হেনরি কাওয়েল বেড়ে উঠেছে দারিদ্র্য ও বিশৃঙ্খল জীবনকে সঙ্গী করে। মাত্র সাত বছর বয়সেই পড়াশোনা ছাড়তে হয় তাকে। শৈশবে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটি স্কুলে ঝাড়ুদারের কাজ করতো সে। কিন্তু অন্য সব বাচ্চাদের থেকে স্পষ্ট ব্যতিক্রম ছিল কাওয়েল। প্রায়ই দেখা যেত সে কাজে ফাঁকি দিয়ে ছুটে গেছে স্কুলের পিয়ানো বাজাতে। শৈশবেই সে অপূর্ব সুর তুলতে পারতো পিয়ানোতে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক লুইস টারমানের বিশেষত্ব ছিল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি পরিমাপের ক্ষেত্রে। আই.কিউ টেস্টের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেলগুলোর একটি, ‘স্ট্যানফোর্ড বিনেট’ তার সৃষ্টি। ঘটনাচক্রে তার পরিচয় হয় হেনরি কাওয়েলের সাথে। টারমান কাওয়েলের বুদ্ধিবৃত্তি পরিমাপ করতে চাইলেন। তিনি ভাবলেন ছেলেটি নিশ্চয়ই প্রচন্ড মেধাবী হবে; দারিদ্র্যের অভিশাপের মধ্যেও তার প্রতিভা যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।
আই.কিউ পরিমাপের পর দেখা গেল হেনরি কাওয়েল আসলেই অসাধারণ মেধাবীদের একজন। তার আই.কিউ ১৪০ এর উপরে, জিনিয়াস পর্যায়ের। টারমান অভিভূত হলেন। কে জানে, এমন আর কত রত্ন লুকিয়ে আছে ছাইয়ের স্তুপের ভেতরে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এদের হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। অন্যদেরও খুঁজে বের করতে হবে। এভাবেই শুরু হয় লুইস টারমানের প্রতিভার অন্বেষণ।
তিনি একটি মেয়েকে খুঁজে পেলেন, যে মাত্র উনিশ মাস বয়সেই অক্ষর জ্ঞান লাভ করেছে। আরেকজন চার বছর বয়সেই ডিকেন্স, শেক্সপীয়র শেষ করে ফেলেছে। আরেক তরুণের কাহিনী তো আরো অদ্ভুত। তাকে ল স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। কারণ তার প্রফেসর বিশ্বাস করতে পারেনি কোনো মানুষের পক্ষে এত বিশাল রচনা স্মৃতি থেকে হুবহু লেখা সম্ভব। ঈশ্বরপ্রদত্ত এ অসাধারণ মেধাবীরা প্রতিনিয়ত টারমানের বিস্ময়কে বাড়িয়ে তুলছিলো।
১৯২১ সালে এসে টারমান বিশাল পরিসরে এ গবেষণা চালানোর পরিকল্পনা করেন। কমনওয়েলথ থেকে বেশ বড়সড় অনুদানও জুটিয়ে ফেলেন তিনি। একদল কর্মীকে পাঠিয়ে দিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষকদের বলা হলো তাদের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বাছাই করতে। এরপর তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষা নেয়া হলো। সেখান থেকে বাছাই করা হলো প্রথম দশ শতাংশ ছেলে মেয়েদের। তাদের দ্বিতীয় ধাপে আবার যাচাই করা হলো। যারা ১৩০ এর উপর স্কোর করে, তারা মুখোমুখি হয় তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার।
এই প্রক্রিয়ায় টারমান প্রায় আড়াই লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীকে যাচাই করেন। আর তার মধ্য থেকে বাছাই করেছিলেন মাত্র চৌদ্দশ’ সত্তর জনকে। এদের সবার আই.কিউ ছিল ১৪০ থেকে ২০০ এর মধ্যে। বলাই বাহুল্য, টারমান বেছে নিয়েছিলেন সবচেয়ে মেধাবী ও উজ্জ্বল মস্তিষ্কগুলোকেই। টার্মাইটস নামে পরিচিত হয়ে ওঠে তারা। আর হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিষয়।
