ভারতের তাজমহল নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে অতি পরিচিত একটি জায়গা। জানাশোনা আছে এটি তৈরির ঐতিহাসিক প্রেম উপাখ্যানের বিষয়েও। সেই তাজমহল থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে অবস্থান করছে আরেক ট্র্যাজিক সিম্বল ‘শিরোজ হ্যাংআউট’। তবে এটি প্রচলিত কোনো দর্শনীয় স্থান নয়। এটি একটি ক্যাফেটেরিয়া। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, একদল এসিডদগ্ধ তরুণী- যারা জীবন যুদ্ধে বেঁচে গেছেন, তারা এই ক্যাফেটেরিয়াটি গড়ে তুলেছেন।
যারা এই ক্যাফেটেরিয়াটি গড়ে তুলেছেন, তাদের সকলের চেহারাই এসিডে ঝলসে কম-বেশি বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও দমে যাননি তারা। বিচিত্র সেসব চেহারার মধ্য দিয়েই ছিটকে পড়ছে নির্ভার হাসির ঝলকানি। যেন বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতনের সকল প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ তাদের চোখে মুখে। ভয়াবহ এসিড হামলার শিকার হয়েও শুধু বেঁচে থাকাই নয়, বরং মাথা উঁচু করে করে জীবনযুদ্ধে টিকে যাওয়ার হার না মানা গল্পই থাকছে আজকের লেখায়।
তারা মোট পাঁচজন নারী। এই পাঁচ নারীর মধ্যে রয়েছেন যথাক্রমে ঋতু সাইনি, চঞ্চল কুমারী, নিতু মাহর, গীতা মাহর ও রূপা। তাদের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই ভীষণ সাড়া ফেলেছে। এতে আনন্দিত উক্ত পাঁচ তরুণীও। অন্যতম উদ্যোক্তা রূপা বলেন,
প্রথমবারের মতো যখন একদল ভারতীয় পর্যটক আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় আসেন এবং আমাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন, তখন আমাদের সবার মন আনন্দে ভরে গিয়েছিল। সেই থেকে আমরা নিয়মিত গ্রাহক পেয়ে থাকি। গ্রাহকরা এখানে শুধুমাত্র এক কাপ কফি খেতে আসেন না, বরং তারা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন; আমাদের সাথে কথা বলতে আসেন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা শহরে এই ক্যাফেটেরিয়াটি যাত্রা শুরু করে। তবে শুরু করাটা উদ্যোক্তাদের পক্ষে খুব সহজ কাজ ছিল না, কেননা যেকোনো উদ্যোগের জন্য দরকার পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের পাশে দাঁড়ায় ‘স্টপ এসিড অ্যাটাকস’ নামের একটি সংস্থা। সংস্থাটি ‘পে অ্যাজ ইউ উইশ’ বা ‘যে যা পারেন সাহায্য করুন’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করে এবং ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে।
শিরোজ হ্যাংআউটের অন্যতম উদ্যোক্তা চঞ্চল কুমারীর বর্তমান বয়স ২০ বছর। ২০১২ সালে একজন পুরুষের বিয়ের প্রলোভন অস্বীকার করলে তার উপর এসিড হামলা চালায় ঐ ব্যক্তি। এতে তার চেহারা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তিনি বলেন,
আমাদের অধিকাংশ গ্রাহক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের কল্যাণে ছুটে আসেন। তারা দেখতে আসেন কীভাবে এসিডদগ্ধরা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকেন, যেমন আমরা পাহাড়সম দুর্গম পথ অতিক্রম করেও বেঁচে আছি।
চঞ্চল কুমারীর চেহারায় ইতিমধ্যেই পাঁচবার সার্জারি করা হয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রেও একাধিকবার সার্জারির ঘটনা রয়েছে। জীবনের একটি বড় সময় তাদের নির্জনে কাটাতে হয়েছে। চেহারা ও দেহের দগ্ধ অংশের যাতনা তাদের দীর্ঘকাল ভুগিয়েছে। এত কিছুর পরেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছেন, জীবিকা অনুসন্ধানে নেমেছেন। এখন তারা এসিড আক্রমণ প্রতিহত করার দাবিতে আন্দোলনও করছেন।
তারা এই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন নয়া দিল্লি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্টপ এসিড অ্যাটাকস (এসএএ)’ নামক একটি সংস্থাকে। ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস চলাকালে এই সংস্থাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #stopacidattacks নামের একটি ক্যাম্পেইন চালায়। উক্ত ক্যাম্পেইনে তারা এসিড দগ্ধদের আইনি সহায়তা প্রদান, চিকিৎসা সেবা প্রদান, ট্রমা দূরীকরণ এবং কর্মসংস্থানের জন্য সবার কাছে উন্মুক্ত সাহায্য কামনা করে। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই অর্থ বিনিয়োগ করে বেঁচে থাকা এসিডদগ্ধ নারীদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। শিরোজ হ্যাংআউট সেসব পদক্ষেপেরই একটি অংশ।
তিক্ত হলেও সত্য, ভারতে প্রতিনিয়ত এসিড হামলার ঘটনা বাড়ছে। দেশটির সরকারি সংস্থা ‘দ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশটিতে এক হাজারেরও বেশী নারী এসিড আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তবে এসব সরকারি পরিসংখ্যানে কোনোভাবেই বাস্তব চিত্র উঠে আসে না, কেননা সামাজিক ও পারিবারিক বাস্তবতা এবং পুনরায় হামলার আশংকায় অনেক নারীই নিজেদেরকে এসব তালিকা থেকে দূরে রাখেন।
বর্তমানে এসএএ’র প্রায় ৪৩০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৫০ জনই গত দুই বছরের মধ্যে এসিড হামলার শিকার হয়েছেন। এই সদস্যরা আবার তাদের নিজ নিজ এলাকার অন্যান্য এসিড আক্রান্তদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এভাবে সমগ্র ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ এসিডদগ্ধ নারীর সাথে তারা সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন।
সংগঠনটির সংগৃহীত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা ভারতে এসিড হামলার শিকার ৭০ শতাংশই নারী। এর মধ্যে ৫০ শতাংশেরও অধিক নারী তাদের কথিত প্রেমিক দ্বারা এসিড আক্রান্ত হয়েছেন। আর এর কারণ হিসেবে যে বিষয়টি সবার আগে উঠে এসেছে, তা হলো এসিডের উন্মুক্ত ক্রয়-বিক্রয়। ভারতে এক লিটার এসিড ক্রয় করতে মাত্র ৩০ রুপি খরচ হয়!
