তারা জানেন যে, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বড় ধরনের ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’য় জড়িয়ে পড়া রাশিয়ার জন্য ক্ষতিকর। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্বলতা। মস্কো এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না, এবং এজন্য পশ্চিমা বিশ্বকে মোকাবেলা করতে মস্কো একটি নতুন রণকৌশল বেছে নিয়েছে, যেটিকে বিশ্লেষকরা বলছেন ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’। এই রণকৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রোপাগান্ডা, সাইবার যুদ্ধ, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ বিরোধকে প্রকট করে তোলা, যাতে পশ্চিমা বিশ্ব নিজস্ব সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হয় এবং রাশিয়া ‘শ্বাস নেয়ার অবকাশ’ লাভ করে। অবশ্য এই কৌশল যে অভিনব কিছু এমন নয়, কারণ পশ্চিমা বিশ্বও রাশিয়া বা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে একই কৌশল ব্যবহার করে থাকে।
‘ইউনিট ২৯১৫৫’ হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে রুশ ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’রই একটি হাতিয়ার। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, ২০০৮ সালে রুশ–জর্জীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই বাহিনীটি গঠন করা হয়, কিন্তু ২০১৮ সালের আগে পশ্চিমা বিশ্বে এটির সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কার্যত গণমাধ্যমে প্রকাশিত অল্প কিছু তথ্য ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বও এই বাহিনীটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করেনি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর কমান্ডার হলেন মেজর জেনারেল আন্দ্রেই আভেরিয়ানভ। সোভিয়েত উজবেকিস্তানের তাসখন্দ সামরিক অ্যাকাডেমি থেকে উত্তীর্ণ আভেরিয়ানভ ১৯৯০–এর দশকে সংঘটিত প্রথম চেচেন যুদ্ধ এবং ২০০০–এর দশকে সংঘটিত দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০০৮ সালের দিকে ‘ইউনিট ২৯১৫৫’ গঠনের পর তাকে এটির কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ইউনিট ২৯১৫৫–এর কমান্ডার হিসেবে আভেরিয়ানভ কোন ধরনের কার্যক্রমে জড়িত, সেটি জানা যায়নি। কিন্তু ২০১৫ সালে রুশ সরকার তাকে রাশিয়া সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘হিরো অফ দ্য রাশান ফেডারেশন’ প্রদান করেছে, যার থেকে আন্দাজ করা যায় যে, সংগঠনটি বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্যরা সাধারণত যুদ্ধে অভিজ্ঞ সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তা। এদের কেউ কেউ ১৯৮০–এর দশকের আফগান যুদ্ধ এবং ১৯৯০ ও ২০০০–এর দশকের চেচেন যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, আবার অনেকে ২০১০–এর দশকে ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্যরা গুপ্তহত্যা, অন্তর্ঘাত ও অন্যান্য বিশৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে পারদর্শী। এই ইউনিটের প্রতিটি সদস্যই একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করে, এবং এদের গোপনীয়তার মাত্রা এত বেশি যে, জিইউ–এর অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও এদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, এই ইউনিটের সদস্যরা গুপ্তহত্যা, বোমা হামলাসহ নানারকম অন্তর্ঘাতমূলক কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করে। মস্কোয় এই ইউনিটের একটি পরিত্যক্ত প্রশিক্ষণকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, এদেরকে মার্কিন, জার্মান, অস্ট্রীয় ও বেলজীয় অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২০১২ সালে রুশ সরকার ইউনিটটির সদস্যদের ‘সামরিক কার্যক্রমে বিশেষ অর্জনে’র জন্য বোনাস প্রদান করে।
