২০২২ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সীমান্তে রুশ সৈন্য সমাবেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্কের সীমান্তে ইউক্রেনীয় সৈন্য সমাবেশকে কেন্দ্র করে একদিকে রাশিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক এবং অন্যদিকে ইউক্রেন ও ন্যাটোর মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিরুদ্ধে একটি আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনার মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রুশ জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত একটি ভাষণে এই ঘোষণা প্রদান করেন এবং ইউক্রেনে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে সবিস্তারে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।
উক্ত ভাষণে ইউক্রেনীয় সঙ্কট, রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্ক এবং ইউক্রেনীয় সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা সম্পর্কে পুতিনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুটিত হয়েছে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ এবং রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে চলমান নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করার জন্য পুতিনের এই ভাষণটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে উক্ত ভাষণের অনুবাদ করা হয়েছে এবং ভাষণের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও মতামত প্রদান করা হয়েছে। নিচের ইটালিক অক্ষরে প্রদত্ত অংশগুলো পুতিনের প্রদত্ত ভাষণের অংশ এবং তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে আবদ্ধ বিবরণগুলো উক্ত ভাষণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা/মতামত।
ভাষণ
রাশিয়ার নাগরিকবৃন্দ, বন্ধুগণ,
আমার বক্তব্যের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ইউক্রেনের ঘটনাবলি এবং কেন এটি আমাদের জন্য, রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই আমার বার্তাটি ইউক্রেনে অবস্থানরত আমাদের সহযোগীদের জন্যও প্রযোজ্য। বিষয়টি খুবই গুরুতর, এবং এর সুগভীর আলোচনা প্রয়োজন।
দনবাসের পরিস্থিতি একটি বিপজ্জনক, সূক্ষ্ম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কী ঘটছে কেবল সেটির ব্যাখ্যা প্রদানের উদ্দেশ্যে নয়, একইসঙ্গে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে এবং সম্ভাব্য অতিরিক্ত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে আপনাদেরকে জানানোর উদ্দেশ্যেও আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে সরাসরি বক্তব্য রাখছি।
[দনবাসের পরিস্থিতি: ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সংঘটিত পশ্চিমা–পরিচালিত ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়, এবং একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও তীব্র রুশবিরোধী সরকার ইউক্রেনের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব ইউক্রেনে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন/অ্যান্টি–মাইদান শুরু হয় এবং পূর্ব ইউক্রেনের রুশ সীমান্তবর্তী কয়লাসমৃদ্ধ দনবাস অঞ্চলে স্থানীয় রুশপন্থীরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক’ নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৪–১৫ সালে ইউক্রেনীয় সরকার সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্র দুটি ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং তখন থেকে রুশ–সমর্থিত প্রজাতন্ত্র দুটির সঙ্গে ইউক্রেনের ‘নিম্ন তীব্রতার সংঘাত’ (low intensity conflict) চলছিল। যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে বিভিন্ন মাত্রায় সহায়তা প্রদান করেছে।
এই যুদ্ধের ফলে দনবাসে অন্তত ৩,৫০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ দনবাস থেকে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক ছিল না, বরং তারা ইউক্রেনের রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পক্ষপাতী ছিল। ২০১৫ সালে রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ইউক্রেন এবং দনেৎস্ক ও লুহানস্কের মধ্যে ‘মিনস্ক ২’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে সীমিত মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন প্রদানে সম্মত হয়। কিন্তু ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ‘মিনস্ক ২’ চুক্তিকে ইউক্রেনের জন্য একটি রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করে। ফলশ্রুতিতে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি পেত্রো পোরোশেঙ্কো এবং পরবর্তী ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘মিনস্ক ২’ চুক্তির শর্তাবলি বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি জানান।
