“আজকের তাপমাত্রা কত?” এই প্রশ্নের উত্তরে যদি আপনি শোনেন ৯৪ ডিগ্রি, তাহলে আঁতকে উঠবেন নিশ্চয়ই। আঁতকে ওঠারই কথা। পরিমাপের একক সেলসিয়াস নয়, বরং ফারেনহাইট শুনলে তারপরই কিছুটা শান্ত হবেন। তবে পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করবেন, ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে কত ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়!
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয় সেলসিয়াস এককে। শুধু তাপমাত্রা নয়, সবকিছুই পরিমাপ করা হয় মেট্রিক পদ্ধতিতে। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র। সত্যি বলতে কি, পৃথিবীর মাত্র ৩টি দেশ মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে না- মায়ানমার, লাইবেরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকানদের মাপজোখের পদ্ধতিকে এককথায় বলা যেতে পারে জগাখিচুড়ি! ফুট, পাউন্ড, মাইল, গ্যালন প্রভৃতি একক ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে আমেরিকানরা। সেটা বাইরের পৃথিবীর কাছে যত অদ্ভুতই মনে হোক না কেন। শুধু তা-ই না, কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচটি ‘আমেরিকান ফুটবল ফিল্ডে’র সমান অথবা প্রায় দশটি হ্যামবার্গারের সমান ওজনের কোনো কিছু- এরকম অদ্ভুত এবং সৃজনশীল একক ব্যবহার করতেও পিছপা হয় না তারা!
কেন মেট্রিক পদ্ধতি সুবিধাজনক?
মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিমাপের সুবিধা হচ্ছে বিভিন্ন এককের মধ্যে অত্যন্ত সহজ রুপান্তর। ১০ মিলিমিটারে ১ সেন্টিমিটার, ১০০ সেন্টিমিটারে ১ মিটার, ১০০০ মিটারে ১ কিলোমিটার- এরকম সরল দশমিক সম্পর্ক ব্যবহার করা হয় মেট্রিক পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, আমেরিকান কাস্টমারি এককের মধ্যে রুপান্তর অত্যন্ত জটিল এবং দুর্বোধ্য। ১২ ইঞ্চিতে ১ ফুট, ৩ ফুটে ১ গজ, আবার ১৭৬০ গজে ১ মাইল- এরকম সম্পর্ককে আর যা-ই হোক সরল বলা যাবে না!
তাপমাত্রা পরিমাপের সেলসিয়াস এককে যেখানে পানির হিমাঙ্ককে ০ ডিগ্রি এবং স্ফুটনাঙ্ককে ১০০ ডিগ্রি ধরে পরিমাপ করা হয়, সেখানে ফারেনহাইট এককের ৩২ ডিগ্রি এবং ২১২ ডিগ্রিকে যে কারো কাছে একদম র্যান্ডম মনে হতেই পারে।
যেভাবে এলো মেট্রিক পদ্ধতি
মেট্রিক পদ্ধতি আসার কারণ যতটুকু বৈজ্ঞানিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই পণ্য আদান-প্রদানের জন্য পরিমাপ পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ই পরিমাপের জন্য ‘একহাত পরিমাণ দৈর্ঘ্য’ বা ‘দশটি শস্যদানার সমান ওজন’ এরমকম একক ব্যবহৃত হত। এরকম একক যে খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না সেটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পসারের সাথে সাথে সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য পরিমাপ পদ্ধতি প্রবর্তনের দরকার পড়ে। তবে এই কাজ মোটেও সহজ কিছু ছিল না। মধ্যযুগের শেষের দিকের ফ্রান্সের কথাই ধরা যাক। সেসময় প্রায় কোয়ার্টার মিলিয়ন এককের প্রচলন ছিল শুধু ফ্রান্সেই! এমন কিছু পরিবর্তনের ফলাফল স্বরূপ নিশ্চয়ই প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সেই ‘বিশৃঙ্খলা’র ক্ষেত্র তৈরি হয় ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরে। বিপ্লবের মাধ্যমে শুধু পুরাতন রাজতন্ত্রই ঝেড়ে ফেলা হয়নি, বরং একে একে ঝেড়ে ফেলা হতে থাকে পুরাতন ঐতিহ্য ও প্রথা।
এরই ধারাবাহিকতায় পুরো ফ্রান্সের জন্য একটি পরিমাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় এবং সেটাকে পুরাতন শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘আপামর জনতার’ পরিমাপ পদ্ধতি হিসেবে প্রচার করা হয়। বিভিন্ন একক সংজ্ঞায়িত করা হয় প্রাকৃতিক এবং সার্বজনীন ধ্রুবকের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরুপ দৈর্ঘ্যের একক মিটারের কথা বলা যেতে পারে। কোনো পুরাতন প্রথার সাথে না মিলিয়ে ১ মিটারকে বিষুব রেখা থেকে উত্তর মেরুর মধ্যকার দূরত্বের ১ কোটি ভাগের একভাগ ধরা হয়। দশমিক পদ্ধতিকে করা হয় সব কিছু পরিমাপের ভিত্তি। এমনকি ৭ দিনে ১ সপ্তাহের পদ্ধতি বাতিল করে ১০ দিনে সপ্তাহ ধরে নতুন ক্যালেন্ডারও প্রবর্তন করা হয়! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, চার্চের প্রভাব কমানো নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের একটি কারণ। এতে যে সপ্তাহে রবিবার বলে কিছু থাকবে না!