ইউনিট ২৯১৫৫ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি ইউরোপকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য একটি সমন্বিত ও চলমান পরিকল্পনায় লিপ্ত বলে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা। পশ্চিমা কর্মকর্তারা এই সংস্থাটির কার্যক্রম নিয়ে শঙ্কিত, কারণ এটি সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, এবং এরা কখন বা কোথায় আক্রমণ চালাবে, সেটি আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
২০১৫ সালে এমিলিয়ান গেব্রেভ নামক একজন বুলগেরীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীকে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে খুনের চেষ্টা করা হয়, এবং পরবর্তীতে এজন্য ইউনিট ২৯১৫৫ সদস্যদের দায়ী করা হয়৷ ২০১৬ সালে মন্টিনিগ্রোর বিরোধী দলকে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, এবং এই প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে মন্টিনিগ্রোর সরকার ইউনিট ২৯১৫৫–কে দায়ী করে। ২০১৭ সালে স্পেনের একটি আদালত কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সহায়তা করার জন্য ইউনিট ২৯১৫৫ সদস্যদের দায়ী করে।
২০১৮ সালে ব্রিটেনে প্রাক্তন রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও বিশ্বাসঘাতক সের্গেই স্ক্রিপালকে খুন করার প্রচেষ্টা চালানো হয়, এবং এটির জন্যও ইউনিট ২৯১৫৫–কে দায়ী করা হয়। বস্তুত স্ক্রিপালের খুনের প্রচেষ্টার সময়ই পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রথমবারের মতো ইউনিট ২৯১৫৫ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ২০১৯ সালে জার্মানিতে প্রাক্তন চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী কমান্ডার জেলিমখান খানগোশভিলিকে খুন করা হয় এবং এটির জন্যও ইউনিট ২৯১৫৫–কে দায়ী করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করে যে, আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের খুন করার জন্য ইউনিট ২৯১৫৫ এর সদস্যরা তালিবানকে অর্থ প্রদান করেছে।
এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ্য, সেটি হলো রাশিয়া এই অভিযোগের প্রত্যেকটিই অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নিরন্তরভাবে এগুলোর জন্য মস্কোকে (স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ইউনিট ২৯১৫৫কে) দায়ী করেছে। বলাই বাহুল্য, উভয় পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী সত্যকে কিছুটা বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে, কিন্তু এখানে সত্যি–মিথ্যা বোঝার সহজ কোনো উপায় নেই।
উপরে উল্লিখিত উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায়, গেব্রেভ ও স্ক্রিপালকে খুন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, মন্টিনিগ্রোর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবং স্পেনে কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সফল হয়নি। এর ভিত্তিতে কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষক ধারণা করেন যে, ইউনিট ২৯১৫৫ আসলে অদক্ষ এবং অসফল। এখানে পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে। একদিকে তারা দাবি করছে যে, ইউনিট ২৯১৫৫ অত্যন্ত ভয়ানক একটি রুশ সংগঠন, যেটি পশ্চিমা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করতে সক্ষম। অন্যদিকে, তারা দাবি করছে যে, ইউনিট ২৯১৫৫ অদক্ষ এবং ব্যর্থ। প্রশ্ন হলো, যদি ইউনিটটি ব্যর্থই হয়, তাহলে এটি ভয়ানক কীভাবে?