উল্টো ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ককে নির্মূল করার পরিকল্পনা করতে থাকে। রাশিয়া শুরু থেকেই ইউক্রেনকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ওপর পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ চালালে রাশিয়া এর পাল্টা জবাব দেবে। ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ওপর পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করে, এবং ইউক্রেনীয় সৈন্যরা দনেৎস্ক ও লুহানস্ক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। এমতাবস্থায় দনেৎস্ক ও লুহানস্কের সরকারদ্বয় তাদের সমস্ত বেসামরিক জনসাধারণকে রাশিয়ায় স্থানান্তরিত করার ঘোষণা দেয়। এই পরিস্থিতিকেই পুতিন তার ভাষণে দনবাসের পরিস্থিতির ‘বিপজ্জনক, সূক্ষ্ম পর্যায়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন]
আমি আবারো এই বিষয়ের ওপর জোর দিতে চাই যে, ইউক্রেন আমাদের জন্য কেবল একটি প্রতিবেশী দেশ নয়। এটি আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরা আমাদের সঙ্গী, আমাদের সবচেয়ে প্রিয়– কেবল সহকর্মী, বন্ধু ও এককালের সহযোদ্ধাই নয়, আমাদের আত্মীয়ও বটে, যারা রক্তের দ্বারা, পারিবারিক বন্ধনের দ্বারা সংযুক্ত।
অনাদিকাল থেকে ঐতিহাসিক রুশ ভূমির দক্ষিণ–পশ্চিমে বসবাসকারী জনগণ নিজেদেরকে রুশ এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন এই ভূখণ্ডের অংশবিশেষ রুশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হয়, তার আগে এবং পরে পরিস্থিতি একই ছিল।
[পুতিন তার ভাষণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। বস্তুত বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ/কিইভ রুশ সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত, এবং এটি ছিল প্রাচীন রুশ রাষ্ট্রের রাজধানী। ১২৩৬–৪০ সালে মোঙ্গল–নিয়ন্ত্রিত গোল্ডেন হোর্ড খানাতের আক্রমণে রুশ ভূমি বিধ্বস্ত হয়, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে রুশ ভূমির দক্ষিণ–পশ্চিমাংশ (অর্থাৎ বর্তমান ইউক্রেন) পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার হস্তগত হয়। ১৬৫৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনে বসবাসরত কসাকরা রাশিয়ার সঙ্গে ‘পেরেইয়াস্লাভ চুক্তি’ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়, এবং এর ফলশ্রুতিতে সংঘটিত ১৬৫৪–৬৭ সালের রুশ–পোলিশ যুদ্ধের ফলে কিয়েভসহ পূর্ব ইউক্রেন পুনরায় রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়]
সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, আমরা সকলেই এই সত্যগুলো জানি, এটি সাধারণ জ্ঞান। তা সত্ত্বেও আজ যা ঘটছে তা অনুধাবন করা, রাশিয়ার কার্যক্রমের পশ্চাতে থাকা উদ্দেশ্য এবং আমরা যা অর্জন করতে চাই সেগুলোর ব্যাখ্যা করার জন্য বিষয়টির ইতিহাস সম্পর্কে অন্তত অল্প কিছু কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
সুতরাং, আমি এই বাস্তবতা উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে শুরু করতে চাই যে, আধুনিক ইউক্রেন ছিল সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার, বা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, বলশেভিক, কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের ঠিক পরেই কার্যত এই প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছিল, এবং লেনিন ও তার সহকর্মীরা এটি এমনভাবে করেছিলেন, যা ছিল রাশিয়ার জন্য খুবই কঠোর– ঐতিহাসিক রুশ ভূমিকে পৃথক, বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে। সেখানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মানুষ কী ভাবছিল, সেই প্রশ্ন কেউ করেননি।
এরপর দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধের আগে ও পরে স্তালিন এমন বেশ কিছু ভূখণ্ডকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করেন, এবং ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেন যেগুলো ইতিপূর্বে পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও হাঙ্গেরির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই প্রক্রিয়ায় তিনি পোল্যান্ডকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঐতিহাসিক জার্মান ভূখণ্ডের অংশবিশেষ প্রদান করেন। ১৯৫৪ সালে ক্রুশ্চেভ কোনো কারণে রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়াকে সরিয়ে নেন, এবং সেটিও ইউক্রেনকে প্রদান করেন। কার্যত এভাবেই আধুনিক ইউক্রেনের ভূখণ্ড গঠিত হয়েছিল।