পরবর্তী গোটা জীবন লুইস টারমান তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের বিবাহ, অসুস্থতা, মানসিক অবস্থা সহ জীবনের অধিকাংশ কাজের হিসেব রেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। আন্তরিকভাবে পরিচর্যা করেছেন। নিয়মিত পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে গেছেন। তাদের চাকরির জন্য বা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের জন্য সুপারিশ করেছেন। তালিকা করেছেন তাদের অসাধারণ অর্জনগুলোর। আর এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন জেনেটিক স্টাডি অফ দ্য জিনিয়াসের বিশাল বিশাল ভলিউমে।
টারমান বিশ্বাস করতেন, একজন ব্যক্তির জন্য তার নীতিবোধের পর আই.কিউ’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। আর টার্মাইটরা ছিল সবাই উচ্চ আই.কিউ সম্পন্ন। বেড়ে ওঠার সময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সকল সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছিলো তাদের মাঝে। ক্যালিফোর্নিয়ার ছেলেমেয়েরা অংশ নেয় এমন যেকোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের তালিকায় থাকতো টার্মাইটদের নাম। লুইস টারমান কয়েকজন টার্মাইটের লেখা নিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্য সমালোচকদের কাছে। বিখ্যাত লেখকদের প্রথমদিকের লেখার সাথে তাদের লেখার মানের তফাৎ খুঁজে পাননি সমালোচকরা।
তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিয়ে প্রচন্ড আশাবাদী ছিল সবাই। সবার বিশ্বাস ছিল, এরাই হবে ভবিষ্যৎ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত সমাজ। টার্মাইটদের মধ্যে থেকে আসবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব। যারা দেশকে এগিয়ে নেবে বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায় ও সামাজিক উন্নয়নের দিকে। তাদের সফল ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেননি কেউ।
সাফল্য নিয়ে লুইস টারমানের এ ধ্যান ধারণা আমাদের সমাজে এখনো বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, সাফল্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যক্তির মেধা। তাই অদম্য মেধাবীদের প্রতি থাকে আমাদের বিশেষ পক্ষপাত। স্কুল-কলেজে মেধাবীদের জন্য বিশেষ প্রকল্প রাখা হয়। আই.কিউ পরীক্ষা করা হয় অনেক অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও।
গুগল, মাইক্রোসফটের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মী নেয়ার আগে যাচাই করে নেয় তার বুদ্ধিমত্তার ধার। একগাদা প্রশ্ন থাকে প্রার্থীদের স্মার্টনেস যাচাই করার জন্য। এর মধ্যে সেই বিখ্যাত প্রশ্নটিও থাকে, ‘ম্যানহোলের ঢাকনা বৃত্তাকার কেন?’ (উত্তরটা কি বলতে পারবেন? না পারলে দুঃখিত, আপনি মাইক্রোসফটে কাজ করার মতো স্মার্ট নন!)।
এ বিষয়গুলো ঘটে, তার কারণ হচ্ছে আমরা ভাবি মেধা বা ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভাই সাফল্যের মূল উপকরণ। উচ্চ আই.কিউ সম্পন্ন মানুষের কোনো কাজে ভালো করার, সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? এ প্রশ্নের জবাবের জন্য আমাদের টার্মাইটদের কাছে ফিরে যেতে হবে। সেসব উচ্চ আই.কিউ সম্পন্ন ছেলেমেয়ে কি সফল হয়েছিল?