প্রথমত, গেব্রেভের খুনের প্রচেষ্টায় আসলেই ইউনিট ২৯১৫৫ জড়িত কিনা সে বিষয়ে বাস্তব কোনো প্রমাণ নেই। একজন সাধারণ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে মস্কো কেন খুন করতে যাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। স্ক্রিপালের খুনের প্রচেষ্টার আগে এই ঘটনার সঙ্গে ইউনিট ২৯১৫৫–এর নাম যুক্ত করা হয়নি। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, রুশরা হয়ত এই প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত নয়, তবে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয়ত, মন্টিনিগ্রোর অভ্যুথান প্রচেষ্টায় ইউনিট ২৯১৫৫–এর জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, মন্টিনিগ্রোর পশ্চিমাপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে মন্টিনিগ্রো ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত থাকত এবং রাশিয়া শুরু থেকেই ন্যাটোর বিস্তারের বিরোধী। কিন্তু অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়েছে এবং মন্টিনিগ্রো এখন ন্যাটোর সদস্য।
তৃতীয়ত, কাতালোনিয়া স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি ঠিকই, কিন্তু অঞ্চলটি স্বাধীন হলেও যে সেটি মস্কোর প্রতি সহানুভূতিশীল হতো সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদ নতুন কোনো ঘটনা নয় এবং অঞ্চলটিতে রুশ প্রভাব নেই বললেই চলে। কিন্তু কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দেয়ার মাধ্যমে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্পেনকে অস্থিতিশীল করে তোলা সম্ভব, এবং মস্কোর মূল লক্ষ্য এটাই। কাতালোনিয়া স্বাধীন হোক বা না হোক, ইউরোপকে অস্থিতিশীল করতে পারলে সেটি মস্কোর জন্য লাভজনক।
চতুর্থত, স্ক্রিপালকে খুনের প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ মস্কো দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছে। মস্কোর বক্তব্য হচ্ছে, স্ক্রিপালকে ২০০৪ সালে রাশিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ২০১০ সালে ব্রিটেনে আটক কয়েকজন রুশ গুপ্তচরের মুক্তির বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। এর আট বছর পর স্ক্রিপালকে খুন করার চেষ্টা করে মস্কোর কোনো লাভ নেই। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, স্ক্রিপালকে খুনের চেষ্টার মাধ্যমে মস্কো ভবিষ্যৎ বিশ্বাসঘাতকদের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কবার্তা দিতে চেয়েছে।
পঞ্চমত, খানগোশভিলির খুনের সঙ্গে যে ইউনিট ২৯১৫৫ জড়িত, এটি প্রায় নিশ্চিত। বিদেশে অবস্থানরত চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খুন করার ঘটনা এটি মস্কোর ক্ষেত্রে প্রথম নয়। জার্মান কর্তৃপক্ষ এই খুনের দায়ে একজন রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তারও করেছে। এই ব্যক্তি ২০১২ সালে মস্কোয় একজন রুশ ব্যবসায়ীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল এবং রুশ সরকার তার নাম ইন্টারপোলের কাছে সরবরাহ করেছিল। ধরে নেয়া যেতে পারে, ইউনিট ২৯১৫৫ খানগোশভিলিকে খুন করার জন্য এই অপরাধীকে ব্যবহার করেছে।
সর্বোপরি, মার্কিন সৈন্যদের খুন করার জন্য ইউনিট ২৯১৫৫ তালিবানকে অর্থ প্রদান করেছে– এই অভিযোগটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিজেরাই স্বীকার করেছে যে, এই ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তালিবান মিলিট্যান্টরা বহু আগে থেকেই মার্কিন সৈন্যদের খুন করে আসছে, এবং এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আলাদাভাবে অর্থ প্রদানের প্রয়োজন নেই। মস্কো ও তালিবান উভয়েই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু অন্যদিকে এটাও ঠিক, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কো তালিবানকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে।
সব মিলিয়ে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের পাল্লাই ভারী বলে ধরে নেয়া যায়। ইউনিটটির সামর্থ্যকে ছোট করে দেখার ব্যাপারে অবশ্য কিছু কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ সতর্কতা ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, বর্ণিত অপারেশনগুলো ইউনিট ২৯১৫৫–এর কার্যকলাপের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র, এবং এটি সম্ভব যে, এগুলোর বাইরেও ইউনিট ২৯১৫৫–এর আরো অনেক সফল অপারেশনের তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি।
সামগ্রিক বিবেচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ইউনিট ২৯১৫৫ এর মূল উদ্দেশ্য ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু’দের নিশ্চিহ্ন করার পাশাপাশি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিভিন্ন সঙ্কটকে আরো গভীর করে তোলা। এর ফলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং রুশ পররাষ্ট্রনীতিতে বাধা দানের সামর্থ্য বা সুযোগ কম পাবে। পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় রাশিয়ার সামরিক দুর্বলতা সহসা দূরীভূত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, এবং সেজন্য রুশ পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘ইউনিট ২৯১৫৫’–এর মতো বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর ব্যবহার অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা যায়।