[পুতিনের বক্তব্য অনুসারে, আধুনিক ইউক্রেন বলশেভিক–শাসিত রাশিয়ার সৃষ্ট একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ও পশ্চিমা বিশ্ব পুতিনের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে, এবং পুতিনের এই বক্তব্যকে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের আদর্শিক ভিত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু ইউক্রেনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, প্রকৃতপক্ষেই বিংশ শতাব্দীর আগে ইউক্রেন কখনো স্বাধীন ছিল না। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউক্রেনের ভূখণ্ডের অংশবিশেষে কসাকরা একধরনের রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলেছিল, কিন্তু উক্ত কসাক রাষ্ট্রগুলো সার্বভৌম ছিল না। সেগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে রাশিয়া, পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া কিংবা উসমানী রাষ্ট্রের ‘আশ্রিত রাষ্ট্র’ ছিল।
১৯১৭ সালের মার্চে রাশিয়ার তদানীন্তন রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেইন্ট পিটার্সবার্গ) সংঘটিত একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রাশিয়ার ক্ষমতাসীন রোমানভ রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং একটি অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ১৯১৭ সালের জুনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ নামক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে এবং রুশ অস্থায়ী সরকার ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসনকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিকে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে পেত্রোগ্রাদে সংঘটিত আরেকটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রুশ অস্থায়ী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। বলশেভিকরা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
পরবর্তী কয়েক বছর ইউক্রেনের ভূখণ্ডে একটি রক্তক্ষয়ী বহুপাক্ষিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বলশেভিকরা, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা, ইউক্রেনীয় রক্ষণশীলরা, জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ইউক্রেনীয় নৈরাজ্যবাদীরা প্রভৃতি বিভিন্ন পক্ষ ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে বর্তমান ইউক্রেনের সিংহভাগ ভূখণ্ড (পূর্ব ইউক্রেনসহ) ‘ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং অবশিষ্ট ভূখণ্ড (পশ্চিম ইউক্রেনসহ) পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়।
বলশেভিকরা দক্ষিণ রাশিয়ার বেশ কিছু ভূখণ্ড (দনেৎস্ক ও লুহানস্কসহ) সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইউক্রেনীয়করণ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইউক্রেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটায়, যেটি পরোক্ষভাবে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সেসময় বলশেভিকরা দক্ষিণ রাশিয়ার যেসব ভূখণ্ডকে সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করেছিল, এই বিষয়ে সেসব ভূখণ্ডের অধিবাসীদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি, বরং এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। একে পুতিন ‘রাশিয়ার জন্য খুবই কঠোর’ একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ইয়োসেব স্তালিনের শাসনামলে সোভিয়েত ইউক্রেনের সীমানা বর্ধিত হয়। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের কাছ থেকে পশ্চিম ইউক্রেন অধিকার করে এবং ১৯৪০ সালে রোমানিয়ার কাছ থেকে উত্তর বুকোভিনা, হেরৎসা ও আরো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল অধিকার করে। উক্ত অঞ্চলগুলোকে সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪১-৪৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অক্ষশক্তি (জার্মানি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসমূহ) পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, এবং সোভিয়েত ও রুশ ইতিহাসে এই যুদ্ধকে ‘দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধ চলাকালে অক্ষশক্তি সমগ্র সোভিয়েত ইউক্রেন দখল করে নেয়, কিন্তু ১৯৪৪–৪৫ সালে সোভিয়েত সৈন্যরা সোভিয়েত ইউক্রেনকে মুক্ত/পুনর্দখল করে। তদুপরি, এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরির কাছ থেকে জাকারপাত্তিয়া অধিকার করে সেটিকে সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাকারপাত্তিয়া চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ ছিল, কিন্তু ১৯৩৯ সালে হাঙ্গেরি চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে অঞ্চলটি দখল করে নেয়।
