ফ্যাসিস্ট শাসকের অত্যাচার সইতে না পেরে রাজনীতি-সচেতন জনতার রাজপথে নামার ঘটনা ইতিহাসে ঘটেছে বহুবার। বর্ণবাদ কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। জনকল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের খায়েশমতো রাষ্ট্র পরিচালনার বলি হতে হয় সাধারণ জনতাকে। ইতিহাস তা-ই বলে। ফ্যাসিস্ট শাসকের অত্যাচার ও অতি-নজরদারির বিরুদ্ধে যখনই অতিষ্ঠ জনগণ রাজপথে নেমেছে, তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট শাসনের পরিণাম যে কত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে বিশ্ববাসীর। হিটলার কিংবা মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট শাসনের বলি হয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। এই কারণেই ফ্যাসিস্টদের আর রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায় না কেউ। ভয়াল অভিজ্ঞতার দগদগে ক্ষত কি আর এত সহজে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়?
একটু আমেরিকার দিকে তাকানো যাক। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে উত্তাল পুরো আমেরিকা। বৈশ্বিক গণতন্ত্রের অভিভাবক আমেরিকায় বর্ণবাদের মতো ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে জোরেশোরে। সবসময়ই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বলা হয়, কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে সেটার মাত্রা বেড়ে গিয়েছে বহু গুণ বেশি। শুধু যে আন্দোলন করা হচ্ছে তা-ই নয়, শত শত বছর আগের বিখ্যাত মানুষদের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অনেক মূর্তির মুখে কালি মেরে দেয়া হচ্ছে। কারণ, এই মূর্তিগুলো যেসব ব্যক্তিকে উপজীব্য করে বানানো হয়েছে, তারা একসময় বর্ণবাদের সাথে যুক্ত ছিলেন।
ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে এখন। যেসব সাদা চামড়ার ব্যক্তি বর্ণবাদের সাথে যুক্ত থেকে সমাজের উচ্চ মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছিলেন কয়েক শতক আগে, তাদেরই উত্তরসূরী এই প্রজন্মের তরুণেরা আজ সেসব মূর্তি ভেঙে দিচ্ছে। ইতিহাসের দায়মোচনের এরকম সুযোগ তো আর সবসময় পাওয়া যায় না!
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে আমেরিকায় বর্ণবাদ ও পুলিশের নির্মমতার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সহিংসতায় রূপ নিতে খুব বেশি সময় নেয়নি। সহিংসতার অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কয়েক শতকের জমে থাকা ক্ষোভ উদগীরণ করতে জনগণের সহিংস হয়ে ওঠার ঘটনা মোটেই অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত নয়।
চলমান সহিংসতায় ভূমিকা রাখার অজুহাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগে একটি টুইটে ‘এন্টিফা’ (Antifa) নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত’ করার হুমকি দিয়েছিলেন। ট্রাম্প যদিও তার টুইটার বার্তায় এন্টিফাকে একটি সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করেছেন, আদতে এই নামের কোনো সংগঠন নেই আমেরিকায়। তার দাবি ছিল- আন্দোলনে যারা সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন, তারা এন্টিফার সদস্য। কিন্তু ট্রাম্প তার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে যারা সহিংসতার সাথে জড়িত তারা এন্টিফার সদস্য নয়, তারা মোটা দাগে সুবিধাবাদী বা ‘অপরচুনিস্ট'(Opportunist)। আন্দোলনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব কাজ করছেন সেই সহিংসতাকারীরা।
কিন্তু কেন এন্টিফার বিরুদ্ধেই ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের এত ক্ষোভ? যখন অন্যান্য উগ্র ডানপন্থী সংগঠনগুলোর প্রতি যখন নীরব ভূমিকা পালন করেন, তখন এন্টিফার বিরুদ্ধে কেন মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর এমন বিতৃষ্ণা? এনপিআর রিভিউয়ের মতে, ফেডারেল কোর্টে সহিংসতার অভিযোগে ৫১ জন মার্কিনীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, যাদের একজনের সাথেও এন্টিফার কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। তারপরও কেন এন্টিফাকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
এন্টিফা শব্দটি এন্টিফ্যাসিস্ট (Anti-fascist) শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটাকে একধরনের ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যায়। ফ্যাসিবাদীরা উগ্র-ডানপন্থী ও বর্ণবাদী হয়, ইতিহাস থেকে তা-ই জানা যায়। স্বাভাবিকভাবে মতাদর্শগত কারণে এই রাজনৈতিক আন্দোলনে তাই ফ্যাসিবাদবিরোধী বামপন্থীদের আধিক্য দেখা যায়।
এন্টিফার জন্ম জার্মানিতে, নাৎসিদের উত্থানের সময়ই। জার্মান ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সময়ই কমিউনিস্টদের পক্ষে রাজপথের দখল নিতে নাৎসিদের সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তেন এন্টিফার কর্মীরা। নাৎসি বনাম এন্টিফার রাজপথের লড়াই ১৯৩০ এর দশকের প্রথমদিকে জার্মানিতে খুবই সাধারণ দৃশ্য ছিল।
