চারদিকে স্বার্থের পেছনে ছোটা শত শত মানুষ দেখে, আমরা হয়ত কল্পনাও করতে পারি না, মানুষ কতটা বিশাল হৃদয়ের হতে পারে। সাধারণের মাঝেই মানুষের মন কতটা অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার চারপাশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক দেখে, হতাশ হয়ে পড়ি। ভাবি, এর মধ্যে থেকে আশার আলো কীভাবে দেখেত পাওয়া যাবে! কিন্তু এসব স্বার্থ, শোক আর হাহাকারকে পরাজিত করে পৃথিবীর বুকে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন অস্ট্রেলিয়ান কোটিপতি এবং মানবতাবাদী আলী বানাত।
অনেকের মতো আপনিও হয়ত আলী বানাতের নাম এই প্রথমবার শুনছেন, কিন্তু এটাও সত্য যে, জীবনের শেষ সময়ের তাঁর মহানুভবতার গল্প শুনে তাঁর নাম আরো অনেক বছর মনে থাকবে। ইউটিউবে তাঁর প্রকাশিত ভিডিও, ‘Gifted With Cancer’ দেখে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তিনি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন।
কে এই আলী বানাত?
আলী বানাত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে বসবাসকারী একজন প্রয়াত মুসলিম ধনকুবের, যুব উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী, যিনি প্রায় তিন বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে গত ২৯ মে মাত্র ৩২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ক্যান্সার ধরা পড়ার আগে তিনি তার স্ত্রী এবং পরিবার নিয়ে সিডনীতে বসবাস করতেন। ২০১৫ সালে প্রথম তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার তার জীবনের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন মাত্র ৭ মাস। তবে তিনি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন ৩ বছর। কিন্তু এই ৩ বছরে তিনি এমন কিছু করে গেছেন যা তাঁকে আরো শত শত বছর পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদেকে সাহায্য করার লক্ষ্যে তাঁর সমস্ত অর্থ-সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন।
বিলাসী জীবন যাপন
আলী বানাত শুধু যে ধনকুবের ছিলেন তা নয়, এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন শৌখিন মানুষ। ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্রে তাঁর শৌখিন মনোভাবের আঁচ পাওয়া যায়। বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের, দামী সব পণ্য ব্যবহারের পাশাপাশি, তিনি সেগুলো সংগ্রহও করে রাখতেন। তার হাতে ব্যবহার করা প্রতিটি ব্রেসলেটের দাম প্রায় ৬০,০০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার দাম প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড় করানো ফেরারি স্পাইডার গাড়িটির দাম ৬ লক্ষ মার্কিন ডলার বা ৫ কোটি টাকা।
স্নিকার জুতোর প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তাঁর জুতোগুলোর দাম বলে শেষ করা দুষ্কর। ‘গিফট উইথ ক্যান্সার’ শিরোনামের ভিডিওটিতে দেখা যায়, তাঁর ড্রেসিং রুমের সাজসজ্জা এবং তাঁর ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্র থরে থরে সাজানো রয়েছে। কয়েক সারি জুতো, হ্যাট এবং লুইস ভিতনের সানগ্লাস। আলী বানাত বিভিন্ন রকম এবং ব্র্যান্ডের সানগ্লাস সংগ্রহ করতে ভালবাসতেন। তার ব্যবহার্য একজোড়া জুতোর দাম ১,৩০০ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১ লক্ষ টাকা; একজোড়া স্যান্ডেলের দাম ৭০০ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৫ সালে তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর, ক্যান্সারকে আল্লাহর উপহার হিসেবে গ্রহণ করে তিনি তার বিলাসী ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন ছেড়ে মানবতার সেবা করতে শুরু করেন।
ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে, এই পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে তাকে একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে এবং এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেই তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে। তাই তার শরীরে ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর তিনি তার সমস্ত ব্যবসা, অর্থ-সম্পদ দান করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদেকে সাহায্য করার লক্ষ্যে তাঁর সমস্ত অর্থ-সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে, ইউটিউব চ্যানেল ওয়ান পাথ নেটওয়ার্কে ক্যান্সার আক্রান্ত আলী বানাতের সাক্ষাৎকার সম্বলিত একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল। ভিডিও সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন বিশিষ্ট ইসলাম ধর্ম প্রচারক এবং চিন্তাবিদ মোহাম্মদ হবলস।
তাঁকে যখন জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, তিনি কেন ক্যান্সারকে আল্লাহর উপহার হিসেবে দেখছেন, আলী অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, “ক্যান্সার আমাকে পরিবর্তিত হবার সুযোগ দিয়েছে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ক্যান্সার না হলে হয়ত আমি জীবনটাকে ভিন্নভাবে দেখতে পারতাম না। এমনকি আরো ভুল পথে এগিয়ে যেতাম।”
তাঁর সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ:
মোঃ হবলস: ক্যান্সার কোন ব্যাপারে আপনার চোখ খুলে দিয়েছে?
