গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপলিসে চার পুলিশ অফিসারের কাস্টডিতে মৃত্যুবরণ করেন জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন আফ্রিকান-আমেরিকান। সিসিটিভি ফুটেজ এবং পথচারীদের করা ভিডিওতে উঠে আসে ফ্লয়েডের প্রতি পুলিশের নির্মমতার চিত্র। ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের জনগণ, তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে। শুরুতে কেবল এক পুলিশ অফিসারের প্রতি হত্যার অভিযোগ আনা হলেও পরে উপস্থিত চার পুলিশের প্রতিই হত্যার অভিযোগ আনা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তৈরি পুরো ঘটনাটির অনুসন্ধানের অনুবাদটি এখানে তুলে ধরা হলো।
মিনিয়াপলিসে এক সোমবার সন্ধ্যাবেলা। ২০ ডলারের একটি জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগ এনে পুলিশকে জানানো হলে পুলিশ তাতে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হয়। তার সতেরো মিনিট পরে নিথরভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় সন্দেহভাজন মানুষটি দেহ এবং কিছুক্ষণ বাদেই তাকে মৃত ঘোষণা কয়া হয়। মানুষটি ছিল ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড, করোনাভাইরাস মহামারীতে সম্প্রতিই রেস্তোরাঁর চাকরি হারানো ফ্লয়েড ছিলেন হিউস্টনের বাসিন্দা।
ফ্লয়েডের মৃত্যু মিনিয়াপলিসবাসীকে আন্দোলনে নামিয়েছে, এবং ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশজুড়ে।
চার অফিসারকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ঘটনার তদন্তও শুরু হয়েছে। তাদের একজন, ডেরেক শভিন, অভিযুক্ত হয়েছেন থার্ড-ডিগ্রি মার্ডার এবং ম্যানস্লটার অভিযোগে, গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে।
টাইমসের পক্ষ থেকে সিসিটিভি ফুটেজ, পথচারীদের ধারণ করা ভিডিওগুলোর অনুসন্ধান করা হয়েছে, ঘটনার সাক্ষী এবং অভিজ্ঞদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে, অফিসিয়াল নথিপত্র ঘেঁটে দেখা হয়েছে যাতে ঘটনাটির পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিবরণ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি।
২৫ মে’র ঘটনাটির শুরু এখানে থেকে- ফ্লয়েড বসে আছেন নীল রঙের একটি এসইউভি গাড়ির ড্রাইভার সিটে। রাস্তার ওপারে রয়েছে একটি দোকান, নাম কাপ ফুডস। রাস্তার এই পাশের সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে আমরা বুঝতে পারি এরপর কী ঘটেছে।
সন্ধ্যা ৭:৫৭, কাপ ফুডসের দুই কর্মচারী গাড়িতে বসা ফ্লয়েডের দিকে এগিয়ে আসে, তারা অভিযোগ আনাতে আসে সিগারেট কিনতে ২০ ডলারের ব্যবহৃত নোটটি জাল। তারা তাদের সিগারেট ফেরত চাইলেও খালি হাতে ফিরে যেতে দেখা যায় তাদের।
চার মিনিট পর, তারা পুলিশকে কল করে। ৯১১ এর ট্রান্সক্রিপ্ট অনুযায়ী এক কর্মচারী অভিযোগ জানায় ফ্লয়েড জাল নোট ব্যবহার করেছে এবং সে মদ্যপ আর নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় আছে। খুব দ্রুতই ঘটনাস্থলে প্রথম পুলিশের গাড়িটি আসে। অফিসার থমাস লেন এবং জে. অ্যালেক্সান্ডার কুয়েং গাড়ি থেকে নেমে এসইউভির দিকে অগ্রসর হন।
কিছু সময় পরেই লেন তার পিস্তলটি বের করেন, আমরা জানি না ঠিক কেন, এরপর ফ্লয়েডকে আদেশ দেন তার হাত ড্রাইভিং হুইলের উপর রাখতে। কিন্তু আবারো পিস্তল নামিয়ে রাখার প্রায় দেড় মিনিট পর তাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়। এই ঘটনাটির ভিডিও করা হয়েছে ফ্লয়েডের গাড়ির পিছে পার্ক করা অন্য আরেকটি গাড়ির ভেতর থেকে।