মেট্রিক পদ্ধতি শতভাগ না হলেও মোটামুটি টিকে যায় (যদিও ১০ দিনে সপ্তাহের ক্যালেন্ডারটি টেকেনি!)। ফ্রান্সে পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসেন ‘ফরাসি বিপ্লবের শিশু’ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি তার রাজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি প্রসারিত করেন মেট্রিক পদ্ধতি। নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন হলেও ইউরোপিয়ানরা মেট্রিক পদ্ধতির যৌক্তিকতা উপলদ্ধি করে এবং সেটা ব্যবহার করতে থাকে।
তবে ব্যতিক্রম ছিল ফ্রান্সের প্রবল শত্রু ব্রিটেন। ফরাসিদের উদ্ভাবিত কোনো পদ্ধতি ব্রিটিশরা ব্যবহার করবে এমন কথা কল্পনাও করা যায় না! এ যে চরম অপমান! অন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলো সারা বিশ্বে তাদের উপনিবেশগুলোতেও মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলন করে। ওদিকে ব্রিটেন তাদের উপনিবেশগুলোতেও তাদের পুরাতন ইম্পেরিয়াল সিস্টেম ব্যবহার করতে থাকে।
পরবর্তিতে দুই শতাব্দীর মধ্যে ব্রিটেন এবং তাদের উপনিবেশগুলো ধীরে ধীরে মেট্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে থাকে। তবে যত দিনে সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়, তত দিনে ঘটে যায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা আমেরিকা হয়ে যায় স্বাধীন। ততদিনে ফুট, গ্যালন, ইয়ার্ড, মাইলে অভ্যস্ত আমেরিকানরা তাদের পরিমাপ পদ্ধতি পাল্টানোর ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
মেট্রিক কনভার্শন অ্যাক্ট ১৯৭৫
পুরো পৃথিবীর সাথে তাল না মিলিয়ে ভিন্ন পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেই সুবিধাজনক কিছু ছিল না। মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিবর্তনের চেষ্টাও যে করা হয়নি সেরকম না। সেই লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে ‘মেট্রিক কনভার্শন অ্যাক্ট পাশ করে কংগ্রেস। পরিবর্তন সহজ করা এবং জনসাধারাণকে মেট্রিক পদ্ধতির সাথে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে গঠন করা হয় ‘ইউনাইটেড স্টেটস মেট্রিক বোর্ড’। তবে মেট্রিক কনভার্শন আইনের মধ্যে সমস্যা ছিল দুটি। প্রথমত, অন্যান্য দেশের মতো বাধ্যতামূলক না করে মেট্রিক পদ্ধতির ব্যবহারকে করা হয় ঐচ্ছিক। দ্বিতীয়ত, মেট্রিক পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য ঠিক করা হয়নি কোনো নির্দিষ্ট ডেডলাইন।
বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করা এককের বদলে নতুন একক ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছা আমেরিকানরা প্রকাশ করেনি। কষ্ট করে নতুন কিছু শেখার চেয়ে তারা বরং আগের এককগুলোই ব্যবহার করতে থাকে। হাইওয়ের পাশে মাইলের বদলে কিলোমিটার সাইন দেখে অথৈ সাগরে পড়তে আগ্রহ বোধ করেননি কোনো আমেরিকান চালক।
জনসাধারণের অনাগ্রহ আর প্রতিরোধের মুখে নিরুপায় হয়ে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮২ সালে মেট্রিক বোর্ড বিলুপ্ত করতে বাধ্য হন। যদিও কনভার্শন অ্যাক্ট পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয়নি। যেমন, এই অ্যাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে পরবর্তীতে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকে আমেরিকান কোম্পানিকে তাদের পণ্যগুলোকে দুভাবে লেভেল করতে হয়। আমেরিকানদের জন্য একভাবে আর বাকি পৃথিবীর মানুষদের জন্য আরেকভাবে!
মেট্রিক ম্যাথ ডিজাস্টার
মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার না করার কারণে আমেরিকাকে কম মূল্য পোহাতে হয়নি। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত (কুখ্যাত?) বিপর্যয় ঘটে ১৯৯৯ সালে। ২৮৬ দিনের যাত্রা শেষে নাসার ‘মার্স ক্লাইমেট অরবিটার’ মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে ঢোকার পরে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ। নাসাকে ১২৫ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের কারণ। স্পেসক্রাফটের অভিমুখ ঠিক রাখার জন্য অরবিটারের থ্রাস্টারে যে ফোর্স দিতে হয় সেটা মাসের পর মাস ধরে ভুলভাবে দেয়া হচ্ছিল। কারণ, নাসার নেভিগেশন টিমের কাছে থ্রাস্টারের ডাটা পাঠানো হচ্ছিল পাউন্ড এককে। সেটাকে মেট্রিক পদ্ধতিতে নিউটন একক ভেবে কাজ করছিল নাসার টিম!
তবে আমেরিকানরা সম্ভবত একমাত্র সময়ের একক ব্যবহার করে মেট্রিক পদ্ধতিতে। এত সেকেন্ড বা এত মিনিটের বদলে ‘একটি গড়পড়তা আমেরিকান ফুটবল ফিল্ডের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে একটি আমেরিকান ফুটবলের যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততটুকু’ শুনতে খুব একটা বোধগম্য হত না!