উদারতান্ত্রিক ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা ও নাৎসি প্রোপাগান্ডার ফলে নাৎসিরা জার্মানির ক্ষমতায় চলে আসে। জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগার ঘটনার সমস্ত দায়ভার চাপানো হয় কমিউনিস্টদের উপর। এরপর আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় কমিউনিস্ট তথা এন্টিফা সদস্যদের, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্টদের দমন শুরু হয়। এভাবে নাৎসিদের দমন-পীড়নে এন্টিফা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় জার্মানি থেকে।
এন্টিফার সদস্যরা বিশ্বাস করে, যদি নাৎসিদের উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়েই তাদেরকে জনগণ শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতো, তাহলে হয়তো জার্মান জনগণকে পরবর্তীতে আর দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। হয়তো বিশ্ববাসীকেও আরেকটি ভয়াল বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হতো না।
আমেরিকায় এন্টিফা আসে ভিন্ন নামে, কিন্তু মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই। এন্টি-রেসিস্ট অ্যাকশন বা এআরএ নামের যে সংগঠন গঠিত হয় গেল শতাব্দী নব্বইয়ের দশকে, তা মূলত এন্টিফার আমেরিকান সংস্করণ। মূলত বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের মতো বিষয়গুলো সামনে রেখে আমেরিকার এন্টিফা সদস্যরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে এন্টিফা সদস্যরা তাদের সংগ্রাম জারি রেখেছিল, এখনও রাখছে।
এন্টিফা আন্দোলনের কর্মীরা রাজপথের সংগ্রামে সবসময় তাদের পুরো শরীর কালো রঙের পোশাকে আবৃত করেন। এটি কোনো কুসংস্কার নয়, বরং এর সাথে তাদের পরিচয় গোপন রাখা এবং একত্রিত থাকার বিষয়টি জড়িত। কালো কাপড় পরিধানের পেছনে অবশ্য একটি ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া অধিকৃত পূর্ব জার্মানির নৈরাজ্যবাদীরা নিজেদের কালো কাপড়ে আবৃত করতেন।
জেনে রাখা ভালো, এন্টিফা কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত দল নয়। তাদের কোনো কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় নেতা নেই। একে বলা যায় অনেক ব্যক্তি, গ্রুপ এবং সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক। এই রাজনৈতিক আন্দোলনে কেউ নিজেকে নেতা দাবি করেন না, সবাই এন্টিফার ব্যানারে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করে থাকেন।
আমেরিকায় উগ্র-ডানপন্থীদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, মিছিল কিংবা রাজনৈতিক কার্যক্রমে এন্টিফার কর্মীরা সশরীরে বাধা প্রদান করেন। যদি অপরপক্ষ থেকে সহিংসতার কোনো আভাস না পাওয়া যায়, তাহলে পারতপক্ষে এন্টিফা কর্মীরা সহিংসতার আশ্রয় নেন না। কিন্তু আন্দোলনের সময় অপরপক্ষের উগ্র-ডানপন্থীরা যদি স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার সীমা অতিক্রম করে, সেক্ষেত্রে এন্টিফার কর্মীরাও সহিংস হয়ে ওঠেন। এই বিশেষ ক্ষেত্রটিই আমেরিকার অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনগুলো থেকে এন্টিফাকে অন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগঠন থেকে পৃথক করেছে।
২০১৭ সালে আমেরিকার ভার্জিনিয়ার শার্লোটসভিলে উগ্র-ডানপন্থীদের একটি অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার জন্য এন্টিফার কর্মীরা সমবেত হন। সেসময় ব্যাপক সহিংসতা হয় উগ্র-ডানপন্থী ও এন্টিফা কর্মীদের মাঝে। উগ্র-ডানপন্থীদের ছেড়ে কথা বলেননি তারা। ডানপন্থী-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এন্টিফার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায়। সেসময় বেশ আলোচনা শুরু হয় এন্টিফা নিয়ে।
এন্টিফা যেকোনো মূল্যে উগ্র-ডানপন্থী ও বর্ণবাদীদের প্রতিরোধ করতে চায়। এজন্য যদি সহিংসতার আশ্রয়ও নিতে হয়, তবুও তারা রাজি। তারা ফ্যাসিবাদের উত্থান দেখতে চায় না, জনগণকে ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে চায়। এজন্য উগ্র-ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিনিয়ত প্রতিরোধ আন্দোলনে নিজেদের নিয়োজিত করে চলেছে।
বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনকে আমেরিকার এন্টিফা কর্মীরা উগ্র-ডানপন্থী ও বর্ণবাদী হিসেবেই বিবেচনা করে। ট্রাম্পের উগ্র-ডানপন্থী সমর্থকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এন্টিফা কর্মীরা হানা দেন, অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত করেন। শুধু বাস্তবেই নয়, ভার্চুয়াল জগতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তারা ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের নানাভাবে প্রতিরোধ করে থাকেন।
সাধে কি আর ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা তাদের গলদের গোড়া ধরে টান দেয়া এন্টিফাকে জনবিচ্ছিন্ন করতে তৎপরতা চালিয়ে যান!