উল্লেখ্য, দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধ শুরুর পর থেকে পোল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ১৯৪৪ সালে রুমানিয়া অক্ষশক্তি থেকে বের হয়ে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এই তিনটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ভূখণ্ডগুলো অধিকার করে সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করেছিল, সেগুলোকে তাদের কাছে প্রত্যর্পণ করেনি। অবশ্য পোল্যান্ডের কাছ থেকে অধিকৃত ভূখণ্ডের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডকে জার্মানির পূর্বাংশের অংশবিশেষ প্রদান করে।
সর্বশেষ, ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে সোভিয়েত ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেন। ক্রুশ্চেভের এই সিদ্ধান্তের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিষয়টি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, পুতিনের বক্তব্য হচ্ছে, আধুনিক ইউক্রেনের (যেটি ইউরোপের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি) ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা সংযোজিত হয়েছে। পুতিনের উক্ত বক্তব্য ঐতিহাসিক বাস্তবতার দিক থেকে সত্য, কিন্তু যেকোনো ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। পুতিনের দৃষ্টিকোণ হচ্ছে, ইউক্রেন সোভিয়েত বলশেভিকদের দ্বারা সৃষ্ট একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র এবং ইউক্রেনীয় জাতি প্রকৃতপক্ষে একটি কৃত্রিম জাতি। রুশ জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের কাছে এবং ইউক্রেনীয় রুশপন্থীদের কাছে এই দৃষ্টিকোণটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু পুতিনের দৃষ্টিকোণই যে একমাত্র সঠিক দৃষ্টিকোণ, বিষয়টি এমন নয়।
প্রখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ভাষ্য অনুসারে, প্রতিটি জাতিই প্রকৃতপক্ষে ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (imagined community)। তার বক্তব্য অনুসারে, একটি জাতির কোনো সদস্য কখনোই উক্ত জাতির সিংহভাগ সদস্যের সাক্ষাৎ পাবে না বা তাদের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ পাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে কোনো না কোনো জাতির সদস্য হিসেবে বিবেচনা করে। এর কারণ হচ্ছে, একজন ব্যক্তির জন্মের পর থেকেই রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে একটি ধারণা বা বিশ্বাসের সঞ্চার ঘটায় যে, সে কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতির সদস্য। এভাবে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি ব্যক্তির সমষ্টিগত বিশ্বাসের ফলে একটি জাতির সৃষ্টি হয়, যেটি প্রকৃতপক্ষে কল্পিত, কিন্তু সকলের কাছে বাস্তব হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
উদাহরণস্বরূপ, শ্রীমঙ্গলে বসবাসরত জনসাধারণের সিংহভাগের সঙ্গে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে বসবাসরত জনসাধারণের সিংহভাগের হয়তো কখনোই দেখা হবে না, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে যে, তারা একই জাতির অংশ, এবং এই সমষ্টিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতেই বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বিরাজমান। যদি কখনো সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, তারা বাঙালি জাতির অংশ নয়, বরং স্বতন্ত্র কোনো জাতির অংশ, এবং যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উক্ত বিশ্বাসের বিস্তার ঘটানো হয়, সেক্ষেত্রে কালক্রমে তারা নতুন একটি জাতিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ, অ্যান্ডারসনের তত্ত্ব অনুসারে, কেবল ইউক্রেনীয় জাতিই নয়, বিশ্বের সকল জাতিই ‘কৃত্রিম’, যেগুলোর মধ্যে রুশ জাতিও রয়েছে]
কিন্তু আমি এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলতে গেলে, আমাকে একটু দূর থেকে এদিকে অগ্রসর হতে হবে।