ফ্লয়েডকে হাতকড়া পরানোর পর কুয়েং তাকে রেস্তোরাঁর দেয়ালে টেনে নিয়ে যায়। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যেটি দেখা যায় পাশের রেস্তোরাঁর সিকিউরিটি ক্যামেরাতে।
ট্রান্সক্রিপ্ট এবং ফুটেজ দেখে আমরা এখন পর্যন্ত তিনটি বিষয় নিশ্চিত। প্রথমত, পুলিশ জানতো তারা একজন মদ্যপ এবং নিয়ন্ত্রণহীন মানুষের সামনাসামনি রয়েছেন। দ্বিতীয়ত, পুলিশ যদিও এ ধরনের ঘটনা আশা করেছিল, এরপরও ফ্লয়েডকে কোনোরকম আক্রমণাত্মক আচরণ করতে দেখা যায়নি। তৃতীয়ত, তাকে এর মধ্যেই অনেক বিধ্বস্ত দেখায়।
গ্রেপ্তার করার ছয় মিনিট, ফ্লয়েডকে তারা নিজেদের গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে অফিসাররা যখন তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যান, ফ্লয়েড হঠাৎ মাটিতে পড়ে যায়। অভিযোগ অনুসারে, ফ্লয়েড জানান তিনি ক্লাস্ট্রোফোবিক, তাই তিনি গাড়ির ভেতরে যেতে পারবেন না।
অফিসারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়, বেশ কয়েকবার ফ্লয়েড পুলিশের দিকে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করেন এবং বলেন তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না।
ঘটনাস্থলে আগমন ঘটে এবারে তৃতীয় ও শেষ পুলিশের গাড়িটির। এখানে ছিলেন দুজন অফিসার, ডেরেক শভিন এবং টু থাও। উভয়ের বিরুদ্ধেই পূর্বে থেকে অভিযোগ ছিল। থাও অভিযুক্ত হয়েছিলে একজনকে মাটিতে আছড়ে ফেলে পেটানোর দায়ে। শভিন অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনবার পুলিশি গোলাগুলির সম্পৃক্ততায়, যার মধ্যে একটি ছিল গুরুতর।
শভিন এবারে ফ্লয়েডকে গাড়িতে তোলার জন্য ধ্বস্তাধস্তি শুরু করেন। কাপ ফুডসের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কুয়েং ফ্লয়েডের সাথে পেছনের সিটে ধ্বস্তাধস্তি করছেন এবং পাশে থাও দাঁড়িয়ে তা দেখছেন। এবারে শভিন ফ্লয়েডকে সিট থেকে নামিয়ে রাস্তায় আনেন, আমরা জানি না কেন এমনটা করা হয়েছে।
ফ্লয়েডকে ফুটপাতে উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হয়। এরপরই দুজন পথচারী ভিডিও ধারণ করা শুরু করেন। প্রথম ফুটেজে দেখা যায় চারজন পুলিশ অফিসার ফ্লয়েডকে ঘিরে রয়েছেন। প্রথমবারের মতো আমরা ফ্লয়েডকে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম যেখানে তিনজন অফিসার তার গলা, ঘাড় এবং পা বল প্রয়োগ করে চেপে ধরে রেখেছেন।
৮:২০, আমরা প্রথমবারের মতো ফ্লয়েডের আওয়াজ শুনতে পেলাম। “I can’t breathe, man. Please“. ভিডিও ধারণ বন্ধ করে দেয়া হয় যখন লেন ভিডিও ধারণকারীকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। অফিসাররা এর মধ্যে রেডিওতে কোড-২ এর জন্য অনুরোধ করেন, যেটি নন-ইমারজেন্সি মেডিকেল টিমের সহায়তার জন্য, কারণ ফ্লয়েডের মুখে আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে আমরা ফ্লয়েডের গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। কিন্তু খুব দ্রুতই কোড-৩ এর জন্য কল করা হয়, যেটি ইমারজেন্সি মেডিকেল সহায়তার জন্য।
ইতিমধ্যে আরেকজন পথচারী, ১৭ বছর বয়সী ডারনেলা ফ্রেইজার অন্য আরেক দিক থেকে ভিডিও ধারণ করা শুরু করেন। সেখানে দেখা যায় মেডিকেল সহায়তা চাইলেও পরের সাত মিনিট শভিন একইভাবে ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু সেখানে দেখা যায়নি কুয়েং আর লেন বল প্রয়োগ করছিল কি না। (এই পর্যায়ে শভিন এবং ফ্লয়েডের কিছু কথা শোনা যায়)
শভিন: তুমি কী চাও?