পাঁচ সদস্যের মধ্যে গীতা মাহর ও নিতু মাহরের বেঁচে থাকার লড়াই সম্ভবত সবচেয়ে করুণ। নিতু মাহর মূলত গীতা মাহরের কন্যা। গীতা মাহরের বর্তমান বয়স ৪২ বছর এবং নিতু মাহরের বর্তমান বয়স ২৬ বছর। আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে তারা উভয়ে গীতা মাহরের স্বামী বা নিতু মাহরের বাবার দ্বারা এসিড আক্রমণের শিকার হন। এরপর তাদের আরও বহু ধাপে নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। নিতুর এক বছরের বড় আরেকটি বোন ছিল। তাকে ঘুমের মধ্যে এসিড নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হয়েছে।
এত কিছুর পরেও নিতু মাহর ও তার মা ঐ পাষণ্ডের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এ সময় তাদের উপর আরও নানা ঘরোয়া সহিংসতা চালানো হয়েছে। বর্তমানে তারা ক্যাফেটেরিয়াটির উদ্যোগের সাথে যুক্ত থাকায় এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। এখন খুব জরুরী না হলে তারা আর বাড়িতে যান না। ফলে সেই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে তারা আপাতত মুক্তি পেয়েছেন। বর্তমানে তারা এসএএ’র অন্যান্য কার্যক্রমের সাথেও যুক্ত আছেন।
ঋতু সাইনির বর্তমান বয়স ১৯ বছর। তিনি একসময় ভালো ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে তার চাচাতো ভাই দ্বারা এসিড আক্রান্ত হন। এতে তার বাম চোখটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে তার খেলাধুলার স্বপ্ন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি শিরোজ হ্যাংআউটের হিসাবরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রুপার বর্তমান বয়স ২২ বছর। তার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখন তিনি তার সৎ মা দ্বারা এসিড আক্রান্ত হন। বর্তমানে তিনি একজন দক্ষ দর্জি এবং কাপড় ডিজাইনার। তার তৈরি করা বিভিন্ন পোশাক শিরোজ হ্যাংআউটে প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। এভাবেই শিরোজ হ্যাংআউটের পাঁচ উদ্যোক্তা তাদের জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে চলেছেন। আর তাদের সকলের পেছনে ছায়া হয়ে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন এসএএ’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অলক দীক্ষিত। তিনি বলেন,
এসিডদগ্ধদের মধ্য থেকে যারা বেঁচে থাকেন, তারা সাড়া জীবন ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকেন। বিশেষত তারা যখন তাদের ক্ষত-বিক্ষত চেহারার কারণে সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হন, তখন তাদের সেই ট্রমা অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের জন্য এমন কিছু মানুষ থাকা খুব জরুরী যারা তাদের হাতকে শক্ত করে ধরবে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলবে। আমরা তাদের জন্য সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
তবে শুধুমাত্র আবেগ বা দয়ার উপর নির্ভর করে পাঁচ উদ্যোক্তা তাদের ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনা করেন না। গ্রাহকরা সন্তুষ্ট চিত্তেই শিরোজ হ্যাংআউট থেকে ফিরে যেতে পারেন। কেননা সেখানকার বাহারি কফির পাশাপাশি রয়েছে অনেক সুস্বাদু খাবারের সমাহার। এর ফলে স্বল্প সময়েই তাদের এই উদ্যোগ গ্রাহক মহলে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। যেমনটি বলছিলেন ক্যাফেটেরির নিয়মিত ভোক্তা শিখা শিং,
এটি খুব ভালো লাগার একটি বিষয় যে, তারা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেছেন; যদিও এই কাজ খুব পরিশ্রমের। আমি কেএফসি কিংবা ম্যাকডোনাল্ডস থেকে শিরোজ হ্যাংআউটকেই বেশি পছন্দ করি। কেননা আমি অন্তত এতটুকু নিশ্চিত থাকি যে, খরচের বিবেচনায় এখানে আমি উত্তম সেবা পাবো।