আমি আপনাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব এবং তৎপরবর্তী গৃহযুদ্ধের পর বলশেভিকরা একটি নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এই বিষয়টি নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে বেশ গুরুতর মতবিরোধ ছিল। ১৯২২ সালে স্তালিন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) মহাসচিব এবং জাতীয়তা বিষয়ক জনকমিশারের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার পরামর্শ ছিল রাষ্ট্রটিকে স্বায়ত্তশাসনের নীতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা, অর্থাৎ একটি একীভূত রাষ্ট্রে যোগদানের পর প্রজাতন্ত্রগুলোকে – ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক সত্তাগুলোকে – বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদান করা।
লেনিন এই পরিকল্পনার সমালোচনা করেন এবং জাতীয়তাবাদীদের, যাদেরকে তিনি তখন ‘স্বাতন্ত্র্যবাদী’ হিসেবে অভিহিত করতেন, ছাড় প্রদানের প্রস্তাব করেন। লেনিনের ধারণাগুলো, যেগুলোর নির্যাস ছিল একটি কনফেডারেটিভ রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ক স্লোগান, সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তরে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে ১৯২২ সালের সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ঘোষণায় সেগুলোকে নিশ্চিত করা হয় এবং পরবর্তীতে লেনিনের মৃত্যুর পর ১৯২৪ সালের সোভিয়েত সংবিধানে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এটি সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথম প্রশ্নটিই মূল প্রশ্ন: কেন জাতীয়তাবাদীদের তুষ্ট করার, প্রাক্তন সাম্রাজ্যের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী উচ্চাভিলাষকে পরিতুষ্ট করার প্রয়োজন হয়েছিল? নতুন, প্রায়শ নির্বিচারে সৃষ্ট প্রশাসনিক বিভাগগুলোর– ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর– কাছে এমন বিস্তৃত ভূখণ্ড হস্তান্তর করার কী তাৎপর্য ছিল, যে ভূখণ্ডগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না? আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, এই ভূখণ্ডগুলোকে ঐতিহাসিক রুশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসাধারণের সঙ্গে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
তদুপরি, এই প্রশাসনিক বিভাগগুলোকে কার্যত জাতীয় রাষ্ট্রসত্তার মর্যাদা ও আকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। সেটি আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়: কেন এরকম উদারভাবে উপহার প্রদান করার প্রয়োজন হয়েছিল, যা সবচেয়ে উৎসাহী জাতীয়তাবাদীদেরও উদ্ভটতম স্বপ্নের বাইরে ছিল? এসব কিছুর ওপর, কেন কোনো রকম শর্ত ছাড়াই প্রজাতন্ত্রগুলোকে একীভূত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার দেয়া হয়েছিল?
প্রথম দেখায় একে পুরোপুরি দুর্বোধ্য, এমনকি পাগলামি বলেও মনে হয়। কিন্তু সেটি কেবল প্রথম দেখাতেই। এর একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। বিপ্লবের পর বলশেভিকদের মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে, একদম যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা। এই উদ্দেশ্যে তারা সবকিছু করেছিল: কাইজার–শাসিত জার্মানি ও তার মিত্রদের সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নাটকীয় হওয়া সত্ত্বেও এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও তারা অবমাননাকর ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি গ্রহণ করেছিল, এবং দেশের ভিতরে জাতীয়তাবাদীদের সকল দাবি ও ইচ্ছে পূরণ করেছিল।
রাশিয়া ও তার জনসাধারণের ঐতিহাসিক ভাগ্যের ক্ষেত্রে লেনিনের রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত নীতিগুলো কেবল ভুল ছিল না; প্রবাদে যেরকম বলে, এগুলো ছিল ভুলের চেয়েও খারাপ কিছু। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
[সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর নবগঠিত রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রকাঠামো কেমন হবে, সেটি নিয়ে লেনিন ও স্তালিনের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেনিন ও স্তালিন উভয়েই নীতিগতভাবে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যে বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘুদেরকে বিস্তৃত স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু এই নীতিকে কীভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে, সেটি নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ১৯২২ সালে জর্জিয়ার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যেকার এই বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। লেনিন চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি কনফেডারেশন হিসেবে গড়ে তুলতে। জাতীয়তার ভিত্তিতে গঠিত বলশেভিক–শাসিত প্রজাতন্ত্রগুলো স্বেচ্ছায় উক্ত কনফেডারেশনে যোগদান করবে এবং তাদের উক্ত কনফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার থাকবে, এমনটিই ছিল লেনিনের রূপকল্প।