আ. বানাত: সব, চারপাশের ছোটবড় সবকিছু! এমনকি নিঃশ্বাস গ্রহণ করার জন্য যে বাতাস, সেটিও আমার কাছে এখন অন্যরকম।
মোঃ হবলস: আপনি যেদিন প্রথম জানলেন আপনার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে, আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
আ. বানাত: আমার মনে হচ্ছিল আমি আমার গাড়ি, দামী ঘড়ি, এমনকি জামাকাপড় এসব থেকে মুক্তি পেয়েছি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর এসব আমি বিদেশে গিয়ে দুস্থ ও অসহায় মানুষদেরকে দান করে দিয়েছি। আমি এই পৃথিবীর কোনো কিছু সাথে নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই না, নিতে পারবোও না।
মোঃ হবলস: আপনার বাড়ির সামনে দামী ফেরারি গাড়িটি দেখলে আপনার এখন কেমন লাগে?
আ. বানাত: এসব কোনো কিছুই এখন আর আমার মনকে নাড়া দেয় না। এসব কোনো কিছুই আমার এখন আর করতে মন চায় না। আপনাকে যখন কেউ বলবে আপনি চূড়ান্ত পর্যায়ের (৪র্থ) ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং আপনার জীবন আর বেশিদিন নেই, তখন আপনার এসব দুনিয়াবি জিনিস আর ভাল লাগবে না। কারণ আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, এসব মূল্যবান জিনিসপত্র থেকে আপনার আর কোনো লাভ নেই। আপনি পরপারে কোনোকিছু সাথে নিয়ে যেতে পারবেন না। শুধু নিয়ে যেতে পারবেন আপনার কর্ম।
মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড প্রজেক্ট গঠন
২০১৫ সালে,তার শরীরে ক্যান্সার শনাক্ত হবার বছরই, তিনি বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদের সাহায্যার্থে ‘মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (এমএটিডব্লিউ)’ নামক একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। আলী বানাতের মৃত্যুর পর থেকে এখন পর্যন্ত, এই দাতব্য সংস্থা প্রায় ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডোনেশন সংগ্রহ করেছে এবং প্রতি মুহূর্তেই এই ডোনেশনের পরিমাণ বাড়ছেই।
মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড সংস্থাটির মাধ্যমে আফ্রিকা, টোগো, বুরকিনা ফাসো সহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশের হাজার হাজার দুস্থ মানুষের জন্য আলী বানাত মানবসেবা করে গিয়েছেন। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে গরীব-দুঃখীদের জন্য কাজ করেছেন, এবং তার সংস্থায় দান করার জন্য দাতা খুঁজেছেন। এর পাশাপাশি তাঁর দান করা অর্থ যেন সংস্থার প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত না হয় সেটি নিশ্চিত করেছেন। বর্তমানে এই দাতব্য সংস্থাটি আফ্রিকায় ২০০ জন বিধবা এবং ৬০০ এতিম বাচ্চার পুনর্বাসনের জন্য একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা এবং তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। অনুদান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে হাসপাতাল এবং স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা স্থাপন করা হচ্ছে।
গো ফান্ড মি’র সাথে সংযুক্তি
আলী বানাত যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনি সশরীরে থেকে এবং নিজের মাধ্যমে মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ‘গো ফান্ড মি’ নামক একটি অনুদান সংগ্রাহক সংস্থা এই কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে। আলীর রেখে যাওয়া তিনটি প্রজেক্টের জন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান সংগ্রহের লক্ষ্যে তারা তিন-চতুর্থাংশ অনুদান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রতিদিন নতুন নতুন অনুদান জমা পড়ছে। ইতোমধ্যে আফ্রিকায় বিধবা এবং এতিমদের জন্য একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেখানে স্কুল, হাসপাতাল এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।
তিনি তার নাতিদীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনে নানা সময়ে নানা দেশে ঘুরেছেন, অনেক মানুষের সাথে মিশেছেন, অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে যখন তিনি হাসপাতালে ক্যান্সারের সাথে লড়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই মানুষগুলো, বন্ধুগুলো দূরদূরান্ত থেকে এসে তাঁকে দেখে গিয়েছেন। আলী বানাতের কাছে এই ভালবাসাই তার জীবনের আসল প্রাপ্তি এবং আল্লাহর কৃপা বলে মনে করেন। মৃত্যুর পূর্বে শেষ ভিডিও ক্লিপটিতে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আপনারা জীবনে মানুষের জন্য কিছু করার জন্য একটি লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং প্রজেক্ট ঠিক করুন। নিজে করতে না পারলে অন্যের প্রজেক্টে দান করুন। কারণ হাশরের ময়দানে এসব দানই আপনার পক্ষে থাকবে। আমার ক্যান্সার হবার পর, আমি বিছানায় শুয়ে কান্না করতাম, আল্লাহর সাহায্য চাইতাম। আল্লাহতায়ালা আমার জীবনে এমন কিছু মানুষকে এনে দিয়েছিল, যাদের কথা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। আর এদের ভালবাসা নিয়েই আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো। আমার পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা একজন-দুইজন-তিনজন যে কয়জনকে পারেন, সাহায্য করুন। শেষ বিচারের দিন এরাই আপনাকে সাহায্য করবে।”
Feature Image: ytimg.com