ফ্লয়েড: আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দয়া করুন, আপনার হাঁটু আমার ঘাড়ে….আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
শভিন: ঠিক আছে, তাহলে তুমি উঠে পড়ে গাড়িতে বসো।
ফ্লয়েড: আচ্ছা আমি বসবো।
শভিন: উঠে পড়ো।
ফ্লয়েড: আমি নড়তে পারছি না।
(ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে রেখে ফ্লয়েডকে বারবার উঠতে বলা হলে এই পর্যায়ে ফ্লয়েডের গোঙানি এবং তার মাকে ডাকতে শোনা যায়)
পরের ভিডিও দুটিতে একইভাবে ফ্লয়েডকে পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১৬ বার সে অনুরোধ করে সে শ্বাস নিতে পারছে না। এরপরও শভিন তার হাঁটু সরায়নি, ফ্লয়েড চোখ বুজে জ্ঞান হারানো সত্ত্বেও। (পথচারীদের এই পর্যায়ে শভিনকে সরে যাবার জন্য অনুরোধ এবং প্রতিবাদ করতেও দেখা যায়)
মেডিকেল এবং পুলিশিং বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চার পুলিশ এখন যা করছে তা নীতিবিরুদ্ধ এবং অবস্থা গুরুতর। তারা ফ্লয়েডকে মুখ নিচে রেখে বল প্রয়োগ করে চেপে ধরে রেখেছে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে। তাদের এই কাজের জন্য ফ্লয়েডের বুকে চাপ পড়ছে এবং তার পক্ষে শ্বাস নেয়া একরকম অসম্ভব। শভিন যেভাবে তার ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছে এই কৌশল বেশিরভাগ পুলিশ ডিপার্টমেন্টে নিষিদ্ধ। মিনিয়াপলিস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পলিসি অনুযায়ী একজন পুলিশ অফিসার কেবল তখনই এই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন যখন কেউ সক্রিয়ভাবে বাধা দেয়।
যদিও মেডিকেল সহায়তার জন্য অফিসাররা কল করেছেন, এরপরও তাদের নিজে থেকে ফ্লয়েডকে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়নি। (এই পর্যায়ে পথচারী ও ভিডিও ধারণকারীরা ফ্লয়েডের নাড়ী পরীক্ষা করার জন্য প্রতিবাদ করতে থাকেন)
ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, অফিসার লেন দুবার শভিনকে ফ্লয়েডের উপর থেকে সরে যাবার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু শভিন না বলেছিল।
এরেস্ট হবার বিশ মিনিট পর ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায়। ইএমটি তার নাড়ী পরীক্ষা করে। ফ্লয়েড পুরোপুরিভাবে নিথর হয়ে পড়ে থাকার পরও আরও এক মিনিট শভিন ফ্লয়েডের ঘাড়ের উপর চেপে থাকে। ইএমটি তাকে সরে যেতে বলার পরই কেবলমাত্র শভিন উঠে বসে। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অনুযায়ী পুরো ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে শভিন ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে রাখে। এরপর ফ্লয়েডকে অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হয়।
অ্যাম্বুলেন্সটি এরপর চলে যায়, খুব সম্ভবত লোকজন জড়ো হতে থাকে এই কারণে। কিন্তু ইএমটি অতিরিক্ত ফায়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে মেডিকেল সহায়তার জন্য আবারো কল করে।
৮:৩২, ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি যখন পৌঁছায় চার পুলিশ অফিসারের কেউই বলতে পারেন না ফ্লয়েডের অ্যাম্বুলেন্স এখন কোথায়। এই ঘটনা মেডিকেল টিমকে সহায়তা করতে আরও দেরি করিয়ে দেয়। এরমধ্যেই ফ্লয়েডের কার্ডিয়াক এরেস্ট শুরু হয়ে গেছে। ফায়ার ডিপার্টেমেন্টের গাড়ি ফ্লয়েডের অ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছাতে আরো পাঁচ মিনিট সময় নেয়। ৯ টা ২৫ মিনিটের দিকে নিকটস্থ একটি হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ফ্লয়েডের প্রাথমিক ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় পুলিশের বল প্রয়োগ এবং পূর্বেকার হার্টের অসুখের জন্য ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়েছে। যদিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এরেস্টের এই ভিডিওগুলো পুরোপুরিভাবে তুলে ধরে না আসলে ফ্লয়েডের ভাগ্যে সেদিন কী ঘটেছিল।
পুলিশের কাছে থাকা অতিরিক্ত অডিও এবং বডি ক্যামেরার ভিডিও হয়তো পারবে তুলে ধরতে কেন এই কীভাবে এই ঘটনা শুরু হয়েছে এবং এত দূর গড়িয়েছে।
খুব দ্রুতই এরপর চার পুলিশকে বরখাস্ত করা হয় এবং শভিনের বিরুদ্ধে মার্ডার এবং ম্যানস্লটারের অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু অনেকের জন্যই কেবল এটুকুই যথেষ্ট না, ক্ষোভ আর আন্দোলন কেবল তাই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়েই যাচ্ছে বেশি থেকে আরো বেশিতে।