অন্যদিকে, স্তালিন চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি একীভূত ফেডারেশন হিসেবে গড়ে তুলতে। তার সৃষ্ট রূপরেখা অনুসারে, উক্ত ফেডারেশনটি একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজমান থাকবে। রাষ্ট্রটিতে থাকা জাতিগত সংখ্যালঘুদেরকে বিস্তৃত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে, কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদেরকে তুষ্ট করতে চাচ্ছিলেন, অন্যদিকে স্তালিন উক্ত জাতীয়তাবাদীদের ছাড় প্রদানের বিরুদ্ধে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত লেনিনের রূপকল্পই বাস্তবায়িত হয় এবং সোভিয়েত সংবিধানে এই মর্মে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর যেকোনো সময়ে ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই হোক আর রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকেই হোক, তিনি লেনিন কর্তৃক প্রণীত জাতীয়তা সংক্রান্ত নীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবর্তন আনেননি। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর ওপর কেন্দ্রের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। স্তালিনের পরবর্তী সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর ওপর থেকে কেন্দ্রের অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে থাকেন এবং এই প্রক্রিয়ায় মিখাইল গর্বাচেভের সময়ে ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলোর ওপর থেকে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কার্যত লোপ পায়। ফলশ্রুতিতে ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলো তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে একে একে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, এবং শেষপর্যন্ত ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। অর্থাৎ, লেনিন কর্তৃক প্রণীত জাতীয়তা সংক্রান্ত নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, লেনিন কেন সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোয় এরকম পরোক্ষভাবে আত্মঘাতী নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন? পুতিনের ভাষ্যমতে, সেসময় বলশেভিকদের মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা, সুতরাং বলশেভিক শাসনের প্রতি জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে লেনিন এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পুতিনের বক্তব্য সঠিক। ১৯২০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সুবৃহৎ সোভিয়েত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূখণ্ডগুলোর ওপর বলশেভিকদের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল বটে, কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল নাজুক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্বহীন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের আগ পর্যন্ত মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর ওপর সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এ সময় বলশেভিক শাসনের জন্য দুটি মারাত্মক অভ্যন্তরীণ হুমকি বিরাজমান ছিল— রুশ জাতীয়তাবাদী/রাজতন্ত্রীরা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। বলশেভিকরা রুশ রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে ক্ষমতায় এসেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই উক্ত রাজতন্ত্রীরা ছিল বলশেভিকদের চরম শত্রু। অনুরূপভাবে, রুশ জাতীয়তাবাদীরাও ছিল বলশেভিকদের চরম শত্রু, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, বলশেভিকদের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র কারণে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড হারিয়েছে। তদুপরি, তাদের ভাষ্যমতে, বলশেভিকরা রাশিয়ার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে রুশ জনসাধারণের ওপর বিজাতীয় কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নিজ নিজ অঞ্চলগুলোকে সোভিয়েত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক ছিল।