টারমান যখন বার্ধক্যে পৌঁছুলেন, তার টার্মাইটরাও ততদিনে পৌঁছে গেছে তাদের জীবনের স্থিতিশীল পর্যায়ে। টারমান বুঝলেন, তার হিসেবে কোথাও একটা বড়সড় ভুল রয়ে গিয়েছিলো। তার টার্মাইটদের মধ্য থেকে একজনও ততটা বিখ্যাত কেউ হয়ে উঠতে পারেনি, যতটা হবে বলে তিনি আশা করছিলেন। তাদের কেউ কেউ লেখক হয়েছে, গবেষণামূলক কাজ করেছে। কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাও হয়েছে, দু’জন বিচারপতি হয়েছে। কিন্তু খুব কমজনই জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছিল। তারা ভালো আয় করতো- কিন্তু ততটা ভালো নয়।
আর বেশিরভাগের ক্ষেত্রে বলা যায়, একদমই গড়পড়তা ক্যারিয়ার ছিল তাদের। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, কয়েকজনের ক্যারিয়ারকে টারমান নিজেই ব্যর্থ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজনও নোবেল বিজয়ী ছিলেন না। অবশ্য তার কর্মীরা দুজন নোবেল বিজয়ীকে যাচাই করেছিলেন, উইলিয়াম শকলি এবং লুইস অ্যালভারেজ। কিন্তু তারা বাছাইতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কারণ তাদের আই.কিউ যথেষ্ট ছিলো না।
এখন প্রশ্ন জাগে, টারমানের হিসেবে ভুলটা কী ছিল? তবে কি সাফল্যে আই.কিউ’র ভূমিকা নেই? এর উত্তর ম্যালকম গ্লাডওয়েল তার আউটলায়ার্স বইয়ে বেশ চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, ব্যক্তির সাফল্যের ক্ষেত্রে আই.কিউ’র গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু এখানে একটি থ্রেশহোল্ড পয়েন্ট আছে, যে পর্যায়টি পার করলে আই.কিউ’র ভূমিকা নগণ্য।
বাস্কেটবল খেলার কথাই ধরুন। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা নিয়ে কেউ কি ভালো বাস্কেটবল খেলোয়াড় হতে পারবে? বিষয়টা অসম্ভবই বলা যায়। এর জন্য নূন্যতম ছয় ফুট এক/দুই ইঞ্চি উচ্চতার দরকার। অর্থাৎ বাস্কেটবলে ভালো করার জন্য উচ্চতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কিন্তু এর মানে এই নয় যে ছয় ফুট আট ইঞ্চির একজন খেলোয়াড় উচ্চতার জন্য ছয় ফুট ছয় ইঞ্চির একজনের চেয়ে ভালো করবে। তখন পার্থক্য গড়ে দেবে তার অন্যান্য দক্ষতা।
আই.কিউ’র ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। কোনো কাজে ভালো করতে হলে আপনার বুদ্ধিমত্তা একটা নির্দিষ্ট সীমার উপরে হতে হবে, এটি সত্য। হয়তো ১২০ এর উপর হতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এরপর যার মেধা যত বেশি, সে তত সফল হবে। তখন সফলতা নির্ভর করবে অন্য বিষয়গুলোর ওপর। আপনার অধ্যবসায়, অনুশীলন, সুযোগের সদ্ব্যবহার- এসবই গড়ে তুলবে পার্থক্য।
একটা উদাহরণ দেয়া যায়, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আই.কিউ ছিল ১৬০ এর মতো। তার চেয়েও উচ্চ আই.কিউ সম্পন্ন অনেকের দেখা পাওয়া গেছে আজ পর্যন্ত। যেমন ক্রিস ল্যাঙ্গানের আই.কিউ ১৯৫। হ্যাঁ ক্রিস ল্যাঙ্গান আইনষ্টাইনের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু তার মানে কি তার অর্জন আইনষ্টাইনের চেয়ে বেশি?
এ কথাটি আরো অনেক ক্ষেত্রে খাটে। যেমন আমাদের সমাজে কাঙ্ক্ষিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে অনেককেই হতাশ হয়ে পড়তে দেখা যায়। হয়তো অনেকে ভেবে বসে থাকেন, আমি ওদের মতো মেধাবী না; আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু আসল সত্যটি হলো আপনার মেধা যদি একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের বেশি হয়ে থাকে, তাহলে মেধার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার অন্য দক্ষতাগুলো। এ বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করা দরকার। যেমনটি লুইস টারমান উপলব্ধি করেছিলেন, সাফল্য ও মেধার মধ্যে তেমন সরাসরি সম্পর্ক নেই।