এমতাবস্থায় বলশেভিকদের অবস্থানকে মজবুত করার জন্য লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত সংখ্যালঘুদের বৃহত্তর অংশের সমর্থন লাভ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এজন্য তিনি এমন একটি জাতীয়তা নীতি প্রণয়ন করেন, যেটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত সংখ্যালঘুদের সিংহভাগকে এবং মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদীদেরকে সন্তুষ্ট করে। তাদের সমর্থন সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিকবাদের ভিতকে শক্ত করে তোলে।
অবশ্য লেনিন তার প্রণীত জাতীয়তা নীতিকে আত্মঘাতী হিসেবে বিবেচনা করেননি। বলশেভিকদের বিশ্বাস ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ফলে রাষ্ট্রটিতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মধ্যে এক অটুট বন্ধনের সৃষ্টি হবে এবং তাদের জাতিগত পরিচিতি (ethnic identity) ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে তাদের শ্রেণি পরিচিতি (class identity) জোরদার হবে। বলশেভিকদের বিশ্বাস ছিল, কমিউনিজম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রবিহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি বৃহত্তর কমিউনিস্ট বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় মাত্র।
এজন্য কট্টর বলশেভিকদের কাছে লেনিন কর্তৃক প্রণীত তথাকথিত ‘আত্মঘাতী’ জাতীয়তা নীতি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু পুতিন এমন একটি প্রজন্মের অংশ, যাদের দৃষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ‘মাতৃভূমি’ ছিল, কিন্তু যাদের মধ্যে কমিউনিজমের আদর্শিক উন্মাদনা ছিল না। এই প্রজন্মের দৃষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘বৃহত্তর কমিউনিস্ট বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়’ ছিল না, বরং তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতোই একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করত। স্বাভাবিকভাবেই, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের জনসাধারণ যেভাবে নিজ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে স্পর্শকাতর, পুতিন যে প্রজন্মের অংশ সেই প্রজন্মও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়ে একই রকম স্পর্শকাতর ছিল। এজন্য পুতিনের দৃষ্টিকোণ থেকে, লেনিনের জাতীয়তা নীতি ছিল আত্মঘাতী।
অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুতিনের বক্তব্য ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন: পুতিন মন্তব্য করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশাসনিক বিভাগগুলো (প্রজাতন্ত্রগুলো) ‘নির্বিচারে’ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোর সীমানা নির্ধারণের ইতিহাস ঘাঁটলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বলশেভিকরা যথেষ্ট হিসেব–নিকেশ করে জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর সীমানা নির্ধারণ করেছিল। এক্ষেত্রে তারা জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত উপাদানগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতাগুলোকেও বিবেচনায় রেখেছিল।
তদুপরি, পুতিন বলশেভিকদের ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্তকে তাদের ‘যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা’র একটি কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পুতিনের এই বক্তব্য ঐতিহাসিক বাস্তবতার হিসেবে সঠিক, কিন্তু ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত জটিল এবং এটিকে কেবল বলশেভিকদের ক্ষমতালিপ্সার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলে বিষয়টির প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না]
অবশ্যই আমরা অতীতের ঘটনাবলি পরিবর্তন করতে পারি না, কিন্তু আমরা অন্ততপক্ষে কোনো সংরক্ষণশীলতা বা রাজনৈতিক কূটকৌশল ছাড়া খোলাখুলিভাবে ও সৎভাবে সেগুলোকে স্বীকার করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংযোজন করতে পারি যে, কোনো রাজনৈতিক হিসেব কোনো এক মুহূর্তে যতই মুগ্ধকর বা লাভজনক মনে হোক না কেন, সেটিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
আমি কারো ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছি না। সেসময় গৃহযুদ্ধের আগে এবং পরে দেশের অবস্থা খুবই জটিল ছিল; এটি ছিল গুরুতর। আজ আমি কেবল সেই জিনিসটিই বলতে চাই যেটি সেসময় প্রকৃতপক্ষে হয়েছিল। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। বস্তুত, আমি ইতোমধ্যেই বলেছি, সোভিয়েত ইউক্রেন বলশেভিকদের নীতির ফল এবং এটিকে “ভ্লাদিমির লেনিনের ইউক্রেন” বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তিনি ছিলেন এর স্রষ্টা এবং স্থপতি। এটি সম্পূর্ণভাবে ও বিস্তৃতভাবে আর্কাইভের নথি দ্বারা প্রমাণিত, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে দনবাস সম্পর্কে লেনিনের কঠোর নির্দেশনাসমূহ, যে অঞ্চলটিকে কার্যত ইউক্রেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর আজকে ইউক্রেনে “কৃতজ্ঞ প্রজন্ম” লেনিনের স্মৃতিস্তম্ভগুলো উপড়ে ফেলছে। তারা এটাকে ডিকমিউনাইজেশন বলছে।
তোমরা ডিকমিউনাইজেশন চাও? খুবই ভালো, এটায় আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মাঝপথে থেমে যাওয়া কেন? ইউক্রেনের জন্য প্রকৃত ডিকমিউনাইজেশনের অর্থ কী দাঁড়াবে, সেটা দেখানোর জন্য আমরা প্রস্তুত।
[২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে ইউক্রেনে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা ইউক্রেনের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। তাদের দৃষ্টিতে, কিয়েভ/কিইভকে কেন্দ্র করে যে রুশ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, ইউক্রেন সেই সভ্যতার প্রকৃত উত্তরসূরী এবং মস্কোকেন্দ্রিক রাশিয়া উক্ত সভ্যতার উত্তরাধিকারকে ইউক্রেনের কাছ থেকে ‘চুরি’ করেছে। তারা মস্কোকেন্দ্রিক রাশিয়াকে একটি ‘এশিয়াটিক’, ‘পশ্চাৎপদ’ ও ‘বর্বর’ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং নিজেদেরকে প্রকৃত ‘ইউরোপীয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তাদের মতে, ইতিহাসের যে সময়ে ইউক্রেন রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটি ছিল প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে রুশ/সোভিয়েত উপনিবেশবাদ ও দখলদারিত্বের সময়। বস্তুত ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা রাশিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কিছুকেই অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে এবং ইউক্রেন থেকে রুশ/সোভিয়েত প্রভাব নিশ্চিহ্ন করতে তারা বদ্ধপরিকর।
বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পরই ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেন থেকে প্রাক্তন সোভিয়েত/কমিউনিস্ট শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনগুলো অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়াকে ‘ডিকমিউনাইজেশন’ (Decommunization) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২০১৪ সালের বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেনের নতুন সরকার এই প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে জোরদার করে এবং ইউক্রেন থেকে কমিউনিজমের সমস্ত নিদর্শন অপসারণের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সোভিয়েত আমলে প্রদত্ত ইউক্রেনের শত শত শহর ও গ্রাম এবং হাজার হাজার সড়কের নাম পরিবর্তন করা হয়, সোভিয়েত আমলে নির্মিত হাজার হাজার স্মৃতিস্তম্ভ ও অন্যান্য নিদর্শনগুলো অপসারণ করা শুরু হয় (যেগুলোর মধ্যে লেনিনের স্মৃতিস্তম্ভগুলোও ছিল) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতীকগুলোর ব্যবহার ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়।
পুতিনের বক্তব্য অনুসারে, ইউক্রেন যদি ডিকমিউনাইজেশন ঘটাতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের মাঝপথে থেমে যাওয়া উচিত নয়। পুতিনের বক্তব্যের তাৎপর্য হচ্ছে, বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কমিউনিস্ট আমলে ইউক্রেনের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে, সুতরাং ইউক্রেন যদি সত্যিই কমিউনিজমের সকল নিদর্শন অপসারণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের উচিত উক্ত ভূখণ্ডগুলো (দনবাস, ক্রিমিয়া, গালিৎসিয়া, ভোলিন, জাকারপাত্তিয়া প্রভৃতি) ছেড়ে দেয়া। “ইউক্রেনের জন্য প্রকৃত ডিকমিউনাইজেশনের অর্থ কী দাঁড়াবে, সেটা দেখানোর জন্য আমরা প্রস্তুত” — পুতিনের এই বাক্যটি ছিল ইউক্রেনের প্রতি সরাসরি হুমকি। বস্তুত ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত পুতিনের ভাষণের এই অংশটি থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, রাশিয়া শীঘ্রই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। পুতিনের এই ভাষণের দু’দিন পরেই রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালায়]